ম্যালেরিয়া নামটি একটা ভুলের প্রতীক হলেও তার জীবন বিধ্বংসী ক্ষমতার কথা আমরা সকলেই হয়তো কম বেশি জানি। কারণ জীবনহরণের মতো ভয়ংকর ব্যাপারে তার কিন্তু কোনো ভুল হয় না। ম্যালেরিয়া রোগটির কারণ হিসেবে একসময় ধারণা করা হতো ”দূষিত বাতাস” থেকেই এ রোগটি সৃষ্টি হয়ে থাকে। সেই ধারণাগত জায়গা থেকেই Mal (দূষিত) Aria(বাতাস) এ দুটো শব্দ মিলেমিশে Malaria (ম্যালেরিয়া) নামক শব্দের জন্ম দিয়েছে।
Advertisement
যদিও ১৮৯৭ সালে বিজ্ঞানী রোনাল্ড রস প্রমাণ করে দিলেন ম্যালেরিয়া নামক কথিত এ জ্বরের জন্য দূষিত বাতাস নয় বরং এনোফিলিস গোত্রের মশারাই দায়ী। তবুও ধারণাগত সে ভুল নামটিই এখনও বিশ্বব্যাপী প্রচলিত রয়েছে। বিশ্বব্যাপী কোটি কোটি মানুষ বিশেষ করে আফ্রিকা অঞ্চলে ব্যাপকহারে মানুষের প্রাণঘাতির জন্য মশাবাহিত সংক্রামক এ রোগটিই দায়ী। সুতরাং কথায় আছে “নাম দিয়ে কাম কি?”
আসলে নাম দিয়ে কোনো লাভ নেই। তবে, সম্প্রতি এ নামের পূর্বে ‘সুপার’ যুক্ত করে একে আরো ভয়ংকরভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে ‘সুপার ম্যালেরিয়া’ নাম দিয়ে। ফলে এক অহেতুক আতংকজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। যদিও আমাদের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) বলেছে সুপার ম্যালেরিয়া নিয়ে ঠিক এই মুহূর্তে ভয় পাওয়ার কিছুই নেই ( সূত্র: ২৫ সেপ্টেম্বর, কালের কণ্ঠ)। তবুও এটা সত্য যে আতংক কিছুটা রয়েই গেছে।
‘সুপার ম্যালেরিয়া’ শব্দটির চল শুরু হয়েছে সম্প্রতি দক্ষিণ ভিয়েতনামে প্রথম লাইন ওষুধ প্রতিরোধী এক ধরনের ম্যালেরিয়া অণুজীবী আবিষ্কার হওয়ার পরে। অথচ এটা কিন্তু প্রথম ধরা পড়ে ২০০৮ সালে কম্বোডিয়াতে। তাহলে এখন এত দিন পরে এত হৈ চৈ কেন? আর একে ‘সুপার ম্যালেরিয়া’ নামকরণই বা কারা করলো?
Advertisement
এর উত্তর খুঁজতে গিয়ে দেখি The Lancet Infectious Diseases নামক প্রভাবশালী চিকিৎসা সাময়িকীতে ভিয়েতনামে ওষুধ প্রতিরোধী ম্যালেরিয়া জীবাণু নিয়ে রিপোর্ট হওয়ার পরেই এটা নিয়ে প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়া সরব হয়ে ওঠে। ফলে একটা অজানা আতংকে আমার মতো কেউ যদি ভুগে থাকে তাহলে তাকে দোষ দেয়াটা বোধ হয় ঠিক হবে না। কারণ সেখানে এর জীবন সংহারী ভয়াবহ রূপের কথা তুলে ধরা হয়েছে।
যদিও এর জের ধরেই ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ডা. পেড্রো এ্যালেনসো যিনি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ”গ্লোবাল ম্যালেরিয়া প্রোগ্রামের” পরিচালক তিনি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ওয়েবসাইটে লিখেছেন যে, যথাযথভাবে সংজ্ঞায়িত না করেই এমন একটা নামের প্রচলন করা হয়েছে এবং এ কারণেই বিশ্বব্যাপী বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এবং পাবলিক হেল্থ নিয়ে যারা কাজ করছেন তারা এ নামের কোনো স্বীকৃতি দেননি। উনি অবশ্য একে ‘ডেঞ্জারাস ম্যালেরিয়া’ বলে উল্লেখ করেছেন। সেখানে তিনি এ নিয়ে অহেতুক আতংকিত না হওয়ারও পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি বলতে চেয়েছেন ”ডাই হাইড্রোআর্টেমিসিনিন -পিপেরাকুইন” নামক প্রথম লাইন ওষুধ ম্যালেরিয়ার চিকিৎসায় ২৬%-৪৬% অবধি ব্যর্থ হলেও দ্বিতীয় এবং তৃতীয় লাইনের যে ওষুধ ”আর্টিসুনেট-মেফলোকুইন” এবং “আর্টিসুনেট-পাইরোনারিডিন” তা ম্যালেরিয়া প্রতিরোধী অণুজীবীর বিরুদ্ধেও দারুণ কাজ করছে।অথচ পরবর্তীতে তার এ কথাগুলো আর সেভাবে মিডিয়াতে আসেনি। ফলে একটা চাপা আতংক অনেকের মনে থেকে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়। তাই বাস্তবতার নিরিখেই সুপার ম্যালেরিয়া নিয়ে অহেতুক আতংক দূর করা এবং হওয়াটা এখন ভীষণ জরুরি। কারণ প্রথম যখন পত্রিকাতে এ সংক্রান্ত নিউজ দেখেছিলাম তখন আমিও যে কিছুটা ভয় পায়নি সেটা আজ আর নিশ্চিতভাবে অস্বীকার করতে পারছি না।
সুপার ম্যালেরিয়া নিয়ে তাই অল্প স্বল্প একটা ধারণা থাকাটা মনে হয় জরুরি হয়ে পড়েছে এখন। ম্যালেরিয়া মূলত আফ্রিকাসহ বিশ্বের নানা প্রান্তে প্রতিবছর ব্যাপক হারে মানুষের মৃত্যু ঘটায়। আমাদের কাছাকাছি মেকং নদীর তীরবর্তী অঞ্চলসমূহের দেশ মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, লাওস, কম্বোডিয়া এবং চীনের কিছু অংশ যা “বৃহত্তর মেকং উপাঞ্চল” (Greater Mekong Subregion) নামে পরিচিত সেখানে এক ধরনের ওষুধ প্রতিরোধী ম্যালেরিয়া অণুজীবীর উপস্থিতি ধরা পড়েছে। সেটাই এখন সুপার ম্যালেরিয়া নামে পরিচিতি লাভ করেছে।
তবে এটা ঠিক এ ধরনের অণুজীবীর উপস্থিতি এবং বিস্তার কিছুটা হলেও আমাদের দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে। কারণ এ দেশসমূহ আমাদের কাছাকাছি। মিয়ানমারের সাম্প্রতিক অবস্থার ফলে যেভাবে রোহিঙ্গারা আসছে সেটা এ কারণে এখন বাড়তি উদ্বেগের বিষয়ও হতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসাম, ত্রিপুরা ও মেঘালয় এবং মিয়ানমার ঘিরে থাকা সীমান্তবর্তী বাংলাদেশের ১৩টি জেলায় ম্যালেরিয়ায় রোগের ব্যাপক বিস্তার রয়েছে। আর রোগটি যেহেতু সংক্রামক অর্থাৎ আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে মশার মাধ্যমে সুস্থ ব্যক্তির দেহ প্রবেশ করে ফলে বাড়তি সর্তকতা নেয়াটা মনে হয় সুবিবেচনার কাজ হবে।
Advertisement
ভৌগোলিক অবস্থান, বিদেশ ভ্রমণ, ট্যুরিজমসহ নানা বিষয়ের কারণেই পৃথিবী এখন একটা গুচ্ছ গ্রামের ন্যায়। সেখানে মেকং অঞ্চলের দেশসমূহ যেহেতু আমাদের অত্যন্ত কাছাকাছি এবং নানা কারণেই সেখানে মানুষের অবাধ যাতায়াত ফলে এটা সহজেই এক দেশ থেকে অন্য দেশে ছড়িয়ে পড়তে পারে। সে ব্যাপারে সতর্কতা থাকাটা তাই খুবই দরকার।
একই সাথে আতংকিত না হওয়ার ব্যাপারে জনগণকে সচেতন করা যেতে পারে। সেই সাথে তাদেরকে কোনোরকম গুজবে কান না দেয়ার ব্যাপারেও সতর্ক করতে হবে। তা না হলে দেখা গেলো সে সুযোগে সকল কাজের বর্তমান কাজী “সোশ্যাল মিডিয়ায়” গুজব ছড়িয়ে অহেতুক একটা আতংকময় পরিবেশ তৈরি করতে গুজব রটনাকারীরা সচেষ্ট হতে পারে। সোশ্যাল মিডিয়া বিশেষ করে ফেসবুক ব্যবহারকারীদের এ সংক্রান্ত কোনো রকম খবর তাই বাছবিচার না করে বিশ্বাস করাটা ঠিক হবে না। সবশেষে বলি, আপনি যদি ম্যালেরিয়া প্রবণ এলাকায় বেড়াতে যান তাহলে তার পূর্বে চিকিৎসকের সাথে দেখা করুন। তার পরামর্শ নিন। সেই সাথে ঘুরে আসার পরে দু’সপ্তাহের মধ্যে কোনো রকম জ্বর শুরু হলেই দেরি না করে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন। সেটাই বরং বুদ্ধিমানের কাজ হবে।তাই ‘সুপার ম্যালেরিয়া’ নিয়ে অহেতুক ‘সুপার’ আতংকে ভোগার তেমন কোনো কারণ নেই। কারণ যাকে ‘সুপার ম্যালেরিয়া’ বলা হচ্ছে সেটা বিপদজনক ঠিকই কিন্তু তা অনিরাময়যোগ্যও নয়।
লেখক : চিকিৎসক ও শিক্ষক। সহযোগী অধ্যাপক, ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগ, এনাম মেডিকেল কলেজ।
এইচআর/আরআইপি