বিশেষ প্রতিবেদন

ষোড়শ সংশোধনী বিচার বিভাগকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে

ড. কামাল হোসেন। বিশিষ্ট আইনজীবী ও সংবিধান প্রণেতা। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও খ্যাতি রয়েছে আইন পেশায়। গণফোরামের সভাপতি তিনি। 

Advertisement

সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে সম্প্রতি মুখোমুখি হন জাগো নিউজ’র। আলোচনায় গুরুত্ব পায় রাজনীতির নানা প্রসঙ্গও। চলমান সংকট উত্তরণে গুরুত্ব দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নীতি-আদর্শের ওপর। তিন পর্বের ধারাবাহিকের প্রথম পর্ব আজ প্রকাশিত হলো। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু।

জাগো নিউজ : ফের আলোচনায় গুরুত্ব পাচ্ছে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে। এ সংশোধনী বাতিলের শুনানিতে অংশ নিয়েছেন আপনিও। বাতিলের যৌক্তিকতা নিয়ে কী বলবেন?

ড. কামাল হোসেন : সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী স্বাধীন বিচার বিভাগ ক্ষুণ্ন করার সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে বলে মনে করি। এ সংশোধনী বিচার বিভাগকে ঝুঁকি ও অবৈধ হস্তক্ষেপের মুখে ফেলেছে। আইনের শাসনকে বিপন্ন করেছে। এ কারণে হাইকোর্ট ষোড়শ সংশোধনী বাতিল ও অবৈধ বলে যে রায় দিয়েছেন তা পুরোপুরিভাবে সমর্থন করেছি। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছি, আপনারা এটি অবৈধ ও অসাংবিধানিক হিসেবে বাতিল করে দেন।

Advertisement

জাগো নিউজ : বিচারকদের অপসারণ প্রসঙ্গে অন্য দেশের উদাহরণ সম্পর্কে কিছু বলুন?

ড. কামাল হোসেন : আমেরিকা, ইংল্যান্ড, কানাডা, হংকং, জার্মানি, সুইডেন, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ইসরায়েল, জাম্বিয়া, ত্রিনিদাদ ও টোবাকো, নিউসাউথ ওয়েলসসহ বিভিন্ন দেশে বিচারক অপসারণের জন্য সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল অথবা এ রকম পদ্ধতি রয়েছে।

অষ্টম সংশোধনী মামলার রায়ে সুপ্রিম কোর্ট বলে দিয়েছেন যে, গণতন্ত্র, প্রজাতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতার পৃথকীকরণ, স্বাধীন বিচার বিভাগ ও মৌলিক অধিকার হলো সংবিধানের মৌলিক কাঠামো। শুধু এটি নয়, আরও বেশ কয়েকটি রায়ে বলা হয়েছে, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর অংশ।

জাগো নিউজ : আমাদের সংবিধান কী বলে?

Advertisement

ড. কামাল হোসেন : ১৯৭২ সালে প্রণীত সংবিধানের ২২ অনুচ্ছেদকে বলা হয়েছে সংবিধানের মৌলিক নীতির একটি। এখানে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার কথা বলা হয়েছে, যা থাকবে রাষ্ট্রের অন্য দুটি অঙ্গের হস্তক্ষেপমুক্ত।

১৯৭৫ সালের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি ১৯৭২ সালের আদি সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ থেকে বিচারক অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাত থেকে প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। পরবর্তীতে পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধান করা হয়। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করে রায় দিলেও এ ব্যবস্থা রেখে দেন। ওই রায়ে বলা হয়, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল একটি স্বচ্ছ পদ্ধতি।

জাগো নিউজ : তার মানে আস্থার প্রশ্নে বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে দিতে নেই?

ড. কামাল হোসেন : সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাজনৈতিক দলের মনোনয়নে নির্বাচিত সংসদ সদস্যের আসন শূন্য হবে যদি নিজ দলের বিপক্ষে ভোট দেন। এ কারণে বিচারক অপসারণের ক্ষেত্রে সংসদ সদস্যরা নিরপেক্ষ ও স্বাধীনভাবে ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবেন কিনা- সে প্রশ্ন ওঠে। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও চাপে প্রভাবিত হয়ে সংসদের মাধ্যমে বিচারক অপসারণের ক্ষমতা দেয়ায় বিচার বিভাগকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলা হয়েছে।

জাগো নিউজ : বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে নানা প্রশ্ন। জীবনের এ বেলায় এসে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে কী বলবেন?

ড. কামাল হোসেন : বিচার বিভাগের স্বাধীনতা হচ্ছে মূল স্তম্ভের একটি। কার কতটুকু ক্ষমতা বা দায়িত্ব, তা সংবিধানে লিপিবদ্ধ আছে। আইন বিভাগ, নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগের কার কী দায়িত্ব, তা সংবিধানে নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে।

এই ক্ষমতার সীমা কেউ লঙ্ঘন করলে বিচার বিভাগ তখন বাতলে দেয় যে, তুমি এই সীমা লঙ্ঘন করেছ। বিচার বিভাগ স্বাধীন না থাকলে এই দায়িত্ব পালন করতে পারে না। এরশাদের শাসনামলের সময় যখন উচ্চ আদালতকে কয়েক টুকরা করা হলো অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে, তখন আমরা রিট করলাম। আদালত উচ্চ আদালতের বিভাজন রোধ করে রায় দিল। শুধু তাই নয়, অষ্টম সংশোধনীকেই অবৈধ ঘোষণা করল আদালত।

জাগো নিউজ : উচ্চ আদালতের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে কী বলবেন?

ড. কামাল হোসেন : বিচারপ্রত্যাশী মানুষের সর্বশেষ ভরসাস্থল হচ্ছে উচ্চ আদালত। নিম্ন আদালতে হয়রানি বা সাধারণ মানুষ সর্বশেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে এখানে আসেন। উচ্চ আদালত প্রতিদিনই কিছু কিছু জনকল্যাণমূলক রায় দিচ্ছেন। এখনও উচ্চ আদালতের প্রতি সাধারণ মানুষের বিশ্বাস ও ভরসা রয়েছে বলে আমি মনে করি।

জাগো নিউজ : জেলা জজদের সচিবের মর্যাদা দেয়া হয়েছে। এটি কীভাবে দেখছেন?

ড. কামাল হোসেন : নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ আলাদা হওয়ার পরই নিম্ন আদালতের বিচারকদের পদ ও মর্যাদার বিষয়টি সামনে আসে। উচ্চ আদালতের এ সিদ্ধান্ত বিচার বিভাগকে আরও শক্তিশালী করবে বলে মনে করি। এ নিয়ে কোনো বিতর্ক থাকা উচিত নয়।

জাগো নিউজ : বর্তমান প্রধান বিচারপতির কার্যক্রম নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। প্রধান বিচারপতির নেয়া কিছু উদ্যোগের কারণে বিচার বিভাগের সঙ্গে জড়িতরা সাধুবাদ জানাচ্ছেন। আবার সরকারপক্ষের লোকজনের কাছ থেকে সমালোচনা হচ্ছে। আপনার পর্যবেক্ষণ কী?

ড. কামাল হোসেন : প্রধান বিচারপতি বিচার বিভাগের ক্ষমতার বাইরে কোনো কিছু করছেন বলে আমার জানা নেই। তিনি বিচার বিভাগের প্রধান। তিনি যেসব উদ্যোগ নিচ্ছেন, তা বিচার বিভাগের স্বার্থে বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। এখানে সমালোচনার কোনো কারণ আছে বলে মনে করি না।

জাগো নিউজ : নির্বাহী বিভাগের সঙ্গে বিচার বিভাগের দ্বন্দ্ব প্রসঙ্গে …

ড. কামাল হোসেন : সংবিধানের ১১১নং অনুচ্ছেদে স্পষ্ট করে বলা আছে, নির্বাহী বিভাগ বিচার বিভাগকে সহযোগিতা করবে। এখানে দ্বন্দ্বে জড়ানোর কোনো অবকাশ নেই।

জাগো নিউজ : প্রধান বিচারপতির ‘জনসম্মুখে’ কথা বলা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন আইনমন্ত্রী …

ড. কামাল হোসেন : কথা বলা প্রত্যেক নাগরিকের মৌলিক অধিকার। যেকোনো বিষয় নিয়ে প্রধান বিচারপতির কথা বলার মৌলিক অধিকার রয়েছে। বিচার বিভাগের সর্বোচ্চ ব্যক্তি বা সর্বোচ্চ আদালত নিয়ে কথা বলতে বিশেষ শ্রদ্ধা রাখতে হয়। আদালত, আদালতের কর্তাব্যক্তি নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করা আদালত অবমাননার শামিল।

জাগো নিউজ : নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের বিচারিক ক্ষমতা বাতিল করা হয়েছে। এটি কীভাবে দেখছেন?

ড. কামাল হোসেন : উচ্চ আদালত সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলেই আমি মনে করি। সংবিধানের ২২নং অনুচ্ছেদে এ ব্যাপারে স্পষ্ট করে বলা আছে। যেহেতু বিচার বিভাগ নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা সেহেতু বিচারিক ক্ষমতা নির্বাহী বিভাগের হাতে থাকার কোনো যুক্তি থাকতে পারে না।

বিচার করার ক্ষমতা বিচার বিভাগই রাখে। এটি সংবিধানের মৌলিক কাঠামোতে বলা আছে। এটি পরিবর্তন করা হলে সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক করা হবে। আর যে সংশোধনীর মাধ্যমে এই পরিবর্তন আনা হবে, সেই সংশোধনীও অবৈধ বলে বিবেচিত হবে। কারণ বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ব্যাপারে কোনো আপস হতে পারে না।

জাগো নিউজ : ভ্রাম্যমাণ আদালত প্রসঙ্গে …

ড. কামাল হোসেন : ভ্রাম্যমাণ আদালত অবশ্যই থাকতে পারে। কিন্তু সেখানে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কেন? জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট দিয়েই ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করতে হবে।

এএসএস/এমএআর/পিআর