এক মাস আগে রাজধানীর খুচরা বাজারে প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজের দাম ছিল ৪৫ থেকে ৫০ টাকা। সোমবার তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮০ থেকে ৯০ টাকায়। অর্থাৎ মাসের ব্যবধানে দেশি পেঁয়াজের দাম বেড়েছে ৭৯ শতাংশ।
Advertisement
একই অবস্থা আমদানি করা পেঁয়াজের ক্ষেত্রেও। সোমবার প্রতি কেজি আমদানি করা পেঁয়াজের দাম বেড়ে হয়েছে ৬০ থেকে ৭০ টাকা। এক মাস আগে যা ছিল ৩৫ থেকে ৪০ টাকা। অর্থাৎ আমদানি করা পেঁয়াজের দাম বেড়েছে ৭৩ শতাংশ।
শুধু মাসের হিসাবে নয় বছরের হিসাবেও দেশি ও আমদানি করা উভয় ধরনের পেঁয়াজের দাম বেড়েছে বহুগুণ। এক বছর আগে দেশি পেঁয়াজের কেজি ছিল ৩০ থেকে ৩৫ টাকা। আর আমদানি করা পেঁয়াজের কেজি ছিল ২০ থেকে ২৮ টাকা। সেই হিসাবে বছরের ব্যবধানে দেশি পেঁয়াজের দাম বেড়েছে ১৬২ শতাংশ এবং আমদানি করা পেঁয়াজের দাম বেড়েছে ১৭১ শতাংশ।
শুধু পেঁয়াজ নয় বর্তমানে প্রতিটি নিত্যপণ্যের বাজারদর বেশ চড়া। চিকন চাল ৬০ টাকা নিচে মিলছে না। গরিবের মোটা চালের দাম ৫০ টাকার ওপর। আদার কেজি ১৬০ টাকা। কাঁচামরিচও ১৫০ টাকার নিচে মিলছে না। আর যেকোনো ধরনের সবজির কেজি ৪০ টাকার ওপরে। কিছু কিছু সবজির দাম ব্রয়লার মুরগির দামের থেকেও বেশি।
Advertisement
অবস্থা অনেকটা এমন দাঁড়িয়েছে যে, দ্রবমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে শহর থেকে গ্রামে, নিম্নআয়ের চাকরিজীবী থেকে শুরু করে দিনহাজিরা শ্রমিক সবারই নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা। আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের সমন্বয় করতে না পারায় নিম্নআয়ের অনেকেরই এখন তিন বেলা খাবার জোটানো দূরূহ হয়ে পড়েছে।
বেসরকারি একটি বীমা কোম্পানিতে অফিসার পদে কাজ করেন মো. আজিজুর রহমান। তিনি জানান, পরিবারসহ দুই সন্তান নিয়ে মানিকনগরের একটি ভাড়া বাসায় তার বসবাস। দুই সন্তানই স্কুলে পড়ে। বড় ছেলে চতুর্থ শ্রেণিতে আর ছোট মেয়ে পড়ে দ্বিতীয় শ্রেণিতে।
তিনি বলেন, সারা মাসে যে আয় করি সংসার চালাতেই সব খরচ হয়ে যায়। মাস শেষে কোনো টাকা জমা থাকে না। আর গত কয়েক মাস ধরে যে হারে খাদ্যদ্রব্যের দাম বেড়েছে তাতে ঠিকমতো সংসার চালানো দায় হয়ে পড়েছে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, গত মাসে এক সহকর্মীর কাছ থেকে টাকা ধার করে সংসার চালাতে হয়েছে।
শুধু আজিজুর নয়, রাজধানীতে বসবাস করা একটি বড় অংশের জীবনযাত্রার চিত্র এটি। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে অনেক কর্মজীবী দুপুরে ভাত খাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন। গত এক মাসে রাজধানীতে বসবাস করা বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার কমপক্ষে ৫০ জনের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
Advertisement
গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০১৬ সালের খানা আয়-ব্যয় জরিপে উল্লেখ করা হয়, খানাপ্রতি মাসিক আয় দাঁড়িয়েছে ১৫ হাজার ৯৪৫ টাকা, যা ২০১০ সালে ছিল ১১ হাজার ৩৫৩ টাকা। অর্থাৎ ছয় বছরের ব্যবধানে খানাপ্রতি মাসিক আয় বেড়েছে চার হাজার ৫৯২ টাকা বা ৪০ শতাংশ হারে।
অপরদিকে ২০১৬ সালের হিসাবে খানাপ্রতি মাসিক ব্যয় দাঁড়িয়েছে ১৫ হাজার ৯১৫ টাকা, যা ২০১০ সালে ছিল ১১ হাজর ২০০ টাকা। অর্থাৎ ছয় বছরের ব্যবধানে খানাপ্রতি ব্যয় বেড়েছে চার হাজার ৭১৫ টাকা। ব্যয় বৃদ্ধির এ হার ৪২ শতাংশ।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বিবিএস যে প্রতিবেদন তৈরি করেছে তা ২০১৬ সালের আয়-ব্যয়ের ভিত্তিতে। সেই সময় দ্রব্যমূল্যের দাম ছিল এখনকার থেকে বেশ কম। বর্তমান সময়ের আয়-ব্যয়ের ভিত্তিতে প্রতিবেদন তৈরি করলে দেখা যাবে আয়ের তুলনা ব্যয়ের পরিমাণ বেশি হয়ে যাচ্ছে। দ্রব্যমূল্যের যে ঊর্ধ্বগতি তাতে মাসিক আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলাতে দেশের একটি বড় অংশের মানুষকে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
ভোক্তাদের সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়ায় মানুষ অনেক কষ্টে আছে। বিশেষ করে নিম্ন ও মধ্যবিত্তের জীবনধারণ অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে। একটি পণ্যের দাম বাড়লে সমস্যা নেই। সেটা হতেই পারে। কিন্তু এখন নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যের দাম ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। মানুষের আয়ের তুলনায় ব্যয় বেশি। সঞ্চয় তো করতেই পারছে না। অনেক ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় খরচও কাটছাঁট করতে হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে জীবনযাত্রার ব্যয় মিটিয়ে মানুষের বেঁচে থাকা দায় হয়ে পড়বে।
টিসিবির তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে প্রতি কেজি আদার দাম বেড়ে ১৬০ টাকায় পৌঁছেছে। এক মাস আগেও এক কেজি ভালো মানের আদার দাম ছিল ১২০ টাকার মতো। অর্থাৎ মাসের ব্যবধানে কেজিতে আদার দাম বেড়েছে প্রায় ৩০ শতাংশ। আর বছরের ব্যবধানে দাম বেড়েছে ৫৩ শতাংশ। এক বছর আগে এক কেজি আদার দাম ছিল সর্বোচ্চ ১১০ টাকা।
এক বছর আগের তুলনায় বর্তমানে প্রতি কেজি সরু চালের দাম বেড়েছে ২১ শতাংশ। মোটাজাতের পাইজাম বা লতা চালের দাম বেড়েছে ২৩ শতাংশ এবং স্বর্ণা বা চায়না ইরির দাম বেড়েছে ১৫ শতাংশ। অপরদিকে আটার দাম বেড়েছে ৫ থেকে ১০ শতাংশ।
অথচ এক বছর আগের তথ্য নিয়ে বিবিএস যে তথ্য প্রকশ করেছে তাতে দেখা যাচ্ছে, মাথাপিছু দৈনিক খাদ্য গ্রহণের পরিমাণ ১০০০ গ্রাম থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ৯৭৬ গ্রামে। চাল, ডাল, আটাসহ নিত্যপণ্যের বর্তমান দাম হিসাবে নিলে দৈনিক খাদ্য গ্রহণের পরিমাণ আরও কম হবে।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির প্রভাবে চাল-আটা কেনার পরিমাণও কমিয়ে দিয়েছেন অনেকে। ব্যবসায়ীরা বাধ্য হয়ে মোটা চালের বস্তা ৫০ কেজি থেকে কমিয়ে ২৫ কেজি করেছেন। এ বিষয়ে যাত্রাবাড়ী চাল আড়তের বিক্রেতা মো. আলাউদ্দিন বলেন, সম্প্রতি চালের দাম যেভাবে বেড়েছে, আমার ২০ বছরের ব্যবসায় এমন চিত্র আগে কখনও দেখিনি। ছয় মাস আগেও যারা ৫০ কেজি চালের বস্তা কিনতে এখন তারা ২০ থেকে ২৫ কেজি করে চাল কিনছেন। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, মোটা চালের বস্তার পরিমাণ কমিয়ে ২৫ কেজিতে নামিয়ে আনা হয়েছে। আগে কখনও মোটা চাল ৫০ কেজির নিচের বস্তায় বিক্রি হয়নি। শুধু মিনিকেট ও বাসমতি চাল ২৫ কেজির বস্তায় বিক্রি হতো। কিন্তু ক্রেতাদের চাল কেনার পরিমাণ কমে যাওয়ায় ব্যবসায়ীরা মোট চাল ২৫ কেজি বস্তা করতে বাধ্য হয়েছেন।
তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, এক বছর আগের তুলনায় প্রতি কেজি খোলা সয়াবিন তেলের দাম বেড়েছে প্রায় তিন শতাংশ এবং বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম বেড়েছে প্রায় নয় শতাংশ। মুগ ডালের দাম বেড়েছে ২৮ শতাংশের ওপরে। ৫৩ শতাংশ বেড়েছে আদার দাম। দাম বাড়ার এ তালিকায় রয়েছে শুকনা মরিচ, হলুদ, দারুচিনি, এলাচ, ধনে, তেজপাতা থেকে শুরু করে সবধরনের মাছ ও মাংস।
আট হাজার টাকা বেতনে একটি গার্মেন্টসে কাজ করেন ফাতেমা বেগম। স্বামীও গার্মেন্টসকর্মী। দু’জনে মিলে মাসে আয় করেন প্রায় ২০ হাজার টাকা। দুই সন্তান নিয়ে বাড্ডার একটি ভাড়া বাড়িতে থাকেন। ফাতেমা বলেন, প্রতি মাসে বাসা ভাড়া দিতে হয় আট হাজার টাকা। দুই সন্তানের মধ্যে বড় ছেলে স্কুলে পড়ে। দু’জন যা আয় করি তা দিয়ে সংসার খরচ, সন্তানের পড়ালেখার খরচ চালাতে হয়। এর বাইরে গ্রামের শ্বশুর-শাশুড়ি ও এক ননদ আছেন। প্রতি মাসে তাদেরও টাকা দিতে হয়।
তিনি বলেন, প্রতি মাসে গ্রামে তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা পাঠাতাম। কিন্তু গত মাসে টাকার অভাবে দুই হাজার টাকা পাঠিয়েছি। তাতে শ্বশুর-শাশুড়ির মন কিছুটা খারাপ। তারা মনে করেন, আমরা অনেক টাকা আয় করি। কিন্তু কীভাবে তাদের বোঝাব, ঢাকায় থাকার কত খরচ!
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে বলেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বাড়লে নিম্নআয়ের মানুষের কষ্ট হবে, এটাই স্বাভাবিক। সম্প্রতি পণ্যের যে দাম বেড়েছে তা চাহিদা ও সরবরাহের পার্থক্যের কারণেই মনে হচ্ছে। কারণ কাঁচা সবজি মজুদ করে রাখা সম্ভব নয়। সুতরাং এটি মজুদ করে দাম বাড়ানো হচ্ছে, এটা বলা যাচ্ছে না। মূলত যে পরিমাণ চাহিদা রয়েছে সরবরাহ তার থেকে কম, সে কারণে দাম বাড়ছে। তবে মানুষ যদি বেশি দামে না কেনে তাহলে দাম কমে যাবে।
এমএএস/এমএআর/বিএ