গত কিছুদিন আষাঢ়ে বৃষ্টির কল্যাণে পত্রিকা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, চায়ের আড্ডায় ঢাকা শহরের জলাবদ্ধতা নিয়ে বেশ কথা হচ্ছে। ঢাকা শহরের জলাবদ্ধতা অনেক পুরনো সমস্যা। একটু ভারী বৃষ্টি হলেই শহরের অনেক নিচু এলাকা যেমন যাত্রাবাড়ী, শনির আখড়া, ডেমরা, বাসাবো জলাবদ্ধ হয়ে পড়ে। এমনকি শহরের প্রধান বাণিজ্য কেন্দ্র ও গুরুত্বপূর্ণ এলাকা মতিঝিল পর্যন্ত পানিতে তলিয়ে যায়। প্রশ্ন হচ্ছে এই অবস্থার কারণ কি আর সমাধানই বা কি?
Advertisement
ঢাকার এই দুর্দশার অনেকগুলি কারণের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সঠিক পরিকল্পনার অভাব, ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপ এবং অপরিকল্পিত নগরায়ণ। ১৯৯০ সালে ঢাকা সিটি কর্পোরেশন গঠিত হওয়ার পর অবধি এখন পর্যন্ত ঢাকাকে নিয়ে কোনও টেকসই সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়নি। ঢাকা কে নিয়ে প্রথম পরিকল্পনা করেন প্যাত্রিক গেদেস ১৯১৭ সালে। এরপর নানা পরিকল্পনা করা হলেও ঢাকার ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা ও এর অপরিকল্পিত নগরায়ণ সেইসব পরিকল্পনাকে ফলপ্রসূ হতে দেয়নি।
ঢাকা শহরের মূল পরিকল্পনা যাদের করার কথা সেই রাজউক (রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ) তাদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ। সম্প্রতি তারা ঢাকার কৌশলগত পরিকল্পনা ২০১৬ প্রণয়ন করেছে, যার বাস্তবায়ন সম্ভাবনা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। সমস্যা সমাধান করে ঢাকা কে পরিকল্পিত ও আধুনিক সুবিধা সমন্বিত একটি নগর হিসেবে গড়ে তোলার জন্য এবং নাগরিক সেবা নিশ্চিত করার জন্য বর্তমান সরকার ২০১১ সালে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনকে উত্তর ও দক্ষিণ দুই অঞ্চলে ভাগ করে। আশা করা হয়েছিল নতুন দুটি সিটি কর্পোরেশনের আওতায় ঢাকা নতুন করে প্রাণ ফিরে পাবে। বিশেষত নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করে ঢাকাকে বসবাসযোগ্য করে তোলার ক্ষেত্রে সিটি কর্পোরেশনের এই বিভক্তিকরণ কাজে লাগবে।
২০১৪ সালের সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের পর ঢাকার নির্বাচিত দুই মেয়র অনেক প্রতিশ্রুতি ও আশার বাণী শোনালেও বাস্তবিক অর্থে ঢাকা এখনও সমস্যা জর্জরিত একটি অপরিকল্পিত নগরী। এটা সত্য যে অপ্রশস্ত রাস্তাঘাট, নাজুক ড্রেনেজ ব্যবস্থা, ঢাকা ওয়াসা, পাউবো, সিটি কর্পোরেশন ও বিভিন্ন সরকারি সংস্থার মধ্য সমন্বয়হীনতা ও সুশাসনের অভাব ঢাকার সমস্যা নিরসনের পথে প্রধান অন্তরায়। বিভিন্ন সময় সরকার নানা উদ্যোগ নিলেও যানজট, জলাবদ্ধতার মতো সমস্যাগুলো দিন দিন বাড়ছে। জলাবদ্ধতা, নাজুক পয়ঃনিষ্কাশন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মতো বিষয়ে সমন্বিত ব্যবস্থা গ্রহণ না করার জন্য কর্তৃপক্ষের অবশ্যই দায় রয়েছে।
Advertisement
ঢাকার কল্যাণপুর, ধোলাইখালের মতো ৫৭টি খাল দখল হয়ে আজ নিশ্চিহ্ন। বুড়িগঙ্গা, তুরাগ কিংবা শীতলক্ষ্যার মত নদী দখল দূষণে বিপর্যস্ত। বিভিন্ন সময় প্রভাবশালী মহল নদী-খাল দখলের মহোৎসব করলেও কর্তৃপক্ষ ছিল উদাসীন। আজ একটু বৃষ্টি হলেই ঢাকার রাস্তায় হাঁটু পানি জমে যায়। অনুন্নত ড্রেনেজ ব্যবস্থা আর জলাশয়ের অভাব জলাবদ্ধতার সমস্যা কে বাড়িয়ে দিয়েছে হাজারগুণ। যেকোনো সমস্যায় আমরা কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনা নিয়ে প্রশ্ন তুলি। সমস্যা জর্জরিত আজকের ঢাকার জন্য আমরা সরকারের সঠিক উদ্যোগের অভাবকে দায়ী করি।
কর্তৃপক্ষের অবশ্যই দায় রয়েছে, কিন্তু শুধু কি এই অবস্থার জন্য কর্তৃপক্ষের অব্যবস্থাপনা দায়ী? আজকের এই অবস্থার জন্য নাগরিক হিসেবে আমরাও কি দায় এড়াতে পারি? আমরা কি পেরেছি সত্যিকার দায়িত্বশীল সুনাগরিক হতে? নাগরিক দায়িত্বের কতটুকুই বা আমরা পালন করছি? ঢাকার এই জলাবদ্ধতার সমস্যার জন্য কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি আমাদের দায়িত্বহীন নাগরিক মানসিকতাও দায়ী। কলার খোসাটা, চকোলেটের মোড়কটা আমরা সঠিক জায়গায় ফেলছি কি? রাস্তাঘাটে ময়লা না ফেলে ডাস্টবিনে ময়লা ফেলছি তো? না এই কাজগুলো আমরা সঠিকভাবে পালন করছি না। রাস্তা দখল করে বাড়ি নির্মাণ, যত্রতত্র স্থাপনা নির্মাণ, ফুটপাথ দখল, জলাশয় ভরাট করা এইসব কাজে কখনই আমরা বিরত থাকিনি। যখনি সমস্যায় পড়েছি শুধু সরকারের উপর দায় চাপিয়ে নিজেদের দায়িত্ব এড়িয়ে গেছি।
আমরা ঠিক সুনাগরিক হয়ে উঠতে পারিনি কারণ নাগরিক হিসেবে দায়িত্ব পালনের মানসিকতাই আমাদের গড়ে ওঠেনি। ঢাকার সমস্যা নিরসনে সবার আগে আমাদের সুনাগরিক হয়ে উঠতে হবে। এই শহরকে বাঁচাতে হলে নাগরিক হিসেবে আমাদের যে দায়িত্ব রয়েছে সেটা পালন করতে হবে। উন্নত শহরের নাগরিক জীবনমান উন্নত কারণ সুপরিকল্পনার পাশাপাশি তারা সুনাগরিক হওয়ার চর্চা করে নাগরিক দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে। ঢাকায় বসবাসকারী সকল নগরবাসীকে প্রতিজ্ঞা করতে হবে যেন তার কোন কাজ নগর দূষণের কারণ না হয়। তবেই সমস্যার সমাধান শুরুর কাজটা হয়ে যাবে। ঢাকার জলাবদ্ধতা দূর করার জন্য একটি সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে অতিশীঘ্রই।
ঢাকার খালগুলো দখলমুক্ত করে সেগুলো খননের ব্যবস্থা করতে হবে। জলাশয়গুলো সংরক্ষণ করতে হবে, অনুমোদনহীন স্থাপনা অপসারণ ও ড্রেনেজ ব্যবস্থাকে নিয়মিত সংস্কার করে শক্তিশালী ও আধুনিক করতে হবে, বুড়িগঙ্গাসহ ঢাকার আশেপাশের নদীগুলোকে দূষণমুক্ত করার জন্য আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ সমন্বয়ে কাজ কাজ শুরু করতে হবে অতি দ্রুত। ঢাকার বস্তিবাসী, ভাসমান মানুষদের পরিকল্পিত পুনর্বাসন করতে হবে। সর্বোপরি ঢাকার ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপকে মাথায় রেখে পরিকল্পিত নগরায়ণ নিশ্চিত করতে হবে। সঠিক সমন্বিত পরিকল্পনা, পরিকল্পিত নগরায়ণ ও দায়িত্বশীল নাগরিক মানসিকতার সমন্বয় করতে পারলে কে জানে সেই দিন হয়তো খুব দূরে নয় যেদিন বুড়িগঙ্গার কোল ঘেঁষা ঢাকা হবে বসবাসের জন্য আদর্শ নগরী।
Advertisement
লেখক : শিক্ষক, স্থানীয় সরকার ও নগর উন্নয়ন বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়।
এইচআর/জেআইএম