বিশেষ প্রতিবেদন

সরকারের ব্যর্থতায় চালের মূল্যবৃদ্ধি : অভিমত অর্থনীতিবিদদের

দেশের বাজারে পাগলা ঘোড়ার মতো ছুটছে চালের দাম। লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে সরু চালের কেজি ৬০ টাকা ছাড়িয়ে গেছে। গরিবের মোটা চাল ৫০ টাকার নিচে মিলছে না। অবস্থা বেগতিক দেখে চাল মজুতদারদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়েছে সরকার। একাধিক মিল মালিককে জরিমানার পাশাপাশি কয়েকজনকে গ্রেফতারও করা হয়েছে। এরপরও সহনীয় পর্যায়ে নামেনি চালের দাম।

Advertisement

চালের দামের এমন লম্ফনের জন্য সরকারের নীতিকেই দায়ী করছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, চাল আমদানি ও মজুতের ক্ষেত্রে সরকার সঠিক পদক্ষেপ নেয়নি। ফলে বাজারে চালের চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে বড় ধরনের গ্যাপ সৃষ্টি হয়। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকায় দাম হু হু করে বাড়ে।

এ পরিস্থিতিতে চালের দাম সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনতে আমদানির দিকে সব থেকে বেশি নজর দিতে হবে। আমদানি বাড়িয়ে সরকারের মজুত বৃদ্ধি এবং খোলাবাজারে বিক্রির কার্যক্রম সম্প্রসারণ করতে হবে। সেইসঙ্গে কমাতে হবে ওএমএস-এর (খোলাবাজারে চাল বিক্রি কর্যক্রম) চালের দাম।

রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ছয় মাসের বেশি সময় ধরে চালের দাম বাড়ছে। তবে পবিত্র ঈদুল আজহার পর হঠাৎ করেই অস্বাভাবিক হারে চালের দাম বাড়ে। ঈদুল আজহার আগে যে চাল ৫০ টাকা কেজি বিক্রি হয়, সেই চাল এখন বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকার ওপরে।

Advertisement

চালের এমন দাম বাড়ার কারণ হিসেবে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, চালের ব্যাপারে সরকার দূরদর্শিতার অভাব দেখিয়েছে। কারণ জুন মাসেই সরকারের নিজস্ব স্টক (মজুত) অনেক বড়মাত্রায় কমে যায়। এরপর বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পরও সরকার নিজে থেকে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। এর সঙ্গে সম্প্রতি রোহিঙ্গারা আসায় চালের চাহিদা আরও বেড়ে গেছে। ফলে চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে গ্যাপ সৃষ্টি হওয়ায় দাম বেড়েছে।

চালের দাম কমানোর পদক্ষেপ হিসেবে মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, এখন যেসব আমদানির চুক্তি হয়েছে, সেগুলো যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ডেলিভারি (সরবরাহ) নিতে হবে। সেই সঙ্গে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। তাদের বুঝিয়ে সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে চালের দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখতে হবে। পাশাপাশি ভারতের সঙ্গেও আলোচনা করতে হবে। কারণ বাংলাদেশ আমদানি শুল্ক কমানোর কারণে ভারতের রফতানিকারকরা তাদের রফতানিমূল্য বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে আমদানি শুল্ক কমানোর খুব একটা সুফল আমরা পাচ্ছি না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান বলেন, সরকারকে এখন চাল আমদানি করে বাজার একেবারে ভরে দিতে হবে, তাহলেই কাজ হবে। আমি মনে করি- ধরো, মারো এ ধরনের নীতি না নিয়ে, মার্কেট ইকোনমিকে কাজ করতে দিতে হবে। সরকার যদি বেশি বেশি চাল আমদানি করতে দেয়, তাহলে বাজারে একটি সংকেত পৌঁছাবে এবং দাম কমবে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডসহ (এনবিআর) সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে বলে দিতে হবে আমদানিতে যাতে কোনো সমস্যা না হয়। সেই সঙ্গে ওএমএস (খোলাবাজারে চাল বিক্রি কর্যক্রম) চালু রাখতে হবে। আর সম্ভব হলে ওএমএস’র দামটা আর একটু কমাতে হবে। আমার কাছে ৩০ টাকা একটু বেশি মনে হয়- বলেন আতিউর রহমান।

Advertisement

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, সঠিক সময়ে সরকারের মজুত না বাড়ানো, আমন-বোরো ধান সংগ্রহের লক্ষ্য পূরণ না হওয়া এবং সময়মতো আমদানির পদক্ষেপ না নেয়ার কারণে চালের মূল্য বেড়ে গেছে।

তিনি বলেন, যারা স্বল্প আয়ের এবং যাদের মোট খরচের প্রায় ৭০ শতাংশই চলে যায় চালের পেছনে, তাদের ক্রয়ক্ষমতার ওপর চালের মূল্যবৃদ্ধি নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। তাদের খাদ্যনিরাপত্তার ক্ষেত্রে অসুবিধা হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে চালের দাম সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনতে আমদানি আরও বেশি করতে হবে এবং জি টু জি’র (সরকার থেকে সরকার) বাইরে গিয়ে বেসরকারি খাতের মাধ্যমে আমদানি করতে হবে। সেই সঙ্গে খোলাবাজারে চাল বিক্রি আরও সম্প্রসারিত করতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, সরকারকে চাল আমদানি এবং মজুত বাড়াতে হবে। সেই সঙ্গে বড় পরিসরে খোলাবাজারে চাল বিক্রি করতে হবে। তাহলে দাম নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। তবে খোলাবাজারে চাল বিক্রি শুধু ঢাকা শহরে করলেই হবে না, প্রত্যেক উপজেলা ও বড় বড় বাজারে করতে হবে। এতে মজুতদাররা বেশিদিন চাল আটকে রাখতে পারবে না। তারা বাজারে আসতে বাধ্য হবে। মিটিং করে, ধমক দিয়ে দাম কমানো যাবে না।

এমএএস/জেডএ/এমএআর/পিআর