বান্দরবানের সুয়ালক ইউনিয়নের স্যারনপাড়া। এই গ্রামের গৃহবধূ ভান রাম এং বমের প্রতিদিনের রুটিন পাল্টে গেছে। ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে কলসি কাঁখে তাকে ছুটতে হয় গহীন অরণ্যে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তাকে সারাদিনের বিশুদ্ধ পানি সংগ্রহের জন্য স্যারনপাড়া থেকে নামতে হয় প্রায় ছয়শত ফুট নিচুতে।
Advertisement
প্রতিদিনের মতই দেখা গেল ভান রাম তার আট বছরের ছোট শিশুকে নিয়ে থুরং ভর্তি কলসি আর বোতল নিয়ে পাহাড় থেকে ছড়াতে বয়ে আসা পানি সংগ্রহ করছেন। একটা দুটো বোতল নয় ১৫ থেকে ২০টি বোতল আর এক কলসি পানি পূর্ণ করছেন।
পাহাড় থেকে ঝর্ণার মতো বয়ে আসা পানিই তাদের কাছে সুপেয় পানি হিসেবে পরিচিত। আর এই পানি দিয়েই সারাদিনের প্রয়োজনীয় কাজ সারবেন ভান রাম।
পূর্ণ বোতল আর কলসি থুরং (এক ধরনের বিশেষ ঝুড়ি) এ নিয়ে নিচ থেকে ছয়শত ফুট উঁচু গ্রামে উঠতে শুরু করেন গৃহবধূ ভান রাম। পাহাড়ে পাড়ার স্থানীয় বাসিন্দাদের হাতে তৈরি আঁকা-বাঁকা মেঠো সিঁড়িতে খুব সর্তকতার সঙ্গে ধাপে ধাপে পা ফেলছেন ভান রাম। কারণ একটু অসর্তক হলেই পড়ে যেতে পারেন ছয়শত ফুট গভীর খাদে। উপরে উঠতে গিয়ে হাঁপিয়ে যাচ্ছেন বার বার, নিচ্ছেন একটু বিশ্রাম। সঙ্গে তার ৮ বছরের শিশুটিও।
Advertisement
ধাপে ধাপে সিঁড়িতে উঠতে গিয়ে হাঁপিয়ে যাওয়া ভান রাম জাগো নিউজকে বলেন, শুষ্ক মৌসুমে পাহাড়ে পানির অনেক কষ্ট। প্রতিদিন সকালেই অনেক নিচুতে নেমে সারাদিনের খাওয়ার আর গৃহস্থলীর কাজের জন্য পানি সংগ্রহ করতে হয়।
তিনি আরও বলেন, সকাল ৮টার আগেই এই পানি সংগ্রহ করতে হয়। এর পর কাজের উদ্দেশ্যে রওনা হতে হয়। পাহাড়ে পানির মূল্য অনেক বেশি। তাই পানির অপচয় করি না। সবকাজেই প্রয়োজন মাফিক পানি ব্যবহার করি।
এ কথা শুধু ভান রাম এং বমের নয় স্যারনপাড়ার বাসিন্দা লাল সিয়ান বম, টেন ময় বমসহ এলাকায় বাস করা ৫২ পরিবারের ।
স্যারেন পাড়ার আরেক বাসিন্দা লাল সেলিয়াম বম বলেন, পাহাড়ে পানির মূল্য অনেক। এক কলস বিশুদ্ধ পানি আনার জন্য পাহাড়ের অনেক গভীরে যেতে হয়। অনেক সময় পানি আনতে গিয়ে পাহাড় থেকে পড়ে গিয়ে মৃত্যুর ঘটনা ঘটে।
Advertisement
প্রতি বছরই শুষ্ক মৌসুমে খাওয়ার পানি সংকটে পড়েন স্যারনপাড়া, নিজা ম্রো পাড়া, চিম্বুক বাগানপাড়া, বাইট্টাপাড়া, তাবলা হেডম্যানপাড়া, সিতা পহাড়াপাড়াসহ পাহাড়ের অর্ধ শতাধিক পাড়ার বাসিন্দা।
গ্যাসমনিপাড়ার বাসিন্দা পাথই বম বলেন, বর্ষাকালে পানির তেমন সমস্যা থাকে না। কিন্তু শুষ্ক মৌসুম আসলেই ছড়ার পানি পান করতে হয়। আর ছড়ার পানি সব সময় পরিষ্কার থাকে না।
সুয়ালক ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য লাল হাই বম বলেন, পাহাড়ের বেশির ভাগ এলাকার মানুষ বিশুদ্ধ পানির সংকটে পড়েছেন। দুর্গম এলাকার মানুষের সুপেয় পানি সংগ্রহ করা খুবই কষ্টসাধ্য। এমন অনেক গ্রাম আছে দুই থেকে তিন কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে পানি সংগ্রহ করতে হয়। এই সংকট নিরসনে সরকারি-বেসরকারিভাবে বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন।
এদিকে সাইঙ্গ্যাপাড়ার বাসিন্দা পাইসা থোয়াই বলেন, ছড়ার পানি অপরিষ্কার থাকে। এসব পানি ব্যবহার করে পেটের পীড়ায় ভুগতে হয় ।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের তথ্যানুসারে, পুরো জেলায় ৮ হাজার ৬৬১টি রিংটিউবওয়েল ও ডিপ টিউবওয়েল রয়েছে। যার মধ্যে ৫ হাজার ৬৮৯টি সচল এবং ২ হাজার ৯৭২টি অচল। জিএফএস লাইন ৮৮টির মধ্যে ১৭টি সচল, অকেজো ৭১টি।
বান্দরবান জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের সহকারী নির্বাহী প্রকৌশলী খোরশেদ আলম বলেন, পাহাড়ের উঁচুতে থাকা পাড়াগুলোতে পানির সংকট নিরসন করা সম্ভব নয়। কারণ এসব এলাকার পানির স্তর খুব নিচু থাকায় রিংটিউবওয়েল বসানো যায় না। তবে ওই এলাকা থেকে দুই কিলোমিটারের মধ্যে যদি কোনো ঝর্ণা থাকে এবং তা যদি গ্লোবাল ফ্লো সিস্টেম (জিএফএস) বসানোর উপযোগী হয় তাহলে পানির সংকট নিরসন করা সম্ভব।
আরএআর/জেআইএম