গত জানুয়ারিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেয়ার পর প্রথম বিদেশ সফরে সোমবার সৌদি আরব থেকে ইসরায়েলে পৌঁছেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তবে সমালোচকরা বলছেন, মধ্যপ্রাচ্যে আরব-ইসরায়েলি শান্তি চুক্তির জন্য শুধুমাত্র প্রতিশ্রুতির ফুলঝুড়ি ছাড়া কোনো পরিকল্পনা নেই ডোনাল্ড ট্রাম্পের।
Advertisement
মধ্যপ্রাচ্য সফরে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু ও ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করবেন ট্রাম্প। নতুন শান্তিচুক্তি প্রক্রিয়ায় মার্কিন প্রেসিডেন্টের সমর্থন লাভের উদ্দেশ্যে চলতি মাসের শুরুতে ওয়াশিংটন সফর করেন আব্বাস। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইসরায়েলের প্রতি ট্রাম্প প্রশাসনের দৃঢ় সমর্থন রয়েছে, যা শান্তিচুক্তি নিয়ে যেকোনো ধরনের আলোচনা ভঙ্গুর করে দিতে পারে।
ওয়াশিংটনভিত্তিক ইনস্টিটিউট ফর প্যালেস্টাইন স্টাডিজের জ্যেষ্ঠ গবেষক মইন রাব্বানি শান্তিচুক্তির বিষয়টিকে ‘গরম হাওয়া’ বলে মন্তব্য করেছেন। শান্তিচুক্তি নিয়ে ট্রাম্পের জোরাল পরিকল্পনার অভাব রয়েছে বলে জানান তিনি। মার্কিন এই গবেষক বলেন, ইসরায়েল-ফিলিস্তিন শান্তিচুক্তির জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কোনো পরিকল্পনা নেই। এছাড়া সামনে যে এ ধরনের পরিকল্পনা নেয়া হবে তারও কোনো ইঙ্গিত নেই। অথবা এমন কোনো ভিত্তি নেই যার ওপর ধারণা করা যেতে পারে যে, এ ধরনের পরিকল্পনা হতে পারে অথবা বাস্তবায়ন করা উচিত।
১৯৯৩ সালের ওসলো চুক্তির ব্যর্থতার পর থেকে শান্তিচুক্তি পুনর্নবায়নে মার্কিন নেতৃত্বাধীন কোনো পদক্ষেপ ফিলিস্তিনিদেরকে স্বশাসিত ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে রাখা ছাড়া কোনো ফল এনে দেয়নি। ভূখণ্ড, বসতিসমূহ, ফিলিস্তিনি শরণার্থী ও তাদের অধিকার নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে মার্কিন সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন ওসলো চুক্তির উপাদানগুলোর আলোচনা পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা করেছিলেন এবং ২০০০ সালে ক্যাম্প ডেভিড সামিটে একটি চূড়ান্ত চুক্তিতে পৌঁছানোর চেষ্টাও করেন।
Advertisement
কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই প্রক্রিয়া ব্যর্থ হয়। এর পর থেকে দখলিকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে অবৈধ ইসরায়েলি ইহুদি বসতিস্থাপন অব্যাহত রয়েছে। এর ফলে বছরের পর বছর ধরে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে শান্তি প্রক্রিয়া। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ইসরায়েলের সঙ্গে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্টের চেয়ে বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সম্পর্ক বেশ উষ্ণ। এর ফলে শান্তিচুক্তি প্রক্রিয়ায় ইসরায়েলের দেয়া পূর্বশর্তে খুব কমই প্রভাব খাটাতে পারবেন মার্কিন এই প্রেসিডেন্ট।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক পলিসি নেটওয়ার্কের আল-শাবাকা প্যালেস্টানিয়ান পলিসি নেটওয়ার্কের ফেলো ব্যাকোনি বলেন, বসতি সম্প্রসারণ নীতির সুরক্ষায় ইসরায়েল ধারাবাহিকভাবে আলোচনার বিষয়টিকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। আলোচনার কথা বললেও অবৈধ বসতি স্থাপন থেকে পিছু হটেনি ইসরায়েল। তবে ট্রাম্প প্রশাসনের সময় ইসরায়েলি এই নীতি অব্যাহত থাকবে বলে বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন।
ট্রাম্প মার্কিন প্রেসিডেন্টের শপথ নেয়ার সময় থেকে ইসরায়েল এখন পর্যন্ত ৩ হাজার অতিরিক্ত অবৈধ বসতি স্থাপনের অনুমতি দিয়েছে। আগামী ২০ বছরের মধ্যে নতুন এসব বসতি দখলকৃত পশ্চিম তীরে করার ঘোষণা দিয়েছে।
চলতি মাসে আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব নেয়া ইসরায়েলে নিযুক্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিতর্কিত নতুন রাষ্ট্রদূত ডেভিড ফ্রাইডম্যান ইসরায়েলের অবৈধ বসতি স্থাপনের শক্তিশালী সমর্থক। ফ্রাইডম্যানের নিয়োগের ফলে দেশটির সিনেটে পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটির সদস্য ও আমেরিকান ইহুদি সংস্থাগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়। বিশ্লেষকরা বলছেন, এই অঞ্চলে শান্তি আনতে সৎ মধ্যস্থতাকারী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের অক্ষমতা ও অনিচ্ছা রয়েছে।
Advertisement
এর আগে ফিলিস্তিন-ইসরায়ের দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানের ব্যাপারে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন ফ্রাইডম্যান। যা ঐতিহ্যগতভাবে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। একই সঙ্গে মার্কিন এই কর্মকর্তা তেল আবিব থেকে জেরুজালেমে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস সরিয়ে নেয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। যদিও ইসরায়েলের দাবি জেরুজালেম হচ্ছে তাদের রাষ্ট্রের রাজধানী। তবে ইসরায়েলের দখলিকৃত এই এলাকার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি নেই। ১৯৪৭ সালের জাতিসংঘের বিভাজন পরিকল্পনায় জেরুজালেম আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত শাসকের অধীনে শাসিত হওয়ার কথা বলা আছে।
১৯৬৭ সালে ইসরায়েল জেরুজালেমের পূর্বাঞ্চলের অর্ধেক এলাকা অবৈধভাবে দখল করে। ১৯৮০ সালে একটি আইন পাসের পর এই এলাকাকে ইসরায়েলের শাশ্বত ও অবিচ্ছিন্ন রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করে।
ইসরায়েলের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক ও সামরিক সহায়তা বিবেচনা করে, শান্তি আলোচনার জন্য মধ্যস্থতাকারী হিসেবে ওয়াশিংটনের কার্যকর ভূমিকা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের বৃহৎ আর্থিক সহায়তাপ্রাপ্ত দেশ হচ্ছে ইসরায়েল। ১৯৪৮ সালে রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ২৩৩ বিলিয়ন ডলার সহায়তা পেয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে।
আগামী দশকে ইসরায়েলকে আরো ৩৮ বিলিয়ন ডলার অর্থ সহায়তা দেবে যুক্তরাষ্ট্র; ওয়াশিংটনের ইতিহাসে বড় ধরনের বৈদেশিক সহায়তা প্যাকেজ এটি। ক্ষমতার মেয়াদের একেবারে শেষের দিকে এসে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ইসরায়েলের জন্য ওই সহায়তা চুক্তিতে সই করেন।
তবে একই সময়ে ফিলিস্তিনিদের দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে স্বনির্ভরতা অর্জনের ভূমিকা ক্রমশই প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে দখলিকৃত ভূখণ্ডে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের নিরাপত্তা সমন্বয়ের পুনর্নিন্দা জানিয়েছেন ফিলিস্তিনিরা; কারণ তারা মনে করেন এই নিরাপত্তা সমন্বয় ফিলিস্তিন প্রতিরোধ আন্দোলনের সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক।
ট্রাম্পের আমলে নিরাপত্তা সমন্বয়ের এই বিতর্কিত নীতি অব্যাহত থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। গত মাসে হোয়াইট হাউসে ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের সঙ্গে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে মার্কিন এই প্রেসিডেন্ট বলেছিলেন, ‘তারা যৌথভাবে সুন্দর কাজ করছে।’
গাজা উপত্যকার আল-আকসা বিশ্ববিদ্যালয়ের পোস্ট কলোনিয়াল সাহিত্যের সহযোগী অধ্যাপক হায়দার এইদ বলেন, ইসরায়েলের প্রতি ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের অঙ্গীকার ও ‘তথাকথিত শান্তি প্রক্রিয়া’ মার্কিন নেতৃত্বাধীন আলোচনায় এর প্রাসঙ্গিকতা নিশ্চিত করবে। মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার নীতির যে দুটি স্তম্ভ আছে সেটি থেকে দূরে সরে গেলে ওয়াশিংটন তার দায়িত্ব হারিয়ে ফেলবে।
হায়দার এইদ এই শান্তি আলোচনাকে ‘রহস্যময়’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন; যা ইসরায়েলের ওপর যে কোনো ধরনের চাপপ্রয়োগে ব্যর্থ হয়েছে। সংক্ষেপে বললে, ফিলিস্তিনিদের আত্ম-নির্ভরশীলতাসহ মৌলিক অধিকার ট্রাম্প প্রশাসনের আলোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়নি। ফিলিস্তিন-ইসরায়েল দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধানে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের নীতি থেকে সম্প্রতি মুখ ফিরে নিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি প্রকৃত বিষয় নয়। বিশ্বের ১৩০টি রাষ্ট্র ইতিমধ্যে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়েছে। ফিলিস্তিনিরা নিজেদের আত্মনির্ভরশীলতার কথা বলছেন। সুতরাং এটি এখন আর এক অথবা দুই রাষ্ট্রের বিষয় নয়। এখন বিষয় হচ্ছে, কীভাবে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র বাস্তবায়ন করা যায়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আঞ্চলিক দেশগুলোর সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্ক জোরদার করাই ওয়াশিংটনের প্রাথমিক লক্ষ্য। এটি ফিলিস্তিনকে বাদ দিয়ে প্রতিবেশিদের সঙ্গে ইসরায়েলের শান্তি প্রক্রিয়ায় বিস্তার ঘটানোর কার্যকর প্রচেষ্টা। এই দৃষ্টিভঙ্গি ইসরায়েল-সুন্নি জোট বিস্তারের ওপর ভিত্তি করে করা হয়েছে। তবে এটি নিরেট কোনো ফল বয়ে আনবে বলে মনে হয় না। ফিলিস্তিনিদের অধিকারের মূল্যের বদলে যদি এটি করা হয় তাহলে তা অসম্ভব।
আল-শাবাকা প্যালেস্টানিয়ান পলিসি নেটওয়ার্কের ফেলো ব্যাকোনি বলেন, আমি মনে করি ট্রাম্প প্রশাসনের অধীনে হামাসের সঙ্গে বোঝাপড়ার চেষ্টা সফল হওয়ার আশা ক্ষীণ। ট্রাম্প প্রশাসনের কাছ থেকে গাজা উপত্যকার বিষয়ে খুব অল্প ধাক্কা আসতে পারে। তবে কোনো বহিরাগত শক্তির উপস্থিতি ছাড়া আন্তর্জাতিক আইন মানতে ও ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড ফিরিয়ে দিতে ইসরায়েলের ওপর চাপপ্রয়োগ করা যেতে পারে।
রোববার সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদে ৫৫ মুসলিম দেশের নেতাদের সামনে বক্তৃতা দিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি বলেছেন, মৌলবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে মুসলিমদেরকেই নেতৃত্ব দিতে হবে। জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট (আইএস), আল-কায়েদা, হেজবুল্লাহ, হামাস ও অন্যান্য জঙ্গি সংগঠনগুলোর সদস্যদের মৃত্যু শুধুমাত্র সংখ্যায় গণনা করা উচিত নয়। নিশ্চিহ্ন একটি জেনারেশনের স্বপ্নের মৃত্যু গণনা করতে হবে।
এদিকে, হামাস আন্দোলন ট্রাম্পের এ মন্তব্যকে প্রত্যাখ্যান করে বলছে, এটি ইসরায়েলের প্রতি তার সম্পূর্ণ পক্ষপাতমূলক দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট সন্ত্রাসী গোষ্ঠী বলায় এক বিবৃতিতে তা প্রত্যাখ্যান করেছে ফিলিস্তিনি ইসলামি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাস। সংস্থাটির মুখপাত্র ফাওজি বারহোম রোববার এক বিবৃতিতে ট্রাম্পের মন্তব্য প্রত্যাখ্যান করে বলেছেন, আমাদের ভাবমূর্তি বিকৃত করা হয়েছে এবং এর মাধ্যমে ইহুদিবাদী দখলদারিত্বের পক্ষ নিয়েছেন ট্রাম্প।
সূত্র : আল-জাজিরা, রয়টার্স, সিএনএন।
এসআইএস/আরআইপি