জীবিকার প্রয়োজনই মানুষের পেশা। আমাদের সমাজের ভীষণ ব্যস্ততম পেশার অন্যতম একটি হলো চিকিৎসা সেবা। নারী-পুরুষ উভয়কেই এই পেশাতে করতে হয় ভয়ানক পরিশ্রম। তবে পুরুষদের তুলনায় নারীদের শ্রম দিতে হয় কয়েক গুণ বেশী। কারণ বাঙালি সমাজ এখনো পশ্চিমা সমাজের মতো নয়। কর্মজীবী নারীদেরকে বাঙালি সমাজে এখনো পুরুষের সমান মর্যাদা দেয়া হয় না। আর যারা গৃহিনী, তারা এখনো যথেষ্ট অবহেলিত। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা পুরুষের মতো গুরুত্ব পাচ্ছেন না; যা কখনোই কাম্য নয়।
Advertisement
আমাদের চিকিৎসা ক্ষেত্রে কয়েক বছরের তুলনায় অনেক নারীরা এগিয়ে এসেছেন। এখনকার বাবা মায়েরা তাদের সন্তানদের প্রতি যথেষ্ট মনোযোগী। পরিণামে বাবা মায়েরা মেয়ে সন্তানের কর্মজগতের প্রতি পূর্বের তুলনায় যথেষ্ট সচেতন হয়েছেন। এই জন্য কয়েক বছরে নারী চিকিৎসকের সংখ্যা সন্তোষজনক হারে বেড়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, একজন নারী যখন শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছেন, তখন চিকিৎসক হবার জন্য পরিবার থেকে সব সময় সুযোগ সুবিধা পাচ্ছেন না। এমন যথেষ্ট উদাহরণ আমাদের সমাজে রয়েছে।
চিকিৎসা এমন একটা পেশা যেখানে বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত কঠিন লেখাপড়া করতে হয়। শুধু এমবিবিএস হলেই হয় না। নির্দিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হবার জন্য এমবিবিএস এর পরেও প্রতিনিয়ত পড়ালেখার মধ্যেই থাকতে হয়। চরম এই বাস্তবতাটাকে মেনে নেয়া ভীষণ কঠিন। সব পরিবারের সবাই এই বিষয়টা মানতে পারেন না। কারণ, আমাদের দেশে এখনো ঘরের কাজগুলোতে নারী-পুরুষের সমান অশংগ্রহণ নিশ্চিত হয়নি। যতোদিন পর্যন্ত নারী পুরুষের সমান অধিকার নিশ্চিত হবেনা, ততোদিন পর্যন্ত নারীরা পুরুষের তুলনায় অনেক পিছিয়েই থাকবে।
আমাদের দেশের মেডিকেলের শিক্ষা ব্যবস্থা পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে, নারী চিকিৎসকেরা পুরুষ চিকিৎসকের তুলনায় এখনো পেছনে রয়েছে। কারণ, হসপিটালের ডিউটি, পারিবারিক কাজের পর একজন নারী চিকিৎসক লেখাপড়া করার সঠিক সময় পাচ্ছেন না। শ্বশুরবাড়ির কাজ, সন্তান লালন পালনের পর লেখাপড়ার জন্য সময় বের করাটা ভীষণ কষ্টকর। আর চিকিৎসা সেবা এমনই এক পেশা যে, যতো বেশি ডিগ্রি নেয়া যাবে, ততোই উপকার। চিকিৎসকদের পড়ালেখা করতেই হবে। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে এমবিবিএস ডিগ্রি নেয়ার পর পোস্ট গ্রাজুয়েশন এমএস, এফসিপিএসসহ বিভিন্ন ধরনের ডিগ্রি রয়েছে। যা ভীষণ সময় সাপেক্ষ ও কঠিন।
Advertisement
পোস্ট গ্রাজুয়েশন ছাড়া একজন চিকিৎসক কখনোই নির্দিষ্ট একটি বিষয়ে দক্ষ হতে পারেন না। নির্দিষ্ট বিষয়ের উপরে (যেমন গাইনী, মেডিসিন, সার্জারি ইত্যাদি) বিশেষজ্ঞ হবার জন্য একজন চিকিৎসককে এমবিবিএস এর পরেও আবারো পড়তে হয়। আর এই পড়ালেখার জন্য পরিবারকে যথেষ্ট বিসর্জন দিতে হয়। এই বিসর্জনের জন্য পরিবারের সবার যথেষ্ট সহযোগিতা দরকার। শুধু স্বামী নয়, পরিবারসহ আত্মীয় স্বজনদেরও বুঝতে হবে যে, একজন নারী চিকিৎসককে একই সাথে সংসার, লেখাপড়া, চাকরি সমলাতে হয়। যা ভীষণ কঠিন।
পুরুষ চিকিৎসকদেরও ভয়ানক কষ্ট করতে হয়। আমাদের দেশে ঘরের কাজগুলো এখনও নারীদের জন্যই বরাদ্দ। পুরুষদেরও রান্না করতে হবে, ঘর পরিষ্কার করতে হবে, এমনটি নয়। তবে বাসার কাজগুলোতে স্ত্রী বা মাকে সহযোগিতা করলে, জীবনটা আরো অনেক সুন্দর হবে। উপার্জন করাটা যেমন ভয়ানক কষ্টের, ঘরের কাজগুলোও কখনোই ফেলনার নয়।
আমাদের বুঝতে হবে, চিকিৎসা বিদ্যা যথেষ্ট কঠিন। এই পেশার লেখাপড়ার সাথে সরাসরি জড়িয়ে থাকে মানুষের জীবন। তাই পুরুষ চিকিৎসকেরা লেখাপড়া ও তাদের ক্যারিয়ার গড়ে তোলার জন্য পরিবার থেকে যে সুযোগ-সুবিধা পায়, একজন নারী চিকিৎসকেরও দরকার সেই রকম পরিবেশ। আর রাতে ডিউটি একটি সচরাচর সমস্যা। এখনও অনেক পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়-স্বজনেরা বিরক্ত হন রাতে হাসপাতালে ডিউটির জন্য। কিন্তু একজন চিকিৎসকের জন্য রাতে হাসপাতালে ডিউটি পেশার এক অপরিহার্য অংশ। অনেক হাসপাতালের পরিবেশ ও নিরাপত্তা বিশ্বাসযোগ্য থাকেনা। এই জন্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে পরিবেশবান্ধব পদক্ষেপ নেয়াটা ভীষণ জরুরি।
প্রতিটি কর্মজীবী নারীর জন্য চাই কর্মজগতের নিরাপত্তা ও পারিবারিক সহযোগিতা। পারিবারিক আস্থা, বিশ্বাস ও বিসর্জন ছাড়া একজন নারী চিকিৎসকের জন্য সফল হওয়াটা ভয়াবহ কঠিন নারী পুরুষের সমান সফলতার জন্য পশ্চিমা দেশগুলো আজ অনেক উন্নত। নারী চিকিৎসককে পুরুষ চিকিৎসকের মতো সামাজিক মর্যাদা ও পারিবারিক সুযোগ পাবার জন্য চাই মানবিক মূল্যবোধ। চাই পুরো সমাজ ব্যবস্থার দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। নারী পুরুষের সমান অধিকার নিশ্চিত হোক। বর্তমানে বাংলাদেশের স্ত্রী ও প্রসূতি বিদ্যা বিভাগ মানেই নারীদের জয় জয়কার। শুধু গাইনি (স্ত্রী ও প্রসূতি বিদ্যা বিভাগ) নয় অন্যান্য সকল বিভাগে সফল অবস্থান হোক নারী চিকিৎসকদের।
Advertisement
নারী ও পুরুষ চিকিৎসকের সমান সফলতায় এগিয়ে যাক বাংলাদেশ।
লেখক : চিকিৎসক।
এইচআর/জেআইএম