রাজধানী ও এর আশপাশের ৩৫ কিলোমিটার রেলপথে ৫৮টি লেভেল ক্রসিং রয়েছে। এর মধ্যে ২৩টির কোনো অনুমোদন নেই। যেগুলোর একেকটি যেন মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে। ঘন ঘন লেভেল ক্রসিং থাকায় নির্ধারিত গতিতে চলতে পারছে না ট্রেনগুলো।
Advertisement
কমলাপুর রেলওয়ে থানা (জিআরপি) পুলিশের অধীন এলাকায় গত সোয়া দুই বছরে ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যু হয়েছে ৮৯ জনের। এর মধ্যে চলতি বছরের চার মাসে মারা গেছেন ২২ জন। এরপরও অবৈধ লেভেল ক্রসিং বন্ধ করা এবং যাত্রী-পথচারীদের নিরাপত্তায় ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণে কোনো উদ্যোগ নেই রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের।
রেলওয়ে প্রকৌশল বিভাগ ও রেলওয়ে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জ-কমলাপুর-বিমানবন্দর রেলস্টেশন পর্যন্ত ৫৮টি লেভেল ক্রসিংয়ের মধ্যে ২৩টি অবৈধ। এছাড়া এ রেলপথে ছোট আকারের আরও প্রায় ৩০টি অবৈধ লেভেল ক্রসিং রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ গেন্ডারিয়া, মগবাজার, কুড়িল ও উত্তরার লেভেল ক্রসিং।
দুই বছর আগে কুড়িল বিশ্বরোড লেভেল ক্রসিংটি সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেয়া হয়। গত বছরের এপ্রিলে লেভেল ক্রসিংটির দুই পাশে ১০ ফুট উঁচু ইট-পাথরের দেয়ালও নির্মাণ করা হয়। এরপরও পথচারীরা অবৈধভাবে দেয়ালের মধ্যে পকেটগেট তৈরি করে পারাপার হচ্ছেন।
Advertisement
রেলওয়ে ও থানা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের ২৭ জানুয়ারি দুপুরের দিকে রাজধানীর কুড়িল বিশ্বরোড এলাকায় লেভেল ক্রসিংয়ে লাইন মেরামত করছিলেন কর্মী বাদল মিয়া (৫৩)। ওই সময় সিলেট থেকে ঢাকাগামী সুরমা এক্সপ্রেস ট্রেনে কাটা পড়তে যাচ্ছিলেন এক মা ও তার শিশুসন্তান। বাদল মিয়া দৌড়ে গিয়ে শিশু ও তার মাকে বাঁচান। কিন্তু রক্ষা হয়নি বাদল মিয়ার। ট্রেনে কাটা পড়ে ঘটনাস্থলে প্রাণ হারান তিনি।
বন্ধ করে দেয়া এ কুড়িল লেভেল ক্রসিংয়ে ট্রেনে কাটা পড়ে সোয়া দুই বছরে মারা গেছেন ৩৬ জন।
২৯ জানুয়ারি রাজধানীর খিলক্ষেত ও বনানীতে ট্রেনে কাটা পড়ে মিলনা আক্তার (৩৫) নামে এক নারীসহ দুজনের মৃত্যু হয়। ৬ মার্চ রাজধানীর বিমানবন্দর রেলস্টেশনের পাশে ট্রেনে কাটা পরে প্রাণ হারান আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) কনস্টেবল বেল্লাল উদ্দিন (৩৫)।
গত ২ এপ্রিল রাজধানীর ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় রেললাইনের ওপর দিয়ে হেডফোনে কথা বলতে বলতে যাওয়ার সময় ট্রেনে কাটা পড়ে অজ্ঞাত ব্যক্তি মারা যান। ৬ এপ্রিল রাজধানীর কারওয়ানবাজার এলাকায় ট্রেনে কাটা পড়ে মারা যান অজ্ঞাত পরিচয় (৪৫) আরও একজন।
Advertisement
৯ এপ্রিল সকালে রাজধানীর বিমানবন্দর রেলস্টেশনে ট্রেনের নিচে কাটা পড়ে আফাজ উদ্দিন (৫০) নামে এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়। ১৩ এপ্রিল আরিফ (২৬) নামে এক যুবক কুড়িল বিশ্বরোডের রেল ক্রসিংয়ে কাটা পড়ে মারা যান। ১৮ এপ্রিল (মঙ্গলবার) গাজীপুরে পৃথকভাবে ট্রেনে কাটা পড়ে মা ও তার শিশুসন্তানসহ তিনজনের মৃত্যু হয়।
সম্প্রতি সরেজমিনে কুড়িল বিশ্বরোড সংলগ্ন রেলক্রসিং এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, লেভেল ক্রসিংটির দু’পাশে ‘এই রেলক্রসিং দিয়ে যানবাহন ও লোক পারাপার সম্পূর্ণ নিষেধ’ লেখা রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের টাঙানো সাইনবোর্ড রয়েছে। তবুও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পারাপার করছেন পথচারীরা।
উত্তরা হয়ে আসা রেলের লাইন প্রায় ৪০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে বাঁকা। অন্যদিকে ক্যান্টনমেন্ট থেকে কুড়িল ফ্লাইওভারের নিচের লেভেল ক্রসিং পর্যন্ত লাইনটি প্রায় ৫০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে বাঁকা। যে কারণে ট্রেন এলেও কুড়িলের অবৈধ লেভেল ক্রসিং থেকে তা দেখা যায় না।
রেললাইনের পাশে ফ্লেক্সিলোড দোকানদার হাসান। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, প্রতিদিন এ পথ দিয়ে যাতায়াত করেন লাখ মানুষ। রেল কর্তৃপক্ষ লেভেল ক্রসিংটি উঠিয়ে নেয়ার পর এ পথ দিয়ে মানুষের যাতায়াত বন্ধে উঁচু প্রাচীর নির্মাণ করা হয়। কিন্তু মানুষের যাতায়াত বন্ধ হয়নি। প্রাচীর কেটে পকেট বানিয়ে পথচারীরা ঝুঁকি নিয়ে যাতায়াত করছেন।
মানিক নামে রেলগেটের এক কর্মচারী জাগো নিউজকে বলেন, দুই বছর আগে এ গেট বন্ধ করে দেয়া হয়। কিন্তু রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ এখানে কোনো ফুটওভারব্রিজ নির্মাণ করেনি। সিটি কর্পোরেশন কিংবা রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ কেউ উদ্যোগ নেয়নি। যে কারণে ঝুঁকি নিয়ে পারাপার হতে গিয়ে ট্রেনে কাটা পড়ে মারা যাচ্ছেন অনেকে।
রেলওয়ের প্রকৌশল বিভাগের মিস্ত্রি মো. আবু হানিফ জাগো নিউজকে বলেন, মানুষ প্রয়োজনের তাগিদে পকেটগেট চালু রেখেছে। সিটি কর্পোরেশন শোভাবর্ধনের কাজ করলেও জীবন বাঁচানোর জন্য একটি ফুটওভারব্রিজ নির্মাণে এগিয়ে আসেনি।
ঢাকা রেলওয়ে থানার ওসি ইয়াসিন ফারুক জাগো নিউজকে বলেন, কুড়িল বিশ্বরোডের বন্ধ লেভেল ক্রসিং এবং এর আশপাশ দিয়ে পারাপারের সময় প্রতি সপ্তাহে দুর্ঘটনা ঘটছে। গত তিন সপ্তাহে শুধু ওই এলাকায় সাতজনের মারা যাওয়ার খবর পেয়েছি।
তিনি বলেন, রেলওয়ে আইন অনুযায়ী রেললাইনের দুই পাশে ১০ ফুট করে মোট ২০ ফুট এলাকায় সবসময় ১৪৪ ধারা জারি থাকে। রেলওয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ছাড়া যে কেউ এ এলাকায় পা রাখলেই অপরাধী হিসেবে গণ্য হবেন। কিন্তু কেউ আইনটি মানছেন না। ৭নং রেলওয়ে স্টেশন প্ল্যাটফর্মের পূর্বদিকের দেয়াল ভেঙে পকেট গেট করা হয়েছে।
‘মানুষের নিরাপদ পারাপারের জন্য প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ লেভেল ক্রসিং এলাকায় ফুটওভারব্রিজ নির্মাণ করা উচিত। তাহলে মানুষ ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার করবে। দুর্ঘটনাও ঘটবে না’- বলেন রেলওয়ে থানার ওসি ইয়াসিন ফারুক।
বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রধান পরিকল্পনাবিদ আনোয়ারুল হক জাগো নিউজকে বলেন, রেলওয়ের লেভেল ক্রসিং উন্নয়নে এ মুহূর্তে দুটি প্রজেক্টের কাজ চলছে। তবে ফুটওভারব্রিজ নির্মাণের দায়িত্ব রেলওয়ের নয়। এটি নির্মাণের দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট পৌরসভা, জেলা প্রশাসক ও সিটি কর্পোরেশনের।
জেইউ/এমএআর/এমএস