পাহাড়, নদী, জলাভূমি, ধানক্ষেত পেরিয়ে হাজার হাজার রোহিঙ্গা ছুটছেন বাংলাদেশের দিকে। তাদের বিরুদ্ধে মিয়ানমারের রাখাইনে দেশটির সেনাবাহিনী যুদ্ধ ঘোষণা করছে বলে মন্তব্য করছেন রোহিঙ্গারা। সেখান থেকে দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে পালিয়ে এসে বাংলাদেশে প্রবেশের সুযোগ খুঁজছেন তারা।
Advertisement
জাতিসংঘ বলছে, মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলের রাখাইন রাজ্যের রাষ্ট্রহীন মুসলিম সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের ৫০ হাজার মানুষ সহিংসতা থেকে পালিয়েছেন।
এই শরণার্থীরা মার্কিন প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম সিএনএনকে বলেছেন, মিয়ানমার সেনাবাহিনী তাদের ওপর আক্রমণ চালাচ্ছে। তবে সহিংসতার জন্য মিয়ানমার সরকার সন্ত্রাসীদের দোষারোপ করছে। গত শুক্রবার থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে অন্তত ২৭ হাজার রোহিঙ্গা। পূর্ব এশিয়ার এই দুই দেশের শূন্য রেখায় অবস্থান করছে অারো প্রায় ২০ হাজার রোহিঙ্গা।
বৃহস্পতিবার দুই দেশকে বিভক্তকারী নাফ নদ থেকে ২০ রোহিঙ্গার মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। নিহতদের মধ্যে ১২ শিশু রয়েছে।
Advertisement
‘মারধর, গুলি, কুপিয়ে হত্যা’
বাংলাদেশের জনাকীর্ন শরণার্থী ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীরা রাখাইনের ভয়াবহ নিপীড়নের চিত্র তুলে ধরেছেন। হামিদা বেগম নামে এক রোহিঙ্গা শরণার্থী সিএনএনকে বলেন, ‘তারা আমাদেরকে মারধর করেছে, গুলি করছে এবং আমাদের লোকজনকে কুপিয়ে হত্যা করছে।’ রাখাইনে সবকিছু ছেড়ে জীবন নিয়ে পালিয়ে এসেছেন এই রোহিঙ্গা নারী।
তিনি বলেন, ‘অনেক মানুষ খুন হয়েছেন। অনেক নারীকে ধর্ষণ ও হত্যা করা হয়েছে। আমার স্বামী একজন দিনমজুর। আমরা দিনে মাত্র দুই বেলা খাবার খেয়ে দিন পার করতাম। কিন্ত যুদ্ধ শুরুর পর আমরা সবকিছু হারিয়েছি।’
গত শুক্রবার রাখাইন সীমান্তের তল্লাশি চৌকিতে একযোগে রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের হামলায় নিরাপত্তাবাহিনীর ১২ সদস্য নিহত হয়। এরপর রাখাইনে যে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছে সেই কথা স্মরণ করে হামিদা বেগম এসব কথা বলেন। রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের হামলার জবাবে দেশটির সেনাবাহিনী ‘ক্লিয়ারেন্স অপারেশন’ জোরদার করেছে। এতে হাজার হাজার রোহিঙ্গা গৃহহীন হয়ে পড়েছেন।
Advertisement
মিয়ানমারের সরকারি কর্মকর্তারা বলছেন, গত শুক্রবার থেকে শুরু হওয়া লড়াইয়ে এখন পর্যন্ত ৩৯৯ জন নিহত হয়েছে। এদের মধ্যে ৩৭০ জন ‘সন্ত্রাসী’। তবে মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, মিয়ানমার সেনাবাহিনী নারী, শিশু ও নিষ্পাপ মানুষকে হত্যা করছে।
বাড়ি-ঘর পুড়িয়ে দেয়ার জন্য পরষ্পরকে দোষারোপ করছে উভয় পক্ষ। দেশটির সরকার বলছে, রোহিঙ্গা বিদ্রোহীরা দুই হাজার তিনশ’র বেশি বাড়ি-ঘরে আগুন দিয়েছে। এদিকে রোহিঙ্গারা বলছেন, সেনাবাহিনী তাদের বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দিচ্ছে।
হামিদা বেগম অভিযোগ করে বলেন, ‘সেনাবাহিনী ও তাদের সহযোগীরা তার পরিবারের ওপর নির্যাতন চালিয়েছে। মুক্তিপণ দিতে ব্যর্থ হওয়ায় অন্যান্যদের হত্যা করছে সেনাবাহিনী।’
‘জীবন বাঁচাতে আমরা পালিয়ে এসেছি। তারা আমাদেরকে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে দিচ্ছে না। আমরা সবকিছু থেকে বঞ্চিত...তারা লোকজনকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে এবং মুক্তিপণ চাচ্ছে। এদের অনেককেই গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয়েছে।’
হামিদা বেগমের মতো রোহিঙ্গাদের এসব দাবির সত্যতা নিশ্চিত করতে পারেনি সিএনএন। এ ব্যাপারে মন্তব্যের জন্য সিএনএন’র পক্ষ থেকে মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও সাড়া পাওয়া যায়নি। রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমার সরকারের নিন্দা করছে বিভিন্ন দাতব্য সংস্থা ও জাতিসংঘ।
কয়েক দশক ধরে কৌশলগত মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হচ্ছে রাখাইনে। গত বছরের অক্টোবরে একই ধরনের একটি হামলার পর নিরাপত্তাবাহিনী রোহিঙ্গাবিরোধী কঠোর অভিযান শুরু করে। সহিংসতা চরমপন্থার দিকে ঠেলে দিচ্ছে রোহিঙ্গাদেরকে। ‘শেষ পর্যন্ত সবাই হেরে যাচ্ছে’- বলে মন্তব্য করেন জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাই কমিশনের হাই কমিশনার জেইদ রা’দ আল হুসেইন।
‘ঘৃণা শুধু রোহিঙ্গায়’
রাখাইন থেকে পালিয়ে আসা মোহাম্মদ হারুন বলেন, ‘মিয়ানমারে আরো অনেক জাতি গোষ্ঠী আছে, কিন্তু দেশটির সরকার একমাত্র রোহিঙ্গাদেরকে ঘৃণার চোখে দেখে।’ মিয়ানমারে রোহিঙ্গারা সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের। কয়েক প্রজন্ম থেকে দেশটিতে বসবাস করে এলেও তাদের নাগরিকত্ব নেই।
সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদেরকে ঘর থেকে বের হতে নিষেধ করছে বলে অপর এক রোহিঙ্গা বলেন। নবিন সুনা নামের ওই রোহিঙ্গা বলেন, ‘আমরা যদি ঘরে অবস্থান করি, তাহলে তারা আগুন ধরিয়ে দেয়, গুলি চালায় অথবা গলাকেটে হত্যা করে। মুসলমানদের কোনো অধিকার নেই।’
‘প্রতিকূল প্রতিক্রিয়া’
একই ধরনের সহিংসতার পর গত বছর বাংলাদেশে ৮৫ হাজার রোহিঙ্গা প্রবেশ করে। গণহত্যা প্রতিরোধে কাজ করছে আন্তর্জাতিক সংস্থা নেক্সাস ফান্ড। আন্তর্জাতিক এই সংস্থার নির্বাহী পরিচালক শ্যালি স্মিথ সিএনএনকে বলেন, কয়েক দশক ধরে এই মানুষদের ওপর নিপীড়ন চলে আসছে। গত কয়েক দিনে যা ঘটছে তা গত অক্টোবরের ঘটনার মতই। ওই সময় রোহিঙ্গাদের ক্ষুদ্রতম একটি অংশ ছোট পরিসরে হামলা চালিয়েছিল।
হামলার ফলে মিয়ানমার সেনাবাহিনী বেসামরিক হত্যা, ধর্ষণের মাধ্যমে কঠোর জবাব দিয়েছে। এমনকি মেশিন গানের গোলা থেকে রেহাই পায়নি নিষ্পাপ মানুষও। বাংলাদেশের দিকে পলায়নরত নারী, শিশু ও নির্দোষ মানুষকে গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয়েছে।
শ্যালি স্মিথ বলেন, ‘তারা গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিচ্ছে...বেসামরিক নাগরিকদের ওপর এই হামলা ঠিক নয়।’ তিনি বলেন, হামলার নিন্দা জানাতে মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চির অস্বীকৃতি হতাশাজনক। তিনি একজন শান্তিতে নোবেলজয়ী। সেখানে যা ঘটছে তা দেখে মনে হচ্ছে, তিনি শুধুমাত্র বৌদ্ধদের শান্তির প্রতি খেয়াল রাখেন, কিন্তু রোহিঙ্গাদের নয়।
কক্সবাজারের কুতুপালং আশ্রয় শিবিরে রাবেয়া খাতুন নামে এক রোহিঙ্গা নারী বলেন, ‘আট দিন আগে বাড়ি ছেড়েছিলাম। এখানে পৌঁছেছি আজ।’ এখন তারা সেনাবাহিনীর নিপীড়ন থেকে মুক্ত। কিন্তু বেঁচে আছেন বিপজ্জনক অবস্থায়।
শরণার্থী মোহাম্মদ হারুন বলেন, ‘আমাদের কোনো খাবার নেই, কাপড় নেই। আমরা গৃহহীন হয়ে পড়েছি। মিয়ানমার সেনাবাহিনী বাড়ি-ঘর গুড়িয়ে দিয়েছে। খাদ্যদ্রব্য ধ্বংস করেছে। রাখাইনের এই রোহিঙ্গা বলেন, ‘তিনি আর সেখানে ফিরে যাবেন না।’
‘সেনাবাহিনী সবকিছু ধ্বংস করেছে। এখন আমাদেরকোনো খাবার নেই, নেই কম্বলও।
‘গণহত্যা চলছে’
অনেক রোহিঙ্গা শুধুমাত্র পরনের কাপড়েই বাড়ি-ঘর ছেড়ে পালিয়েছেন। তাদের কথায় উঠে আসছে, রাখাইনে খুন, ধর্ষণ ও জ্বালাও-পোড়াও।
রোহিঙ্গা নারী রমিজা বেগম বলেন, ‘আমি কোনো কিছুই সঙ্গে করে আনতে পারিনি। মাথায় পরা স্কার্ফের ফাঁক দিয়ে রমিজা বেগমের পাকা চুল বেরিয়ে আসছে। এই স্কার্ফটিও তাকে দিয়েছে একটি দাতব্য সংস্থা।
‘এখানে কেউ একজন এই পোষাকটি দিয়েছেন। আমি কাপড় চেয়েছিলাম। সবকিছু হারিয়েছি। বার্মায় আমার বাড়িতে আর কোনো কিছুই অবশিষ্ট নেই। সবকিছুই ধ্বংস করা হয়েছে।’ (সংক্ষেপিত)
এসআইএস/পিআর