রুটিন ও পরীক্ষার তারিখ ঘোষণার দাবিতে আন্দোলনে নেমে পুলিশের টিয়ারশেলের আঘাতে চোখ হারাতে বসা সিদ্দিকুরকে চোখ দান করতে চান জাহাঙ্গীর কবির নামে এক ব্যক্তি। তার বাড়ি টাঙ্গাইলে। তিনি মোহাম্মদপুরের আলহাজ্ব মকবুল হোসেন কলেজের ছাত্র।
Advertisement
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত রাজধানীর সাত সরকারি কলেজের আন্দোলনে নামা শিক্ষার্থীদের একজন সিদ্দিকুর। সরকারি তিতুমীর কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের এই শিক্ষার্থী শাহবাগে পুলিশের টেয়ারশেলে চোখে গুরুতর আঘাত পান। বর্তমানে ভারতের চেন্নাইয়ে চিকিৎসাধীন সিদ্দিকুর রহমান বাম চোখে কিছুটা আলো দেখতে পেয়েছেন। তবে এখনও তার দৃষ্টিশক্তি ফিরে আসেনি।
চেন্নাইয়ের শংকর নেত্রালয়ে তার চোখের অপারেশন হয় ৪ আগস্ট। আর ২ আগস্ট তাকে চোখ দান করার ইচ্ছাপোষণ করে ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাট দেন জাহাঙ্গীর কবির।
তার স্ট্যাটাসে তিনি প্রশ্ন রেখেছেন ‘রেটিনা প্রতিস্থাপন করলে যদি সিদ্দিকুর আলো ফিরে পায় তাহলে কেউ কি রেটিনা প্রদান করবে’ ?
Advertisement
এই প্রশ্নের উত্তর তিনিই দিয়েছেন। উত্তরে বলেছেন, ‘হ্যা আমি (চোখ) প্রদান করব, অনেক ভেবে চিন্তেই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি। পৃথিবীর সব বাস্তবতার ঊর্ধ্বে থেকেই আমি এই কাজটি করব। আমার একটি রেটিনা দান করব, তবুও সিদ্দিকুর নামক পৃথিবীটা অন্ধকারে ঢেকে না যাক, এক চোখের আলো নিয়েই বেঁচে থাকুক একটি স্বপ্নবাজ তরুণ। ভালোবাসার ভাগ পাক, ভাগ পাক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের’।
তার ফেসবুক স্ট্যাটাসটি নিচে হুবুহু দেয়া হলো-
একটি চোখ এবং রেখে যাওয়া কিছু প্রশ্ন ...
চোখ, বিবেকের আলোঘর। এটা ছাড়া পৃথিবী অন্ধকার, জীবন ঘনান্ধকার। আরও অন্ধকার মায়া-মমতা, বন্ধন ও ভালোবাসা। কখনো কি ভেবে দেখেছি, একজন অন্ধ মানুষ কতটা অসহায়! কতটা ব্যথাতুর! যার চোখ নেই, তার মর্মপীড়া কতটা যন্ত্রণাদায়ক তা কেবল তিনিই জানেন। যিনি জন্মান্ধ তার কাছে পৃথিবী সজ্ঞাহীন, অর্থহীন। তার কাছে পৃথিবীর রূপ রস-গন্ধ-সাধ, প্রেম ভালোবাসা, আত্বীয়-স্বজন, পরিবার-পরিজন, বাবা-মা ভাই-বোন, সন্তান-সন্ততি সকল কিছুই কাল্পনিক।
Advertisement
কল্পনারও একটা রঙ থাকে, একটা আকার থাকে। কল্পনা করতেও আগে বাস্তবতার সম্মুখীন হতে হয়। কিন্তু যিনি জন্মান্ধ তিনিতো কিছুই দেখেননি, তার কাছে কল্পনাটাই বা কেমন! জীবনের এই জায়গাটিতে এসে প্রত্যেকেই একটি প্রশ্নবোধক চিহ্ন রেখে যায়। একজন জন্মান্ধ ব্যক্তির জীবনে দারি, কমা, বিরাম চিহ্ন, জোতি চিহ্ন বলে কিছু নেই। তার জীবন নামক বইয়ের পৃষ্ঠাগুলো কালো রঙে ছাপা। আর অক্ষরগুলো অদৃশ্য। যেখানে হাজার চেষ্টা করেও আমরা দারি, কমা, বিরাম চিহ্ন আবিষ্কার করতে পারব না।
আমাদের চোখ আমাদের স্বপ্নের চারণভূমি। এখানে দিনরাত স্বপ্নরা ঘুরে বেরায়। ছোট থেকেই আমাদের মা-বাবা, ভাই-বোন আমাদের চোখে স্বপ্ন বুনে দেন। একদিন তা বড় হয়। সেইসঙ্গে বড় হয় আমাদের আবেগ অনুভূতি, আনন্দ-উচ্ছ্বাস। আমাদের চোখগুলোতে তখন পিতার জন্ম হয়, মাতার জন্ম হয়, ভাইয়ের জন্ম হয়, বোনের জন্ম হয়। প্রেমিকের জন্ম হয়, প্রেমিকার জন্ম হয়। জন্ম হয় সন্তান-সন্ততির। জন্ম হয় বিবেক, বোধশক্তির। যশ, খ্যাতি, আধিপত্য, লজ্জা-ঘৃণা সবই এই চোখের মধ্যে সৃষ্ট। চোখের মৃত্যু মানে বিবেকের মৃত্যু। আমরা মূলত চোখের জন্যই বেঁচে থাকি। আমাদের চোখে যা ভালো লাগে তাই করি, তার জন্যই মরিয়া হয়ে উঠি। চোখের মধ্যেই আমাদের জীবনের লক্ষ্য নিহিত। চোখের তিরোধান মানে লক্ষ্যের তিরোধান, লক্ষ্যের তিরোধান মানে ব্যক্তির তিরোধান।
আমরা এমনি এক তিরোধানের সম্মুখীন হতে চলেছি। সিদ্দিকুর নামক একটি আলোকিত পৃথিবীর তিরোধান এবং একটি সম্ভাবনাময়ী স্বপ্নের অপমৃত্যু। কাঁদানেগ্যাসে কেড়ে নেয়া দুটি চোখ এবং রেখে যাওয়া কিছু প্রশ্ন? সে প্রশ্নের উত্তরগুলো আদৌ কেউ দিতে পারবে কি না জানা নেই। তবুও একটি প্রশ্ন আর সেটি হলো ‘রেটিনা প্রতিস্থাপন করলে যদি সিদ্দিকুর আলো ফিরে পায় তাহলে কেউ কি রেটিনা প্রদান করবে’ ? হ্যা আমি প্রদান করব, অনেক ভেবে চিন্তেই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি। পৃথিবীর সব বাস্তবতার ঊর্ধ্বে থেকেই আমি এই কাজটি করব। আমার একটি রেটিনা দান করব, তবুও সিদ্দিকুর নামক পৃথিবীটা অন্ধকারে ঢেকে না যাক, এক চোখের আলো নিয়েই বেঁচে থাকুক একটি স্বপ্নবাজ তরুণ। ভালোবাসার ভাগ পাক, ভাগ পাক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের।
আলোকিত হোক দৃষ্টি, আলোকিত হোক মনআলোকিত হোক সিদ্দিকুর, আলোকিত হোক ভুবন।জাহাঙ্গীর কবির, ঢাকা।
জেডএ/জেআইএম