আন্তর্জাতিক

পড়াশোনায় বাধা দেয়ায় স্বামীকে ‘তালাক’

পশ্চিমবঙ্গের এক কিশোরী জনসমক্ষে তার স্বামীকে তিন তালাক দিয়েছে, কারণ শ্বশুরবাড়ি থেকে মেয়েটির পড়াশোনা নিয়ে তীব্র আপত্তি তোলা হয়েছিল। মুসলমান সমাজের একাংশ মনে করছে পড়াশোনা না করতে দেয়ার বিরুদ্ধে শ্বশুরবাড়ির বিরুদ্ধে যেভাবে সাহস নিয়ে রুখে দাঁড়িয়েছে ১৬ বছরের ওই কিশোরী, তা এক কথায় বৈপ্লবিক পদক্ষেপ।

Advertisement

ওই তালাক ইসলাম সম্মত নয়, এটা বলেও শরিয়তি আইন বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন- পড়াশোনা না করতে দেয়াটাকে স্বামীর নির্যাতন হিসাবে প্রমাণ করে ইসলামি আইন অনুযায়ী বিচ্ছেদ চাইতেই পারে ওই কিশোরী। কিন্তু স্বামীকে তালাক দিয়ে শোরগোল ফেলে দেয়ার পরে ওই কিশোরীর পরিবার এখন ব্যাপক সামাজিক চাপের মধ্যে পড়েছে।

দক্ষিণ ২৪ পরগণার মন্দিরবাজার এলাকার মাম্পি খাতুনের ১৪ বছর বয়সেই বিয়ে দিয়ে দিয়েছিলেন তার বাবা সুরজুল ঘরামি। যদিও ভারতে ১৮ বছরের নিচে কোনও মেয়ের বিয়ে দেয়া বেআইনী।

চায়ের দোকান চালিয়ে সামান্য আয় করা বাবার সামনে তখনই সে প্রতিবাদ করেছিল, চেয়েছিল আরও পড়াশোনা করতে। সেই সময়ে নবম শ্রেণিতে পড়তো মাম্পি। অনেক অনুরোধ-উপরোধের পরে মাম্পির পরিবার এবং হবু শ্বশুরবাড়ি রাজি হয়েছিল দশম শ্রেশির মাধ্যমিক পরীক্ষাটা অন্তত তাকে দিতে দেয়া হবে।

Advertisement

এ বছর মাধ্যমিকে সন্তোষজনক ফল করে উত্তীর্ণ হয় মাম্পি। ভর্তি হয় জেলার একটি নামকরা স্কুলে। কিন্তু সে যখন আরও পড়াশোনা চালিয়ে যেতে আগ্রহ দেখায়, তখনই শুরু হয় অশান্তি।

মাম্পি উচ্চমাধ্যমিক পড়ার জন্য যে স্কুলে ভর্তি হয়েছে, সেই কৃষ্ণচন্দ্রপুর হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক চন্দন মাইতি বলেন, ‘মাম্পি আমাদের স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই শ্বশুরবাড়ি ভীষণ চাপ দিতে শুরু করে। হুমকিও দেয়া হয়।’

‘ও শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে বাপের বাড়িতেই থাকছিল। মেয়ের পড়াশোনার জেদ দেখে আর শ্বশুরবাড়ির চাপ দেখে প্রথমে বিরোধীতা করলেও সম্প্রতি বাবা-মায়ের সমর্থন পাচ্ছিল মাম্পি’- বলছিলেন কৃষ্ণচন্দ্রপুর হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক চন্দন মাইতি।

দিন কয়েক আগে বাপের বাড়ি আর শ্বশুরবাড়ির মধ্যে মাম্পির পড়াশোনা নিয়ে অশান্তি গড়ায় ঝগড়া আর হাতাহাতির পর্যায়ে। হঠাৎই মাম্পি সেখানে উপস্থিত তার স্বামীর দিকে তাকিয়ে পর পর তিনবার তালাক উচ্চারণ করে দেয়। সকলেই হতচকিত হয়ে যায় ঘটনার আকস্মিকতায়- বলছিলেন প্রধান শিক্ষক মাইতি।

Advertisement

পড়াশোনা করতে চেয়ে স্বামী বা শ্বশুরবাড়ির প্রতি বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে কোনো নারী, এমন ঘটনা মাঝে মাঝে শোনা গেলেও কোনো মুসলিম কিশোরী উচ্চশিক্ষার জন্য জনসমক্ষে স্বামীকে তালাক দিয়েছে- এর নজির খুব একটা মনে করতে পারছে না পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান সমাজ।

তবে একই সঙ্গে শরিয়তী আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এইভাবে কোনো নারী তার স্বামীকে তালাক দিতে পারে না। বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য নারীদের আলাদা পদ্ধতি রয়েছে।

‘মেয়েটি পড়াশোনার ব্যাপারে আবেগপ্রবণ হয়ে গিয়ে ওই কথা বলেছে। কিন্তু ইসলামী বিধান অনুযায়ী মহিলারা তার স্বামীকে তালাক দিতে পারে না। কিন্তু বিচ্ছেদের প্রশ্ন যদি কোনও মহিলার দিক থেকে ওঠে, তাকে মাহকামা শরিয়া বা এধরনের যেসব প্রতিষ্ঠানে ইসলামি বিধি-বিধান দেয়া হয়, সেখানে দরখাস্ত করতে হবে।’

‘দু্ই পক্ষ মুখোমুখি বসবে, দরখাস্ত খতিয়ে দেখা হবে, তারপরেই বিচ্ছেদ হতে পারে- বলেন পশ্চিমবঙ্গের মন্ত্রী ও জামিয়ত-এ উলেমা-এ হিন্দের শীর্ষ নেতা মাওলানা সিদ্দিকুল্লা চৌধুরী।

দারুল উলুম, দেওবন্ধ প্রশিক্ষিত শরিয়ত বিশেষজ্ঞ চৌধুরী আরও বলেন, স্বামী নিরুদ্দেশ হলে, অথবা পুরুষত্বহীন বা মানসিক রোগগ্রস্ত হলে কিংবা খোরপোষ দেন না, নির্যাতন করেন - এসব ক্ষেত্রে মুসলমান নারী আইন অনুযায়ী বিচ্ছেদ পেতে পারেন। পড়াশোনা না করতে দেয়াটাকে স্বামীর নির্যাতনের প্রমাণ হিসাবে দেখিয়ে হয়তো মেয়েটি বিচ্ছেদ চাইতে পারতো।

মুসলমান সমাজের মধ্যে শিক্ষার প্রচার-প্রসারে কাজ করে, এমন একটি পত্রিকা ‘উদার আকাশ’-এর সম্পাদক ফারুক আহমেদ মনে করেন, ‘মাম্পি যেভাবে তালাক দিয়েছে, তা বৈধ না অবৈধ সেটা আলেমদের বিচার্য বিষয়। তারা এটা নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করতেই পারেন।’

‘কিন্তু ১৬ বছর বয়সে পড়াশোনা করতে চেয়ে স্বামীর মুখের ওপরে তিনবার তালাক উচ্চারণ করতে পেরেছে যে মেয়ে, সেটা একটা বিরাট বড় বার্তা। আগামী দিনে মুসলিম মেয়েদের কাছে এটা একটা পথপ্রদর্শক হয়ে উঠবে।’ - বলেন ফারুক আহমেদ।

কলকাতার সাংবাদিক মোক্তার মন্ডল বলেন, বর্তমানে তো বহু মুসলমান পুরুষও শরিয়তী বিধান মেনে তালাক দেন না- পর পর তিনবার তালাক উচ্চারণ করে বিচ্ছেদ ঘটিয়ে দেন। সেটা তো সমাজ মেনে নেয়।

‘তাহলে একটি মেয়ে শরিয়ত মেনে তালাক দেয়নি- তা নিয়ে প্রশ্ন কেন তোলা হচ্ছে! এখানে দেখা দরকার যে কেন মাম্পি খাতুন জনসমক্ষে বিচ্ছেদ ঘোষণা করলো। সে পড়াশোনা করতে চেয়ে বিচ্ছেদ চেয়েছে- এই সাহসিকতার জন্যই তাকে কুর্নিশ করা দরকার।

তবে স্বামীকে তিন তালাক দেয়ার কথা এলাকায় ছড়িয়ে পড়তেই এখন মাম্পি খাতুনের পরিবার ব্যাপক সামাজিক চাপের মধ্যে পড়ে গেছে। তারা সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে রাজি হয়নি।

‘আমি অনেকবার ওর বাড়িতে গিয়ে, বাবার দোকানে বসে চা খেতে খেতে বোঝানোর চেষ্টা করেছি, এখনও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি যাতে মেয়েটি পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারে। আমি এও বলে এসেছি যে ওকে স্কুলের হোস্টেলে রেখে পড়ানোর দায়িত্ব আমাদের। তারপরও যতদিন ও পড়তে চাইবে, সব খরচ আমরাই দেব। কিন্তু ওদের ওপরে ভীষণ সামাজিক চাপ রয়েছে সেটাও অনুভব করতে পারছি,- বলেন মাম্পির স্কুলের প্রধান শিক্ষক চন্দন মাইতি।

মাম্পি যে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে আরও পড়াশোনা করতে চেয়ে সামাজিক চাপের মধ্যে পড়েছে, সেই পরীক্ষায় এবছরই রাজ্যে ১৭ নম্বর স্থান অধিকার করেছে এক মুসলমান ছাত্রী রুমানা। ওই পরীক্ষায় প্রতিবছরই ক্রমবর্ধমান হারে মুসলমান ছাত্রছাত্রীরা উন্নততর ফল করছে। বিবিসি বাংলা।

এসআইএস/জেআইএম