ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগণা জেলার ছোট্ট শহর বারাসত। ভারতের এমন আর দশটা শহরের সঙ্গে বারাসতের পার্থক্য অনেক। হিন্দু-মুসলমানের অপূর্ব সৌহার্দ্য এই বারাসতকে করে তুলেছে অনন্য।
Advertisement
বারাসত শহর লাগোয়ো ছোট একটি মসজিদ। আশপাশের অল্পসংখ্যক মুসলমানরা এখানে নামাজ আদায় করলেও এর পরিচিতি ‘বোস বাড়ির মসজিদ’ হিসেবেই।
বাংলাদেশের একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন বোস পরিবার। সে সময় ওই জমিতে জীর্ণ অবস্থায় থাকা একটি মসজিদকে রক্ষা করেছেন এই হিন্দু পরিবারের সদস্যরা। এরপর থেকে প্রায় গত অর্ধশতক ধরে বোস পরিবারই ‘দেখাশোনা’ করছে মসজিদটি।
তাদের হাতেই শ্রী ফিরে এসেছে মসজিদের। এমনকি, নিয়ম করে মুসলিমদের মতো পবিত্র রমজান মাসে এখন রোজাও থাকেন বোস পরিবারের সদস্যরা।
Advertisement
বর্তমানে মসজিদটি তদারকি করছেন বোস পরিবারের ছেলে পার্থ সারথি বোস। মসজিদের প্রতি তার এতোই টান ও নিষ্ঠা যে, স্বগোত্রের বন্ধুরা ৪০ বছরের পার্থ সারথিকে মজা করে ডাকেন মো. পার্থসারথি বসু নামে।
কিন্তু এতে ভ্রুক্ষেপ নেই পার্থের। কর্তব্যেও বিরাম নেই তার। মসজিদের দেখভাল ছাড়াও রমজান মাসে রোজা থাকা পার্থ ইমামের সঙ্গে মসজিদে বসে একসঙ্গে ইফতার করেন।
শুধু তাই নয়, মসজিদের আশপাশে আর কোনো মুসলিম পরিবার নেই। নামাজ পড়তে অন্যরা আসেন আশপাশের গ্রামগুলো থেকে। ফলে রমজান মাসে নিয়মিত রোজাদারদের জন্য ইফতারের আয়োজ করেন পার্থ নিজে।
পার্থ একাই নয়, মুসলিমদের রোজা ও ইফতারে তাকে সহায়তায় নিয়মিত এগিয়ে আসেন আশপাশের অন্যান্য হিন্দু পরিবারগুলো।
Advertisement
ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে এখনো বজায় থাকা সাম্প্রদায়িক বিভেদ-হানাহানি বারাসতকে স্পর্শ করতে পারেনি। মুসলিমদের ধর্মীয় আচারের মতোই এখানে হিন্দুরা ধর্মাচার পালন করেন।
মসজিদের পাশেই আম-লিচুর বড় বাগান। সেখানে নিয়মিত হচ্ছে দুর্গা পূজার আয়োজন। এজন্য লাগোয়া মসজিদে জুমার নামাজ, রমজানে ইফতার, তারাবির নামাজ, অন্যান্য নামাজ বা কোরান তেলাওয়াতে কখনোই সমস্যা দেখা দেয়নি।
জানা গেলো, বারাসতে পশ্চিম ইছাপুরের নবপল্লীতে ২০ থেকে ২৫ বিঘা জমি জুড়ে বোস বাড়ি। বাড়ির কর্তা ৬৭ বছরের দীপক বসু।
তৎকালীন খুলনার এই বসু পরিবার একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় নির্যাতনের শিকার হয়ে পালিয়ে বারাসতে চলে আসেন। এখানে এসে ঘরবাড়ি গড়ে তোলার সময় ভাঙাচোরা অবস্থায় এই মসজিদটি দেখতে পান।
কোনরকমে থাকা তিন কাঠার মতো জায়গার মসজিদটি তখন পরিত্যক্ত। এর সংস্কার নিয়ে কোনো ‘মাথা ব্যথা’ নেই এলাকার মুসলিমদের। কিন্তু দীপক বসুর মা ভক্তি সহকারে বাতি দিলেন। সেই থেকে বোস পরিবারের হাতে প্রাণ ফিরে পেতে শুরু করলো মসজিদটি।
নিজেদের ধর্মবিশ্বাস ও লোকাচার অবিকল রয়েছে বোসদের। তবে সমাজের প্রচলিত সংকীর্ণকা ছুড়ে ফেলে তারা এখনো সেবা করে চলেছেন মসজিদের, মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের।
বয়সের ভারে উদ্যোমে ভাটা পড়লেও এখন সকালে মসজিদ ঝাড়ু দিয়ে পরিস্কার করেন দীপক বসু। বয়সের ভারে নিজে রোজা না রাখলেও ছেলে পার্থের নিস্তার নেই। হাসিমুখের বাবার মতোই দায়িত্ব পালন করে চলছেন পার্থ।
দীপক বসুর কথা, লোক দেখানো বাড়াবাড়ি মানি না। একসঙ্গে জড়িয়ে বাঁচায় সমস্যা নেই, এটুক বুঝি।
এদিকে, স্বামীর আচারকে শ্রদ্ধা জানিয়ে সেহরীর আগেই মাঝরাতে উঠে খাবার তৈরি করে দেন পার্থের স্ত্রী পাপিয়া।
বোস বাড়ির কেউ মারা গেলে তাকে অন্তত একবার আনা হয় মসজিদ প্রাঙ্গণে। শ্রদ্ধা দেখিয়ে শ্মশানে শেষযাত্রার আগে আজান দেন ইমাম। এমনকি, বিয়ের পরে এ বাড়ির নতুন বউরা প্রথমবার শ্বশুরবাড়ি ঢোকার আগে প্রণাম করেন মসজিদে। বোস বাড়িতে নবজাতক কেউ জন্ম নিলে ইমামের হাতের পায়েস খেয়ে হয় তার অন্নপ্রাশন।
অন্যদিকে, বিতর্ক এড়াতে মসজিদে নগদ অনুদান গ্রহণ করা হয় না। প্রভাবশালী এক ধর্মীয় সংগঠনের পক্ষ থেকে মসজিদটির দায়ভার বহনের প্রস্তাব পেলেও তা ফিরিয়ে দিয়েছে বোস পরিবার।
সূত্র : আনন্দবাজার।
এসআর/জেআইএম