সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানো হবে বলে অর্থমন্ত্রী বার বার আশ্বাস দিলেও আপাতত তা বাস্তবায়নে যাচ্ছে না সরকার। তবে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের সীমা বেঁধে দেওয়ার পাশাপাশি বিনিয়োগ করতে হলে সরকারকে অর্থের উৎস জানাতে হবে। এছাড়া বিনিয়োগে দুই স্তরবিশিষ্ট সুদ চালুর পরিকল্পনাও করা হচ্ছে।
Advertisement
সঞ্চয়পত্রের সুদের হার না কমানোসহ এ খাতে বিনিয়োগের ব্যাপারে একটি গাইড লাইন চূড়ান্ত করতে আগামীকাল বৈঠকে বসছে সঞ্চয়পত্র সুদ সমন্বয় কমিটি। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানায়, চলতি অর্থবছরের বাজেট বড় ধরনের ঘাটতির মুখে পড়বে। বিশেষ করে নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন না হওয়ায় কমপক্ষে ২০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব ঘাটতি দেখা দেবে। এই ঘাটতি মেটাতেও সঞ্চয়পত্র বড় ভূমিকা রাখছে।
এসব দিক বিবেচনা করে সঞ্চয়পত্রের সুদের হার না কমানোর পক্ষে অর্থ মন্ত্রণালয়। তবে শুধু অর্থ সংকটের বিষয়টি সরকার ভাবছে না। সরকারের ভাবনায় রয়েছে আগামী নির্বাচনে এর প্রভাব। কারণ সঞ্চয়পত্রের সুদের হার এ মুহূর্তে কমানো হলে অনেক মধ্যবিত্ত-নিম্ন মধ্যবিত্ত ও পেনশনভোগীরা অসন্তুষ্ট হতে পারে। তাই আপাতত সঞ্চয়পত্রের সুদের হারে হাত দিতে চায় না সরকার।
Advertisement
এদিকে, সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানো হবে কিনা এ বিষয়ে অর্থ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব নাজমুস সাকিবকে দিয়ে সরকার একটি কমিটি গঠন করে। কমিটি চুলচেরা বিশ্লেষণ করে ইতোমধ্যে অর্থ বিভাগের সিনিয়র সচিবের কাছে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে।
ওই প্রতিবেদনে কিছু সুপারিশ করা হয়েছে। এগুলোর অন্যতম হচ্ছে, সঞ্চয়পত্রের নীতিমালায় পরিবর্তন আনা। কারণ বর্তমানে নিম্ন-মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও পেনশনভোগী ছাড়াও অন্যান্য অনেক প্রতিষ্ঠান সঞ্চয়পত্র কিনে রেখেছে। এমনকি, কোনো কোনো সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক বিপুল পরিমাণ অংকের সঞ্চয়পত্র কিনে রেখেছে। এ অবস্থায় সবার জন্য সুদের হার কমানো ঠিক হবে কিনা সে বিষয়টি ছেড়ে দেওয়া হয়েছে অর্থমন্ত্রীর হাতে।
বুধবার অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সভাপতিত্বে সঞ্চয়পত্রের সুদের হার ও নীতিমালা সম্পর্কিত বৈঠকে কমিটির সুপারিশ পর্যালোচনা শেষে সিদ্ধান্ত হবে বলে জানা গেছে।
এ ব্যাপারে অর্থ বিভাগের সিনিয়র সচিব হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন জানান, আপাতত সঞ্চয়পত্রের ওপর কোনো ধরনের হাত না দেওয়ার চিন্তা-ভাবনা রয়েছে। তবে অর্থমন্ত্রীর সিদ্ধান্তই হবে চূড়ান্ত। বুধবার বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে পর্যালোচনা শেষে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
Advertisement
সরকারের নীতি-নির্ধারক পর্যায়ে দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানিয়েছে, সামনের জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে সরকার এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না, যার প্রভাব পড়ে নির্বাচনে। বর্তমানে বাজেট ঘিরে অর্থ সংকটের যে আশঙ্কা করা হচ্ছে, তা সঞ্চয়পত্রের উৎস থেকেই অনেকাংশে দূর করা যেতে পারে। সঞ্চয়পত্র খাত থেকে বেশি ঋণ নেওয়ার প্রাথমিক পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। এ বিষয়টি চিন্তা করে সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানোর পরিকল্পনা থেকে সরকার সরে আসতে পারে।
জানা গেছে, আগামীকালের বৈঠকে আলাদাভাবে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের ব্যাপারে একটি গাইড লাইন দেওয়া হতে পারে। এতে সাধারণ বিনিয়োগকারী ও প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগে পৃথক সুদের হার নির্ধারণের সুপারিশ থাকছে। পাশাপাশি সঞ্চয়পত্রে কালো টাকার বিনিয়োগ প্রতিরোধ করতে আয়ের উৎস জানার বিধান থাকতে পারে।
তবে যারা ইতোমধ্যে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করেছেন, তাদের বিষয়ে নতুন করে আর কোনো নীতিমালা আরোপ না করার বিষয়টি গুরুত্ব পেতে পারে। বিশেষ করে অবসরপ্রাপ্ত চাকরিজীবী, প্রতিবন্ধী, নারী ও বয়স্কদের টাকা সঞ্চয়পত্র খাতে বিনিয়োগের বিষয়টি ইতোমধ্যে চিহ্নিত করা হয়েছে।
অন্যদিকে, সঞ্চয়পত্রে বড় বিনিয়োগকারী বিশেষ করে বিভিন্ন করপোরেট হাউস, বড় শিল্প উদ্যোক্তা, ব্যবসায়ী গ্রুপ ও শিল্পপতি, যারা অস্বাভাবিক মোটা অংকের টাকায় সঞ্চয়পত্র কিনেছে তাদের শনাক্ত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, সঞ্চয়পত্রে কালো টাকা বিনিয়োগ হচ্ছে। একে প্রতিরোধ করার জন্যই এ উদ্যোগ নেওয়া হবে। একইসঙ্গে পরিবার সঞ্চয়পত্র ও অবসরভোগীদের জন্য পেনশনার সঞ্চয়পত্রসহ অন্যান্য সঞ্চয়পত্রের সুবিধা যেন প্রকৃতজন ভোগ করতে পারে, তা নিশ্চিত করা হবে।
সূত্র আরও জানায়, ব্যাংক আমানতের চেয়ে সঞ্চয়পত্রে সুদের হার বেশি হওয়ায় বেশ কয়েক বছর ধরে এর বিক্রির পরিমাণ বেড়েছে। সদ্যসমাপ্ত ২০১৬-১৭ অর্থবছরের জুলাই থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ৫ মাসে সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে ৬০ হাজার ৫১৯ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। যা এর আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৪০ দশমিক ৩৯ ভাগ বেশি।
২০১৬-১৭ অর্থবছরের জুলাই থেকে এপ্রিল পর্যন্ত সরকার সঞ্চয়পত্র খাত থেকে ঋণ নিয়েছে ৪২ হাজার ৯৯ কোটি টাকা। আর ২০১৫-১৬ অর্থবছরের একই সময়ে ঋণ নেওয়া হয়েছিল ২৬ হাজার ৪৮৭ কোটি টাকা।
এমইউএইচ/এসআর/আইআই