কয়েকদিন আগে আমার প্রাথমিক স্কুলের এক শিক্ষকের সাথে দেখা হয়েছিল। স্যার আমার কাছে জানতে চাইলেন, ব্যাংকে টাকা জমা রাখলে আবগারী শুল্কের কর্তন বাবদ আসল টাকা কমে যাবে কিনা? অর্থাৎ যে পরিমাণ টাকা তিনি জমা রাখবেন, সেটা কমে যাবে কিনা? কারণ তিনি একটি মাধ্যম থেকে জানতে পেরেছেন, সরকারি ব্যাংকে কেউ এক লাখ টাকা তিন মাস মেয়াদে জমা রাখলে, উৎস কর ও আবগারী শুল্ক কেটে নেওয়ার পর গ্রাহক ফেরত পাবে ৯৯ হাজার ৯৫৬ টাকা। স্যারের কথা শুনে বুঝলাম, আবগারী শুল্কের বিষয়টি হয়তো অনেকের কাছেই এখনও পরিস্কার নয়।
Advertisement
২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট অনুযায়ী, যেকোনো সময় ব্যাংক হিসাবে ১ লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা জমা দিলে বা তুললে পূর্বের ৫০০ টাকার পরিবর্তে ৮০০ টাকা আবগারি শুল্ক কেটে রাখা হবে। এছাড়া, ১০ লক্ষ থেকে ১ কোটি টাকা পর্যন্ত লেনদেন থাকলে ২ হাজার ৫০০ টাকা; ১ কোটি থেকে ৫ কোটি টাকা পর্যন্ত লেনদেন থাকলে ১২ হাজার টাকা এবং ৫ কোটি টাকার বেশির ক্ষেত্রে ২৫ হাজার টাকা আবগারী শুল্ক কেটে রাখা হবে।
বিষয়টি নিয়ে ব্যাংকের গ্রাহকসহ সুধী সমাজের মধ্যে এক ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। এমনকি বেশ কিছু গ্রাহকদের বলতে শুনেছি, আগে তো আবগারী শুল্ক কাটা হত না, তবে এখন কেন কাটা হবে। এই ধারণাটা কিন্তু পুরোপুরি ভুল। পূর্বেও আবগারী শুল্ক কাটা হতো। তবে এক্ষেত্রে অনেক ব্যাংক কর্মকর্তা আবগরী শুল্ক কর্তনের বিষয়টি আমানতকারীদের কাছে জ্ঞাত বা অজ্ঞাতবশতঃ পরিস্কার করতেন না। যে কারণে গ্রাহকদের অনেকেই এখন মনে করছেন, এবারই যেন প্রথম আবগারী শুল্কের বিষয়টি এসেছে। নানা জনের মাথায় এসেছে নানা রকমের চিন্তা ভাবনা। তবে এখন আর আবগারী শুল্ক নিয়ে কোন ধোয়াশা নেই। প্রধানমন্ত্রী বাজেট আলোচনায় বিষয়টি পরিস্কার করে দিয়েছেন এবং সাধারণ মানুষের মনের মধ্যে এক ধরনের স্বস্তি ফিরে এসেছে।
প্রধানমন্ত্রী এক লক্ষ টাকা পর্যন্ত ব্যাংক আমানতের উপর শুল্ক পুরোপুরি মওকুফ এবং ১ লক্ষ থেকে ৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত মোট আমানতের আবগারি শুল্ক ৫০০ টাকা থেকে কমিয়ে ১৫০ টাকা এবং ৫ লক্ষ থেকে ১০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত মোট আমানতের আবগারি শুল্ক ৮০০ টাকা থেকে কমিয়ে ৫০০ টাকা করার ঘোষণা দেন। এছাড়া, ১০ লক্ষ টাকা থেকে ১ কোটি টাকা পর্যন্ত মোট আমানতের আবগারি শুল্ক ২৫০০ টাকা, ১ থেকে ৫ কোটি টাকা পর্যন্ত আমানতের আবগারি শুল্ক ১২ হাজার টাকা এবং ৫ কোটি টাকার উপরে আমানতের জন্য ২৫ হাজার টাকা আবগারি শুল্ক ধার্যের ঘোষণা দেন। এই ঘোষণার পর সাধারণ মানুষ অর্থাৎ স্বল্প সঞ্চয়ের মানুষের মনের মধ্যে এক ধরনের স্বস্তি ফিরে এসেছে।
Advertisement
এবার বিভিন্ন প্রকার আমানতের উপর আবগারী শুল্কের কর্তনের বিষয়ে আসা যাক। স্থায়ী আমানতের মেয়াদ যদি বছরে শুরু হয়ে বছরেই শেষ হয়, তাহলে আবগারি শুল্ক (০১)এক বার দিতে হয়। কিন্তু যদি স্থায়ী আমানতের মেয়াদ এক বছরে শুরু হয়ে পরের বছরে শেষ হয়, তাহলে আবগারি শুল্ক দুই বার দিতে হয়। উদাহরণ স্বরূপ, একজন গ্রাহক অক্টোবর মাসে ছয় মাস মেয়াদি ২ লক্ষ টাকার স্থায়ী আমানত করলেন। তাহলে আমানতের মেয়াদ শেষ হবে পরের বছর মার্চ মাসে। সে ক্ষেত্রে গ্রাহককে (০২) দুই বছরের আবগারি শুল্ক হয়।
চলতি ও সঞ্চয়ী হিসাবের বিপরীতে আবগারি শুল্ক বছরে একবার কাটা হয়। বছরের লেনদেনের ওপর ভিত্তি করে এই আবগারি শুল্কের পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়। সারা বছর চলতি বা সঞ্চয়ী ব্যাংক হিসাবের ব্যালেন্স যদি ১ লক্ষ টাকার নিচে থাকে, তাহলে কোনো আবগারি শুল্ক দিতে হবে না। এর ওপরে গেলে বিভিন্ন হারে আবগারী শুল্ক দিতে হবে, যা ওপরেই উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া, ব্যাংক হিসাবের স্থিতি যদি বছরের কোনো এক সময় ১ লক্ষ টাকা ছাড়িয়ে যায়, তাহলে বছর শেষে এই আবগারি শুল্ক দিতে হবে। উদাহরণ স্বরূপ, ০৫-০৭-২০১৬ তারিখ জহির সাহেবের ব্যাংক ব্যালেন্স ছিল ৫০,০০০ টাকা। ০৮-০৯-২০১৬ তারিখ তার বাবা জহির সাহেবের ব্যাংক হিসাবে ৫৫,০০০ টাকা পাঠালো। এর ফলে, জহির সাহেবের ব্যাংক ব্যালেন্স হল ১,০৫,০০০ টাকা। যেহেতু স্থিতি ১ লাখ টাকা ছাড়িয়ে গেছে, তাই বছরের শেষে অর্থাৎ ডিসেম্বরে তার হিসাবের বিপরীতে আবগারী শুল্ক কেটে রাখা হবে।
আবগারী শুল্ক সম্পর্কে জানার পর অনেকেই মনে করছেন, প্রতিটি লেনদেনে অর্থাৎ টাকা জমা দিলে কিংবা তুলতে গেলে আবগারি শুল্ক কর্তন করা হবে। এটা ভুল ধারণা। সাধারণত ডিসেম্বর মাসে অর্থাৎ বছরে একবারই আবগারী শুল্ক কাটা হয়ে থাকে। এর থেকে বেশি নয়। আবগারী শুল্ক নিয়ে জনগণের মনে এখনও যদি কোন অনিশ্চয়তা থেকে থাকে, সেটা দূর হোক এটাই প্রত্যাশা।
লেখক : উপ-পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক।
Advertisement
এইচআর/জেআইএম