ভ্রমণ

পায়ে হেঁটে কলকাতা থেকে ঢাকা : চতুর্থ পর্ব

১২ ফেব্রুয়ারি। আজকের পথটা একটু বেশি। তাই ভোর রাতেই ঘুম থেকে উঠতে হলো। এখনো চারদিকে আবছা অন্ধকার রয়ে গেছে। আমি উত্তম দাকে ফোন দিলাম। তিনি জানালেন প্রায় এসে পড়েছেন। মাত্র পাঁচ মিনিটের মতো সময় লাগবে। উৎপল রায়কে ফোন দিলাম। তিনি আমাকে যশোর রোডে নিয়ে এলেন। আশেপাশে কোন মানুষ নেই। দোকানগুলোও সব বন্ধ। একটা কুকুর বন্ধ দোকানের সামনে পৃথিবীর সেরা ঘুম ঘুমাচ্ছে। কিছু সময়ের মধ্যেই উত্তম দা চলে এলেন।

Advertisement

আমি আর উত্তম দা পা বাড়ালাম শান্ত কালো পিচঢালা পথে। দু’জনে পরিচিত হতে বেশি সময় লাগলো না। উত্তম দাকে পরিচয় করিয়ে শুরু করি। তিনি খুবই সাধারণ একজন মানুষ। তিনি জাতীয় দাবাড়ু। দু’দিন আগেই তিনি যুক্তরাজ্য থেকে দেশে ফিরেছেন। সেখানে একটি দাবা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছিলেন। বয়স প্রায় পঞ্চাশের কাছাকাছি। এখনো বিয়ে করেননি। তিনি বেশ কয়েকবার বাংলাদেশেও এসেছেন দাবা খেলতে।

আস্তে আস্তে সূর্য তার পূর্ণ তেজ নিয়েই উপস্থিতি জানান দিলো। এখনো আমাদের সাথে কোন গাড়ি যোগ দেয়নি। এর কারণ আমরা খুব ভোরে হাঁটা শুরু করেছি। রাস্তার পাশের একটি খাবারের দোকানে ঢুকলাম। সেখানে সকালের নাস্তা করতে করতে উত্তম দা জানালেন, তিনি আজ আমার সাথে পুরো রাস্তাই হাঁটবেন। তিনি বলেন, ‘প্রথমে ভেবেছিলাম এটা কেমন পাগলামি? কলকাতা থেকে হেঁটে ঢাকা যাবে। কমলেশ দা বলেছে তাই এলাম। তারা যখন আসবে তখন আমি বাড়ি ফিরে যাবো। আর এখন, এই কিছু সময় হেঁটে, তোমার সাথে কথা বলে এবং তোমার হাঁটার উদ্দেশ্য জেনে খুব ভালো লাগছে। আজ আমি পুরো পথই তোমার সাথে হাঁটবো।’ খাবারের বিলটা তিনিই দিলেন। যদিও কমলেশ সেন খাবারের টাকা দিয়েছেন।

আরও পড়ুন- ঢাকার কাছেই মোহাম্মদী গার্ডেন

Advertisement

আমরা গল্পে মেতে উঠলাম। তবে তা হাঁটার মধ্যেই। তিনি নায়ক উত্তম কুমারের কঠিন ভক্ত। আমাকে উত্তম কুমারের বেশকয়েকটি ছবির গল্প শুনালেন। আজকের সকালটা সত্যিই আলাদা মনে হচ্ছে। তার কারণ অবশ্যই উত্তম দা। তার গানের গলাও বেশ ভালো। মান্নাদে’র গান গেয়ে আমার ক্লান্তি বুঝতে দেননি। আমি শুধু মনে মনে ভাবছি, এত ভালো, মজার এবং গুণী একজন মানুষ আমার সাথে হাঁটছে। যত সময় যাচ্ছে তার বন্ধুসুলভ আচরণ আমাকে মুগ্ধ করে চলছে।

তার ব্যক্তিগত একটি কথা শেয়ার করি। যেহেতু কথাটি গোপন রাখার কোন দায় নেই। কলেজ জীবনে তিনি একটি মেয়েকে পছন্দ করতেন। মেয়েটি তার সাথেই পড়তো। একসময় মেয়েটি তার সাথে সম্পর্ক তৈরি করে। ভালোই চলছিলো তাদের প্রেমময় দিনগুলো। হঠাৎ একদিন সড়ক দুর্ঘটনায় মেয়েটি পা দু’টো হারান। তারপরও তিনি মেয়েটিকে বিয়ে করতে চান। কিন্তু মেয়েটি সম্পর্ক ভেঙে ফেলেন। বিয়ে করবেন না বলেও জানান। সেই মেয়েটি তার বোঝা হতে চাননি। তাকে নতুন করে কারো সাথে জীবন শুরু করতে বলেন। কিন্ত উত্তমের ভালোবাসা কম ছিলো না। তাই তিনিও বলে দিয়েছিলেন, যদি কাউকে বিয়ে করে তবে তাকেই করবে। তাই আজও তিনি বিয়ে করেননি। এখনো সেই মেয়েটির সাথে সবসময়ই যোগাযোগ হয়। ‘এখন যদি সে আপনাকে বিয়ে করে?’ এমন প্রশ্নে সহজভাবেই বললেন, ‘হ্যাঁ, বিয়ে করবো।’

কমলেশ সেনসহ আট-দশজন কলকাতা থেকে চলে এলো। কালাসিমা বাজারে আমরা বিশ্রাম করছি। কমলেশ সেনের স্ত্রী আমার জন্য খাবার পাঠিয়েছেন। আজ পায়ের অবস্থা খুবই খারাপ। তবে কাউকে বুঝতে দিচ্ছি না। খাবার খেয়ে গাড়ির সিটের উপর শরীরটা ছেড়ে দিয়ে শুয়ে পড়লাম। এরপর হঠাৎ আমি লাফ দিয়ে উঠে বসলাম। কারণ দু’জন আমার পা ম্যাসেজ করছে। আমি কি বলবো বুঝতে পারছি না। তাদের নিষেধ করতেই বললেন, ‘তুমি আরেকটু বিশ্রাম করো।’

আরও পড়ুন- সাইকেলে চড়ে চন্দনের হিমালয় জয়

Advertisement

আবার হাঁটা শুরু করলাম। এখন দলটি বড় হয়েছে। আজ পুলিশও দু’জন বেশি। সবাই একত্রে হাঁটছি। আজও আমার ক্যামেরা ছুটি কাটাচ্ছে। মানে আজও ক্যামেরা অন হচ্ছে না। তাই তেমন ছবিও তোলা হলো না। গাইঘাটা বাজারে এসে দেখি উৎপল রায় ও তার স্ত্রী আমাদের জন্য দাঁড়িয়ে আছেন। গাড়িতে করে তারা এসেছেন। খুব ভোরে চলে এসেছি বলে উৎপলের স্ত্রীর সাথে দেখা করে আসতে পারিনি। তাই এতদূর এসেছেন আমার সাথে আর একবার দেখা করতে। ডাবের পানি আর নাড়ু নিয়ে এসেছেন। ডাবের পানি আর নাড়ু খেয়ে আবার হাঁটা শুরু।

সামনে ব্যানার ঝোলানো মাইক্রোবাস চলছে ধীরে ধীরে। একদল মানুষ বুকের বামপাশে ব্যাচ ঝুলিয়ে হাঁটছে। সেই মানুষগুলো একটি ছোট্ট ছেলেকে অনুসরণ করছে। পেছনে পুলিশের গাড়ি। এসব দেখে রাস্তার পাশের মানুষ, বাজারের মানুষ সবাই কৌতূহল নিয়ে দেখছে। কেউ কেউ এগিয়ে এসে জিজ্ঞেসও করছে। পেছন থেকে সাইরেন বাজিয়ে অনেকগুলো গাড়ি আসছে দেখে আমরা রাস্তার পাশে দাঁড়ালাম। কয়েকটি পুলিশের গাড়ি, প্রাইভেট গাড়ি। আমাদের দেখে গাড়িগুলো থামলো। কমলেশ সেন আমাকে একটি গাড়ির কাছে নিয়ে গেলেন। কাছে গিয়ে দেখি গাড়ির ভেতরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যনার্জি। আমার চোখ তো কপালে। গাড়ির গ্লাস নামিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার নাম যেন কী?’ আমি বললাম, ‘ইকরামুল হাসান শাকিল, ম্যাম।’ তিনি বললেন, ‘এএনআই’র নিউজে দেখেছি তোমাকে। বাহ্! কী সাহস তোমার! ভালো থেকো।’ বলে চলে গেলেন। আমার আনন্দ আর কে দেখে। মমতা ব্যানার্জিকে দেখলাম। তিনি আমার সাথে কথা বললেন। তা-ও আবার রাস্তায় গাড়িবহর দাঁড় করিয়ে। তিনি বনগাঁর কোন এক দলের সমাবেশে যোগ দিতেই যাচ্ছিলেন। আজকের দিনটা আমার জন্য স্মরণীয় একটি দিন।

রাস্তার পাশে বেশ কয়েকজন নারী, পুরুষ ও ছেলে-মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তারা এক কলেজের অধ্যাপকের পরিবারের লোকজন। তারা টিভির সংবাদের মাধ্যমেই আমার সম্পর্কে জানতে পারে। তাই রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে আমাকে দেখবে বলে। শুধু তাই নয়। দুপুরের খাবার রান্না করে টিফিন ক্যারিয়ারে করে নিয়েও এসেছেন। আমরা সবাই তো অবাক! গাড়িতে বসে আমি সেই খাবার খেয়ে নিলাম। এর মাঝখানেই অনেক কথা হলো। জানতে পারলাম, তাদের আত্মীয়-স্বজন সব বাংলাদেশে। তারা সবাই গল্প করতে করতে আমার সাথে এক কিলোমিটারের মতো রাস্তা হাঁটলেন। ছোট বাচ্চারাও। এই আনন্দ আর কোনদিন পাবো কি না জানি না। তবে যে ভালোবাসা পেলাম তাদের কাছ থেকে, তা আমাকে সারা জীবন ঋণী করে রাখবে।

আমরা বনগাঁতে চলে এলাম। এখানে একটু চা পানের বিরতি দেওয়া হলো। বনগাঁ বাজারে একটা শহীদ মিনার আছে। দেখতে হুবহু ঢাকার শহীদ মিনারের মতো। সামনে একুশে ফেব্রুয়ারি বলে রং করা হচ্ছে। সেখানে আমরা একটু দাঁড়িয়ে ছবি তুললাম। এদিকে আমাদের পেট্রাপোল পৌঁছতে দেরি হয়ে যাচ্ছে। ভয়ে ছিলাম ৫টার পর কি আবার ইমিগ্রেশন বন্ধ হয়ে যায় কি না। তাই পুলিশ ইন্সপেক্টর আমাদের আগে চলে গেলেন। যাতে আমার ইমিগ্রেশনে কোন সমস্যা না হয়।

আরও পড়ুন- ভয়ংকর কে-২ : বিশ্বাসঘাতকতার এই দিনে

বিকেল ৫টা ৩০ মিনিটের সময় আমরা পেট্রাপোল পৌঁছলাম। আমাকে সোজা ইমিগ্রেশন অফিসার বিদাত্মা দত্ত’র রুমে নিয়ে গেলেন। সেখানে তিনি আমাকে স্বাগত জানালেন। একজন পুলিশ এসে আমার পাসপোর্ট নিয়ে গেলেন। আমরা সেখানে বসে চা খেলাম। ইমিগ্রেশন সাময়িক বন্ধ করে দিলেন। তিনি সব অফিসারকে ডেকে আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন এবং ছবি তুললেন। তারপর তিনিসহ আমরা সবাই নো-ম্যানস ল্যান্ডে এলাম। যশোর প্রেস ক্লাবের পক্ষ থেকে আমাকে সংবর্ধনা জানান বেনাপোল প্রেস ক্লাবের সভাপতি মহসিন মিলন, বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী সমিতির নেতা সাজেদুর রহমানসহ অনেকে। আনুষ্ঠানিকতা শেষে বিদায় নিয়ে আমরা বাংলাদেশে চলে এলাম। বেনাপোল ইমিগ্রেশন অফিসারের সাথে সাক্ষাৎ শেষে চলে আসি বেনাপোল প্রেস ক্লাবে। সাংবাদিকদের সাথে সাক্ষাৎ শেষে হোটেলে চলে আসি। এখানে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করেছেন মহসিন মিলন।

রেস্টুরেন্ট থেকে রাতের খাবার খেয়ে হোটেলের রুমে চলে এলাম। অনেক লম্বা পথ হেঁটেছি। শরীরটাও ক্লান্ত লাগছে। পায়ের অবস্থাও খুব খারাপ। শরীরে কিছুটা জ্বর আছে। আজ ফোনে বাবা-মায়ের সাথে কথা হলো। তারা খুবই চিন্তিত। সেলিম ভাইয়ের সাথে কথা হলো। ভেবেছি অপ্রয়োজনীয় কিছু জিনিস রেখে যাবো। রুকস্যাক অনেক ভারি। তাই আলাদা একটি পলিব্যাগে অপ্রয়োজনীয় জিনিস ও পোশাক প্যাক করলাম। এগুলো প্রেস ক্লাবে রেখে যাবো, পরে কুরিয়ার করে ঢাকা পাঠিয়ে দেবে। দু’চোখ ভেঙে ঘুম আসছে।

এসইউ/জেআইএম