সোমবার ঘোষণা করা হয়েছে চিকিৎসা বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত তিন মার্কিন বিজ্ঞানীর নাম। যৌথভাবে নোবেল প্রাপ্তরা হলেন জেফরি সি হল, মাইকেল রসবাশ ও মাইকেল ডব্লিউ ইয়ং। বায়োলজিক্যাল ঘড়ির কর্মপদ্ধতি নিয়ে গবেষণা করার জন্য তারা এই পুরস্কার পেয়েছেন।
Advertisement
বাংলা একটা গান নিশ্চয় সবার মুখে মুখে ফেরে। যদিও পরিচিত গানটির সুরকার, গীতিকার, গানটির রচনাকাল সম্পর্কে কোনো তথ্য জানা নেই গবেষকদের। গানটি হলো—
একটি চাবি মাইরা দিছে ছাইড়াজনম ভরি চলিতেছে।মন আমার দেহ ঘড়ি সন্ধান করিকোন মিস্ত্ররী বানাইয়াছে।থাকের একটা কেস বানাইয়া মেশিন দিলো তার ভিতরওরে রং বেরংয়ের বার্নিশ করা দেখতে ঘড়ি কি সুন্দর।
বাংলা গানেই অনেক আগেই মানুষের পুরো শরীরকে ঘড়ির সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। মানুষের শরীরের ‘দেহঘড়ি’ এই গবেষণার সূত্রটি চিনিয়ে দেয়। মার্কিন ওই বিজ্ঞানীরা এই গানটির কথা জানেন কি না জানা নেই। প্রমাণ নেই তারা আদৌও ওই গানটি শুনেছেন কি না? তবে এই মানবঘড়ি নিয়ে গবেষণা করেই তারা পেলেন পুরস্কার জগতের সর্বোচ্চ খেতাব।
Advertisement
ওই তিন মার্কিন বিজ্ঞানী গবেষণা করে বের করেছেন এই ঘড়ি কী পদ্ধতিতে কাজ করে? মানুষ, প্রাণীজগৎ এবং পুরো প্রকৃতি একটি ঘড়ির সিস্টেমে চলে। এই ঘড়িই ঠিক করে দেয় কোন সময়ে কোন ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সংঘটিত হবে।
মানুষ একটা অভ্যাসে শৃঙ্খলিত। এই অভ্যাস নিয়ন্ত্রণ করে বায়োলজিক্যাল ক্লক বা সেই বাংলা গানের মতো দেহঘড়ি। এই যে আমরা রাতে ক্লান্ত শরীরে ঘুমিয়ে পড়ি। বায়োলজিক্যাল ঘড়ি তখন জানান দেয়— তুমি ক্লান্ত, তোমার এখন ঘুমিয়ে পড়ার সময়। আবার যখন ঘুম ভাঙে তখন বায়োলজিক্যাল ঘড়ি জানান দেয়, তোমার ঘুম ভাঙার সময়, তুমি উঠে পড়ো।
কেবল ঘুম নয় এই বায়োলজিক্যাল ঘড়ি নিয়ন্ত্রণ করে মানুষের যাবতীয় খাদ্যাভ্যাস, জীবনযাপন, পাশাপাশি শরীরের হরমোন নিঃসরণ ও নিয়ন্ত্রণের কাজটিও করে এ বায়োলজিক্যাল ক্লক।
দিনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আমরা সময়কে ভাগ করেছি ২৪ ঘণ্টায়। এই সময়গুলোতে আমরা ধরে নিই কোন সময়, কোন কাজ করতে হবে। তেমনি বায়োলজিক্যাল ঘড়ির চক্র জানান দেয় কোন সময়ে কোন কাজ করতে হবে।
Advertisement
ক্ষুধা লাগলে আমরা খাই, ক্ষুধার সিগনাল দেয় এই বায়োলজিক্যাল ঘড়ি, আমরা কোনো ঘটনায় হাসি-কাঁদি এই সিগন্যালও দেয় বায়োলজিক্যাল ঘড়ি। আর বায়োলজিক্যাল ঘড়ি নিয়ন্ত্রিত হয় পুরো ব্রেইন থেকে।
আমাদের ব্রেইনে একটি মাস্টার ক্লক থাকে। আর বায়োলজিক্যাল ঘড়ি এই মাস্টার ক্লকের নিয়ন্ত্রণাধীন। ধরা যাক, আপনি কোনো বাড়ির মালিক। এই বাড়িতে বিদ্যুতের একটি মেইন মিটার থাকে। এরপর সেই মিটার ঘিরেই থাকে একাধিক সাব মিটার। তেমনি মানুষের মস্তিষ্কে মেইন মিটারের মতো রয়েছে একটি মেইন ক্লক। আর বায়োলজিক্যাল ঘড়ি তার অধস্তন একটি ঘড়ি বা সিরাকাডিয়ান রিদম।
এই বায়োলজিক্যাল ঘড়ি মানুষ শুধু নয়, উদ্ভিদের বেলায়ও প্রযোজ্য। ধরা যাক শিউলি ফুলের কথা কিংবা নাইট কুইনের কথা। শিউলি ফুল রাতে কেন ফোটে? আর নাইট কুইন কেন রাতে প্রস্ফুটিত হয়? উত্তর হলো : বায়োলজিক্যাল ঘড়ি নিয়ন্ত্রণ করে পুষ্পের প্রস্ফূটিত হওয়ার প্রক্রিয়া। লজ্জাবতী গাছ পরশ পেলেই পাতা গুটায় এটাও বায়োলজিক্যাল ঘড়ির সিস্টেম।
আলেক্সজান্ডার দ্য গ্রেটের অধীনস্থ এক জাহাজের ক্যাপ্টেন এন্ড্রস্থেন তেতুলের গাছের ডাইওরনাল পাতা (দিনে পাতা খোলা আর রাতে পাতা বন্ধ) নিয়ে প্রথম এই ঘড়ির কথা বলেন। আধুনিককালে ফ্রেঞ্জ বিজ্ঞানী জ্যাকুস ১৮ শতকে লজ্জাবতী গাছে আলো-আধারের প্রভাব নিয়ে আলোচনা করেন। ১৮৯৬ সালে পেট্রিক আর গিলবার্ট ২৪ ঘণ্টায় মানুষের ঘুম নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। ১৯১৮ সালে আলোক সংবেদনশীলতা আর তাপমাত্রার প্রভাবক হিসেবে বায়োলজিক্যাল ঘড়ির প্রভাব বর্ণনা করেন। ১৯৯৪ সালে জোসেহ তাকাহাসি স্তন্যপায়ীদের মধ্যে ক্লক জিন আবিষ্কার করেন।
বায়োলজিক্যাল ঘড়িকে সিরাকাডিয়ান রিদমও বলা হয়। আমাদের দেহে লোহিত রক্তকণায় সিরাকাডিয়ান রিদমের উপস্থিতি রয়েছে। মানুষের ডিএনএতেও এই রিদম রয়েছে।
নোবেল প্রাইজের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ থেকে বলা হয়, জীবজগত পৃথিবীর আবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়। অনেক দিন ধরেই আমরা জানি মানুষসহ সব প্রাণীর একটি বায়োলজিক্যাল ঘড়ি রয়েছে যার মাধ্যমে দিনটি কেমন যাবে সেটা অনুমান করার পাশাপাশি নিজেকে মানিয়ে নেয়। এই বায়োলজিক্যাল ঘড়ি মানুষের ঘুমের রুটিন, খাদ্যাভ্যাস, রক্তচাপ, হরমোন প্রভৃতি নিয়ন্ত্রণ করে।
সেই ঘড়ির কর্মপদ্ধতি জেফরি সি হল, মাইকেল রসব্যাশ ও মাইকেল ডব্লিউ ইয়ং ব্যাখ্যা করেছেন এবং কীভাবে সেটি কাজ করে তার ধারণা দিয়েছেন। তাদের আবিষ্কার দেখিয়েছে কীভাবে গাছ, প্রাণী ও মানুষ পৃথিবীর আবর্তনের সঙ্গে তাদের জৈবিক ছন্দ মিলিয়ে নেয়।
তবে এই বায়োলজিক্যাল ঘড়িও এক সময় থেমে যায়। তখন কিন্তু চূড়ান্ত পরিণতি চলে আসে। যার অপর নাম মৃত্যু।
সূত্র : ইন্টারনেট
একে/আরআইপি