মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর আগামী শুক্রবার এই প্রথম বিদেশ সফরে বের হচ্ছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। সাত দশকের অন্যতম মিত্র সৌদি আরবে ট্রাম্পের এই সফরকে দেশটির জ্বালানি নিরাপত্তা, সাম্প্রতিক নিরাপত্তা উদ্বেগ বিষয়ে তথ্য বিনিময় ও মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের প্রভাবের বিস্তারের লাগাম টানার চেষ্টা হিসেবে দেখা হচ্ছে।
Advertisement
বিশ্বের শক্তিশালী সেক্যুলার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও একটি মৌলবাদী মুসলিম রাজতন্ত্রের সাত দশকের সম্পর্কের সংকটপূর্ণ কিছু মুহূর্ত :
সম্পর্ক নিরেট করতে যুদ্ধজাহাজের বৈঠক
আধুনিক সৌদি আরবের প্রতিষ্ঠাতা বাদশাহ আব্দুল-আজিজ আল সউদের সময় থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও আল-সউদ রাজতন্ত্রের মাঝে দ্বিপাক্ষিক কৌশলগত অংশীদারিত্বের যাত্রা শুরু হয়। ১৯৪৫ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্টের সঙ্গে সৌদি বাদশাহ ইউএসএস কুইন্সি জাহাজে সাক্ষাৎ করেন। যুদ্ধ জাহাজে এই বৈঠকের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সৌদি আরবের কূটনৈতিক সম্পর্ক আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়।
Advertisement
সুয়েজ খালে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে দুই রাষ্ট্রনেতা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ওই অঞ্চলের ইতিহাস- ফিলিস্তিনে ইহুদি রাষ্ট্র সৃষ্টি ও তেলের বিনিময়ে সৌদি আরবে মার্কিন নিরাপত্তার নিশ্চয়তায় এ দুই দেশের মাঝে দুটি চুক্তি সম্পাদিত হয়।
সৌদি তেলের ইতিহাসে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা
১৯৩৩ সালে স্টান্ডার্ড ওয়েল কোম্পানি অব ক্যালিফোর্নিয়ার সঙ্গে প্রথমবারের মতো তেল রফতানি চুক্তি করে সৌদি আরব। এর পাঁচ বছর পর সৌদি আরবের পূর্বাঞ্চলের দাম্মামে বাণিজ্যিক তেলের খনি আবিষ্কৃত হয়। ১৯৪৪ সালে দ্য অ্যারাবিয়ান আমেরিকান ওয়েল কোম্পানির যাত্রা শুরু করে; ১৯৫২ সাল পর্যন্ত এই তেল কোম্পানির প্রধান কার্যালয় ছিল নিউইয়র্কে। সৌদি সরকার ক্রমান্বয়ে এই কোম্পানিতে তাদের শেয়ার বৃদ্ধি করেছে, পরে আরামকো নামে পরিচিতি পাওয়া কোম্পানিটির পুরো মালিকানা সৌদি আরব নেয়।
ইসরায়েল এবং তেল নিষেধাজ্ঞা
Advertisement
১৯৭৩ সালে আরব সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় ইসরায়েলকে সহায়তার অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশগুলোর ওপর জ্বালানি তেল উত্তোলন ও উৎপাদনকারী দেশগুলোর জোট ওপেকের নিষেধাজ্ঞা আরোপের জেরে উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়। ওপেকের এই নিষেধাজ্ঞা যুক্তরাষ্ট্র ও বৈশ্বিক অর্থনীতিকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। একই সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্য কূটনীতি ও জ্বালানি শিল্পের ওপর দীর্ঘ-দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলে। ইসরায়েলের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখা ও আরব অঞ্চলের তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর সঙ্গে ভারসাম্য তৈরিতে কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয় যুক্তরাষ্ট্রকে।
আফগানিস্তান, সোভিয়েত ও ওসামা বিন লাদেন
১৯৭৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের দশকব্যাপী যে দখলদারিত্ব আফগানিস্তানে চলে আসছিল; সেই দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে ওঠে। আফগান আন্দোলনকারীদের প্রতি সমর্থন জানায় যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব ও পাকিস্তান। প্রতিরোধ আন্দোলনকারীদের মধ্যে সৌদি বংশোদ্ভূত ও ওই অঞ্চলের সর্ববৃহৎ নির্মাতা কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতার ছেলে আল-কায়েদার প্রধান ওসামা বিন লাদেনসহ হাজার হাজার সুন্নি মুসলিম যোদ্ধা অংশ নেয়।
সাদ্দামের কুয়েত আক্রমণ
১৯৯১ সালে কুয়েত-ইরাক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে যুক্তরাষ্ট্র। যুদ্ধের সময় সৌদি আরবে মার্কিন সেনাবাহিনীর উপস্থিতি ঘটে। কুয়েতে ইরাকি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বহুজাতিক সামরিক জোট গড়ে তোলে যুক্তরাষ্ট্র। ২০০৩ সালে সাদ্দাম হুসেইন ক্ষমতা হারানোর পর মার্কিন সেনাবাহিনী সৌদি আরব ত্যাগ করে। সেই সময় রিয়াদে মার্কিন সেনাবাহিনীর উপস্থিতি নিয়ে সৌদি শাসকের ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়। সৌদি শাসককে সমালোচনার লাগাম টানতে সহায়তা করতে রিয়াদ থেকে সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করে নেয় যুক্তরাষ্ট্র।
স্টকহোমের ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট এক প্রতিবেদনে বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সৌদি আরবের সন্ত্রাসবিরোধী সহযোগিতা উন্নত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধাস্ত্রের শীর্ষ ক্রেতা এখন সৌদি আরব।
যুক্তরাষ্ট্রে ৯/১১ হামলা
যুক্তরাষ্ট্রে ৯/১১ হামলায় অন্তত ৩ হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটে। বিমান ছিনতাইয়ের পর ১৯ জঙ্গি এই হামলায় জড়িত ছিল। এই ছিনতাইকারীদের অন্তত ১৫ জনই সৌদি নাগরিক। দুই দেশের বিশেষ সম্পর্ক তৈরি হলেও এই হামলা সৌদি-মার্কিন নাগরিকদের মাঝে প্রশ্ন তোলে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক নিয়ে। জঙ্গিগোষ্ঠী আল-কায়েদার প্রধান ওসামা বিন লাদেন পাকিস্তানে মার্কিন বিশেষ বাহিনীর অভিযানে নিহত হওয়ার আগে সৌদি আরব থেকে রাজপরিবারকে উৎখাত ও মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের আহ্বান জানায়।
বুশ বনাম সাদ্দাম
২০০৩ সালে ইরাকের ক্ষমতা থেকে সাদ্দাম হুসেইনকে হটাতে জর্জ ডব্লিউ বুশের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেন সৌদি শাসক। মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোটেও অংশ নেয়া থেকে বিরত থেকে সৌদি আরব। ইরাকে হামলা হলে তা কুয়েত সীমান্তে বিশৃঙ্খলা তৈরি করতে পারে বলে যুক্তি দেয় সৌদি। সেই যুদ্ধ এবং ইরাকের সংখ্যাগরিষ্ঠ শিয়া ও সুন্নিদের লড়াই অব্যাহত রয়েছে। এই লড়াই এখন রূপ নিয়েছে ইসলামিক স্টেটে (আইএস)।
ওবামা এবং ...
সৌদি আরবের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র এবং বিশ্বের পাঁচ শক্তিধর রাষ্ট্রের স্বাক্ষরিত পারমাণবিক চুক্তি সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার অন্যতম সফলতা হিসেবে দেখা হয়। সৌদি আরবসহ অন্যান্য তেল সমৃদ্ধ আরব উপসাগরীয় সুন্নি রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে আত্মবিশ্বাসী পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করেন ওবামা। গণতান্ত্রিক সংস্কারের লক্ষ্যে বাহরাইনে মার্কিন সেনা মোতায়েন, মিসরে আব্দুল ফাত্তাহ আল সিসিকে সমর্থন ও ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধে মার্কিন সামরিক অভিযানের সিদ্ধান্ত নেন তিনি।
সৈৗদি বিশেষজ্ঞ ও সিঙ্গাপুরের নানইয়াং টেকনোলজিক্যাল ইউনিভার্সিটির জ্যেষ্ঠ গবেষক জেমস এম ডর্সি বলেন, সেই সময় ওবামা সৌদি আরবের সঙ্গে তার দেশের সম্পর্ককে জটিল বলে মন্তব্য করলেও সৌদি আরবের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল, অন্য যে কারো চেয়ে অন্তত একটু বেশিই ভালো ওবামা।
মার্কিন-সৌদি সম্পর্কে ট্রাম্পের সংস্কারযুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবের শেষ মুহূর্তের লবিংয়ের পরও গত বছরের সেপ্টেম্বরে মার্কিন কংগ্রেস একটি বিল পাস হয়। ওই বিলে ৯/১১ হামলায় সৌদি আরবকে জড়িয়ে মামলার অনুমতি দেয়া হয়। সৌদি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ওই বিল পাসের পর জানায়, এই বিধান পাসের ফলে সার্বভৌম সম্পর্কের অবনতি ঘটাবে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। গত নভেম্বরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর ডোনাল্ড ট্রাম্প রিয়াদের সঙ্গে উষ্ণ সম্পর্কে প্রাধান্য দেন। ২০১৫ সালে ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তিকে বিপর্যয় হিসেবে মন্তব্য করেন মার্কিন এই প্রেসিডেন্ট।
সূত্র : ব্লুমবার্গ।
এসআইএস/জেআইএম