মতামত

ভাগ্যবিড়ম্বিত এক যুদ্ধশিশু : মনোয়ারা ক্লার্ক

মনোয়ারা ক্লার্ক এক ভাগ্যবিড়ম্বিত নাম। একজন যুদ্ধশিশু, একজন যুদ্ধাহত শিশু। ১৯৭১ সাল থেকে ২০১৭ সাল। এই ৪৬ বছরের পথচলায় আজ বড্ড ক্লান্ত। কথা বলছিলাম স্বাধীনতা যুদ্ধের দুঃসহস্মৃতি বয়ে বেড়ানো এক যুদ্ধশিশুর সাথে। তার চোখে ছিলো স্বপ্ন, বুকে দীর্ঘশ্বাস আর মুখে শেকড়ের সন্ধান খুঁজে পাবার ব্যাকুলতা।

Advertisement

কোথায় তার জন্ম হয়েছিলো? কে তার বাবা? কে তার মা? এসব প্রশ্নের কোন উত্তর নেই তার কাছে। বুঝতে শেখার পরই তিনি তার শরীরের পেছনের দিকে লম্বা একটি জন্মদাগ দেখতে পান। ব্যাকুল আগ্রহ নিয়ে তিনি তার দত্তক বাবা মি.ক্লার্ক ও মা হেনরি ক্লার্কের কাছে প্রশ্ন করেন- ‘‘বাবা এটা কিসের দাগ? মা এটা কিভাবে হলো?” তখন তাকে বলা হয়-‘‘এদেশ তোমার নয়, বাংলাদেশে তোমার জন্ম। তোমার গর্ভধারিণী মাকে নির্মম নির্যাতনের পর পাকিস্তান বাহিনী বেয়নেট দিয়ে শরীরে ক্ষত-বিক্ষত করে দিয়েছিল। মায়ের গর্ভে থাকাবস্থায় তুমিও বেয়নেটের আঘাত পেয়েছিলে। পুরনো ঢাকার কোন এক গলির ধারে তোমার জন্ম হয়েছিল। তারপর মানবতা সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবীরা আজিমপুর হোমসে নিয়ে যায় তোমাকে। সেখানে ঠাঁই হয় তোমার। পালিত মা-বাবার মুখে উত্তরটা তার কোমল হৃদয়ে জন্মগত বেয়নেটের আঘাতের চাইতেও যেন বেশি যন্ত্রণা দিয়েছিলো।

সকলের শৈশব যতটা রঙিন হয়, মনোয়ারা ক্লার্কের শৈশব ছিলো ততটাই ধূসর। ছিপছিপে গড়নের শ্যামবর্ণের মনোয়ারা যেন সাদা চামড়াওয়ালাদের সাথে বড্ড বেমানান। মনোয়ারা ক্লার্কের নতুন পরিবেশে ঠাঁই হলেও, তার ছিলো না নতুন পরিবেশে আপন করে নেবার মত কোন সহপাঠী কিংবা কোন খেলার সাথী। আবারও ঘটে ভাগ্য বিড়ম্বনা। ১৩ বছর বয়সে মি.ক্লার্ক ও হেনরি ক্লার্কের মধ্যে ঘটে বিবাহ-বিচ্ছেদ। ফলে সেখানে তার অনিশ্চিত জীবন শুরু হয়। তখন তাকে আপন করে বুকে তুলে নেন মার্গারেট নিকল নামের এক ভদ্র মহিলা। তারা নিজের সন্তানের মতো মনোয়ারাকে মায়া, মমতা ও ভালোবাসা দিয়ে বড় করে তুলেন। নানা চড়াই উৎরাই পাড়ি দিয়ে কানাডার একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নার্সিং বিষয়ে গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করে চাকরি নেন একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে। ২০০২ সালে বিয়ে হয় ফিনল্যান্ডের এক অধ্যাপকের সঙ্গে। তাদের কোলে জন্ম নেয় কন্যা সন্তান জুলিয়েট। কিন্তু সুখটা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। জন্মপরিচয় না থাকায় মনোয়ারাকে শুনতে হয় নানা ধরনের কটুকথা, সইতে হয় নানা গঞ্জনা। তাকে নানাভাবে মানসিক নির্যাতন করা হয়। অতঃপর তাদের মাঝেও ঘটে বিবাহ-বিচ্ছেদ। ভাগ্য যেন বারবার তার সাথেই পরিহাস করতে থাকে।

শুরু করেন নতুন এক সংগ্রাম। তাকে খুঁজে পেতেই হবে তার শেকড়ের সন্ধান। আঁতি-পাঁতি খুঁজে ফেরেন জন্মের ইতিহাস। খুঁজে ফেরেন আত্মপরিচয়। ইন্টারনেট ঘেঁটে বাংলাদেশের নানা তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করতে থাকেন। তিনি খুঁজে পান বাংলাদেশ মানেই লাল-সবুজের পতাকা। ছোট্ট এ দেশটির অভ্যুদয় দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে। শহীদ হয়েছেন ত্রিশ লক্ষ স্বাধীনতাকামী বাঙালি। অগণিত মা-বোনকে হারাতে হয়েছে নিজের সম্ভ্রম। অবশেষে রক্তের সিঁড়ি বেয়ে এসেছে কাঙ্খিত স্বাধীনতা, অর্জিত হয়েছে বাঙালির অধিকার।

Advertisement

দীর্ঘ সময় পার হয়েছে। পরিবর্তন ঘটেছে সবকিছুরই। হয়তো মাকে আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। তার মায়ের মুখায়বও মনে নেই। তবে আপন মনের ক্যানভাসে মায়ের মুখ আঁকতে চেয়েছেন বহুবার, এঁকেছেনও নিজের মতো করে। প্রতিবারই ভেসে উঠেছে কোন না কোন অসহায় এবং নির্যাতিত মায়ের মুখ। নির্যাতিত মায়ের মুখ দেখলেই তাকিয়ে থাকেন অপলক নয়নে আর ভাবেন হয়তো তার মা এমনটাই ছিলেন। তিনি মায়ের ভিটার ধুলা নিতে চান। দেখতে চান কোন জায়গাটায় জন্মেছিলেন তিনি। মনোয়ারা ক্লার্কের বিশ্বাস এতে পিপাসার্ত হৃদয় একটু হলেও শান্তি পাবে।

নিজেকে যুদ্ধশিশু ভেবে খুব গর্ববোধ করেন। গর্বটা মনোয়ারার নিজের জন্য নয়। এই ভেবে গর্ববোধ করেন যে, তার মা এদেশ স্বাধীন করার জন্য নির্যাতিত হয়ে জীবন উৎসর্গ করেছেন। সে দিক দিয়ে তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। পাকিস্তান বাহিনীর নির্মম অত্যাচারের জন্ম দাগ নিয়ে বেঁচে আছেন মনোয়ারা ক্লার্ক। নিজের জন্য তার দুঃখ নেই। শুধু কষ্ট লাগে সেই নির্যাতিত মায়ের জন্য। যাকে সহ্য করতে হয়েছে পিশাচদের নির্মম নির্যাতন। মনোয়ারা ক্লার্কের এখনও দুচোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে নির্যাতিত সেই মায়ের কথা ভেবে। যার গর্ভে তার জন্ম হয়েছিল,তাকে নিয়ে মায়ের হয়তো অনেক কষ্ট করতে হয়েছে এই দুঃসহ কল্পস্মৃতিতে মনোয়ারা ক্লার্ক কখনো কখনো আনমনা হয়ে পড়েন।

ভিন্ন দেশে ভিন্ন পরিবেশে বড় হয়েছেন তিনি। যদিও পাশ্চাত্য সভ্যতায় বেড়ে উঠেছেন। কিন্তু কানাডার জৌলুসতা তাকে কখনো প্রশান্তি এনে দিতে পারেনি। মনের কোণে লালন করেন বাঙালি ও বাংলাদেশের প্রতি ভালোবাসা। বাংলাদেশের গৌরবময় ইতিহাস, এদেশের সংস্কৃতি, সবুজ-শ্যামলিমা প্রকৃতি তাকে বারবার ইশারায় টানে। তাই তার আকুল আকুতি ছিলো বাংলাদেশি জন্মসনদ লাভের। যাতে তিনি বলতে পারেন বাংলা মায়েরই সন্তান। তিনি বাংলাদেশি পরিচয়েই বাকিটা জীবন কাটাতে চান। অবশেষে তার লড়াই, তার সংগ্রাম সার্থকতা পেয়েছে। পেয়েছেন বাংলাদেশি জন্মসনদ পত্র। প্রমাণ করেছেন হার না মানার নামই জীবন।

মনোয়ারার ক্লার্কের মনে বাংলাদেশকে নিয়ে চাপা ক্ষোভ ও ভালোবাসা দুটোই রয়েছে। হানাদার মুক্ত হওয়ার পর এদেশ কেন সমাজের শুদ্ধতা বজায় রাখতে যুদ্ধশিশুদেরকে বিতাড়িত করা হয়েছিলো? তারা তো বাংলাদেশেরই সন্তান। শুধু সন্তানই নয়, এই দেশের রক্তাক্ত জন্ম ইতিহাসে যুদ্ধ শিশুরাও এক গৌরবগাথা। অথচ এই সমাজে যুদ্ধ শিশুরা অবাঞ্ছিত-অবহেলিত। আর যারা দেশের জন্য সম্ভ্রম হারালো সেই সব বীরাঙ্গনারা হলো ধিকৃত-ঘৃণিত। মনোয়ারাদের মতো যুদ্ধ শিশুদের ঠাঁই হলো না স্বাধীন বাংলাদেশে। যাদের রক্তে, যাদের সম্ভ্রমের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন হলো, তারা হলো নির্বাসিত! এই সব দুঃখ বেদনা নিয়ে ঘুরে ফিরে মনোয়ারা ক্লার্কের মতো হাজারো যুদ্ধ শিশু।

Advertisement

মনোয়ারা ক্লার্ক ভুলতে পারেননি নাড়ির টান। জন্মস্মৃতি বাংলাদেশ তার স্বপ্নের দেশ। বাংলাদেশকে নিয়ে তার অনেক স্বপ্ন। কেননা, বাংলাদেশ একটি সম্ভবনাময় দেশ। যে দেশের মানুষ স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসেন, স্বপ্নকে লালন করেন, স্বপ্ন বুকে ধারণ করে বেড়ে ওঠেন। এ দেশের স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে হলে, এদেশকে নিজের মনে করে ভালোবাসতে হবে। দেশ গড়ার পেছনে শ্রম দিতে হবে। মানুষে-মানুষে ভেদাভেদ ভুলে সম্প্রীতি গড়ে তুলতে হবে সুখী সুন্দর বাংলাদেশ। তবে এত রক্ত, এত ত্যাগ সার্থক হয়ে স্বপ্নের দেশ বাংলাদেশ বিশ্ব দরবারে মাথা উচু করে দাঁড়াতে পারবে। কিন্তু মনোয়ারা ক্লার্ক আক্ষেপ করে বলেন- ‘বাংলাদেশের মানুষই এদেশকে অবহেলা করে। এ দেশের যারা উচ্চ শ্রেণির তারা তাদের সন্তানকে বিদেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে। মেধাবীরা উচ্চ বেতনের আশায় এদেশ ছেড়ে বিদেশ চলে যাচ্ছে। তাহলে দেশকে এগিয়ে নেবে কারা? মনোয়ারার মনে এমনি হাজারো প্রশ্ন ভীড় করে আছে। কে দেবে সেসব প্রশ্নের জবাব?

লেখক : ছড়াকার ও লেখক।

এইচআর/পিআর