শুধু সাইকেলে চড়ে হিমালয় জয় করেছেন ভারতের হৃদয়পুরের অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমী চন্দন বিশ্বাস। ১৫৩ দিনে ৪টি দেশের ৬ হাজার ২৪৯ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে তিনি ঘরে ফিরেছেন। গত ২২ জুলাই দিল্লি থেকে দমদম বিমানবন্দরে পৌঁছান তিনি। পাঁচ মাস পাহাড় আর প্রকৃতির বুকে একা একা ঘোরার পরে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন চন্দন। সাইকেলে ‘ট্রান্স হিমালয়ান ট্রেল’ সম্পন্ন করার স্বপ্ন তার সফল হলো।
Advertisement
কলকাতা-বাংলাদেশ-ত্রিপুরা-নাগাল্যান্ড-অরুণাচলপ্রদেশ-মেঘালয়-আসাম-উত্তরবঙ্গ-ভুটান-সিকিম-নেপাল-উত্তরখণ্ড-হিমাচলপ্রদেশ-লাদাখ ঘুরে তিনি বাড়ি ফেরেন। এটাকে ‘ট্রান্স-হিমালয়ান ট্রেল’ বলে। যার অর্থ হিমালয়কে আড়াআড়ি পেরোনো।
গত বছর থেকে শুরু হয় চন্দনের রিসার্চওয়ার্ক। অজস্র মানচিত্র, বই, ন্যাটমো, সার্ভে অব ইন্ডিয়া, নেপাল এবং ভুটান দূতাবাসে দৌড়াদৌড়ি করতে করতেই এক বছর চলে যায়। অবশেষে ২০১৭ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি সাইকেলসহ প্রায় ৫০ কিলোগ্রাম মালামাল নিয়ে বেরিয়ে পড়েন।
বাড়ি থেকে বেরিয়ে প্রথমদিনই ঢুকে পড়েন বাংলাদেশের যশোরে। সেখান থেকে বরিশাল। বরিশাল থেকে সারা রাত লঞ্চে করে ঢাকা। গত ২১ ফেব্রুয়ারি ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে’ ঢাকা পৌঁছে শহিদবেদিতে পুষ্পমাল্য অর্পণ করেন। দশ দিন বাংলাদেশে কাটিয়ে আখাউড়া সীমান্ত দিয়ে ত্রিপুরা পৌঁছান। এরপর ত্রিপুরা, নাগাল্যান্ড, আসাম পেরিয়ে পৌঁছান অরুণাচলের পসিঘাট।
Advertisement
যাত্রার সময় তিনি সাধারণত সকাল থেকে দুপুর ২ টা পর্যন্ত সাইকেল চালাতেন। তারপর নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছে সেখানকার প্রশাসনিক দফতর বা থানায় গিয়ে যোগাযোগ করতেন। কাগজপত্র দেখানোর পরে তারাই রাতে থাকার ব্যবস্থা করতে সাহায্য করতেন। তবে পসিঘাট থেকে সেশনে পৌঁছে থাকার তেমন ব্যবস্থা না হওয়ায় প্রথমবারের মতো জঙ্গলে তাঁবু খাটিয়ে থাকতে হয়।
সেখান থেকে ধীরে ধীরে পৌঁছলেন অরুণাচলের আলং। এরমধ্যে গহপুরে এক তথাকথিত ভূত বাংলোয় থাকতে হল! যদিও তেমন কিছু হল না। অবশেষে তেজপুর গুয়াহাটি হয়ে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে পৌঁছলেন উত্তরবঙ্গের আলিপুরদুয়ার। কিছুদিনের বিশ্রাম নিয়ে জয়গাঁও হয়ে ভুটান ঢুকলেন। তবে ভুটানে সাইকেল নিয়ে ঢোকার কোনও অনুমতি নেই। ফলে ফুন্টসলিংয়ে একটা রাত কাটিয়ে ভুটানের বদলে সিকিম ঘুরে চলে গেলেন শিলিগুড়ি। সেখানে ‘ফুড পয়জনিং’য়ের কারণে বসে থাকতে হল ১৫ দিন।
সুস্থ হয়ে পানিট্যাংকি কাকরভিটা বর্ডার দিয়ে সোজা নেপাল। ইস্ট-ওয়েস্ট হাইওয়ে। প্রায় ৪০ ডিগ্রির কাছাকাছি গরম। ওই সময় গরম থেকে বেরিয়ে তাড়াতাড়ি পাহাড়ে ওঠার জন্য দিনে ১০০ কিলোমিটারের বেশি সাইকেল চালান।
নেপালে গিয়ে জীবনের প্রথম শ্মশানের মন্দিরে থাকলেন। বেলবাড়ি, কল্যাণপুর, বর্দিবাস— এসব তরাই অঞ্চল পেরিয়ে ধীরে ধীরে পাহাড়ের দিকে উঠলেন। সিন্ধুলী, মঙ্গলতার, ধূলিখেল হয়ে পৌঁছলেন কাঠমাণ্ডু। এখানে জিনিসপত্রের দাম খুব চড়া। কাঠমাণ্ডু থেকে পরবর্তী গন্তব্য পোখরা। সেই চড়াই-উতরাইয়ে নির্দিষ্ট সময়ের আরও দু-তিনদিন বেশি সময় লেগে গেল পোখরা পৌঁছতে। আরো পড়ুন- অন্নপূর্ণায় সূর্যোদয়
Advertisement
পোখরা থেকে নেমে চলে যান বুটওয়াল লুম্বিনি। মাঝে ‘তানসেন’। গরম এবার ৪৫ ডিগ্রি ছাড়িয়েছে। তার মধ্যেই এগিয়ে যান উত্তরখণ্ডের দিকে। মহেন্দ্রনগর চেকপোস্ট পেরিয়ে ভারতে ঢোকেন। হরিদ্বারের দিকে প্রথম থাকার সমস্যায় পড়লেন। কোনও ধর্মশালা বা হোটেল একা কাউকে থাকতে দিতে রাজি নয়। অবশেষে পুলিশের হস্তক্ষেপে ভারত সেবাশ্রম সংঘ প্রথমে নিমরাজি হয়েও পরে থাকতে দিয়েছে। এরপর দেরাদুন। দুন ইউনিভার্সিটির ফ্যাকাল্টি গেস্ট হাউজে ছিলেন।
সেখান থেকে শিমলা পৌঁছে একদিন সকালবেলা ডর্মিটরির ছাদে বসে মায়ের সঙ্গে ফোনে কথা বলার সময় হঠাৎ দেখেন এক ভদ্রলোক তার সাইকেল ধরে টানাটানি করছেন। পরে জানলেন ‘মা মুঝে টেগোর বনা দে’ নাটকের লাকিজি গুপ্ত তিনি। অভিযানের মধ্যেই ওই কয়েকদিন পারফরম্যান্স এবং থিয়েটার নিয়ে জ্ঞানগর্ভ আলোচনা হয় তাদের।
শিমলার পর কোর হিমালয়ান রিজিয়ন শুরু। শুরু হলো সবচেয়ে বিপদসঙ্কুল অংশ স্পিতি ভ্যালি এবং লাদাখ ভ্যালি। কাজা থেকে বাতাল হয়ে কোকসার পর্যন্ত ১৫টির বেশি ঝোরা বা নালা পেরিয়েছেন। রাস্তা দিয়েই নদী বইছে। শেষ মুহূর্তে একবার ধসের মুখেও পড়েছিলেন।
গত ১৮ জুলাই লাদাখের নুব্রা ভ্যালির হুন্ডার পৌঁছান। গত কয়েকমাসে এক নাগাড়ে ১০ হাজার ফুটের উপরে থেকেছেন। পেরোতে হয়েছে কুনজুম, বাড়ালাচা, ট্যাংলাং, খারদুঙের মতো একাধিক হাই অল্টিচিউড বিপজ্জনক পাস। প্রায় শূন্য ডিগ্রির কাছে তাপমাত্রা ছিল কোনও কোনও জায়গায়।
পুরো অভিযানে মাত্র দু’বার গাড়ির মাথায় সাইকেল চাপাতে হয়েছে। দু’বার দুর্ঘটনা আর কোকসারের কাছে একবার ধসের মুখেও পড়েছেন। পেরিয়েছেন গঙ্গা, যমুনা এবং ব্রহ্মপুত্রসহ ছোট-বড় ১শ’টারও বেশি নদী। এসব প্রতিকূলতা সত্ত্বেও ১৫৩ দিনে সাইকেলে অতিক্রম করেছেন ৬ হাজার ২৪৯ কিলোমিটার রাস্তা।
এসইউ/আরআইপি