সাহিত্য

গফুর হালী : লোকসঙ্গীতের এক নিভৃতচারী

বাংলা ভাষার ইতিহাসের মতো বাংলা গানের ইতিহাসও হাজার বছরের পুরনো। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক বিবর্তনের অন্যতম সমৃদ্ধ ভাণ্ডার বাংলার চিরায়ত লোকসঙ্গীত। আমাদের এই ভাণ্ডার প্রতিনিয়ত সমৃদ্ধ করে গেছেন এমন অনেক আধ্যাত্মিক ও মরমী সাধক, যাদের জীবনকালে আমরা তাঁদের অবদান মূল্যায়ন করতে পারিনি। অফুরান প্রাণশক্তি, বহুমুখি প্রতিভার অধিকারী, ৮৫ বছর বয়সেও গান গেয়ে এবং লিখেই যিনি সংসারের খরচ যোগাতেন, এবং ভাবতে ভালোবাসতেন বয়সে বৃদ্ধ হলেও তাঁর মনের বয়স বিশ কিংবা বাইশ, তিনি আমাদের চট্টগ্রামের মরমী গানের শিল্পী এবং গীতিকার, সুরকার এবং নাট্যকার আব্দুল গফুর হালী।

Advertisement

বেশ কিছুদিন ফুসফুসে ক্যান্সারে ভোগার পর চটগ্রামের একটি হাসপাতালে গত বছরের ২১ ডিসেম্বর  ৮৯ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এই গুণী শিল্পী । আমরা অবহেলায় হারালাম একজন মরমী গানের অসাধারণ কিংবদন্তী দিকপালকে। আমরা অনেকেই এখনো তাঁর নাম না জানলেও তার লেখা গান গেয়ে গেয়ে আমরা বড় হয়েছি। ‘পাঞ্জাবীওয়ালা’, ‘সোনা বন্ধু তুই আমারে করলি দিওয়ানা’, ‘মনের বাগানে ফুটিল ফুলরে’, ‘বানুরে ও বানু’- এই গানগুলো বাংলাদেশের কোন মানুষ শোনেননি অথবা একান্তে গুন-গুনিয়ে গাননি তা নিতান্তই অবিশ্বাস্য।

গফুর হালী আমাদের লোকসঙ্গীতের ভাণ্ডারে একটি প্রতিষ্ঠান ছিলেন। তাঁর এই অসামান্য মেধার পরিচয় পাওয়ার আগেই তাঁকে হারিয়ে ফেলেছি। অসাধারণ বহুমুখি প্রতিভার অধিকারী এই গুণী মানুষটি ১৯২৯ সালের আগস্ট মাসে জন্মেছিলেন চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার রশিদাবাদ গ্রামে। তাঁর পিতার নাম আব্দুস সোবহান এবং মাতার নাম গুলতাজ খাতুন। রশিদাবাদ প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করলেও তিনি ছিলেন স্ব-শিক্ষায় শিক্ষিত। কিন্তু অবাক করা বিস্ময় হচ্ছে অসম্ভব প্রতিভাবান এই গীতিকার ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। জন্মসূত্রে তিনি বেড়ে ওঠেন বিখ্যাত পুঁথি সংগ্রাহক ও সম্পাদক-লেখক আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ এবং পুঁথি ও সংগীত রচয়িতা আস্কর আলী পণ্ডিতের ভাব সংগীতের আবহে। তাই একেবারে ছোটবেলা থেকেই তাঁর ভেতর রোপিত হয়ে গেছে ভাব সংগীতের সুর-বাণীর ভাবধারা।

গফুর হালীর জীবন ও গান নিয়ে গবেষণা করেছেন জার্মানির হালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারতবর্ষ বিষয়ক দর্শন শাস্ত্রের সহকারী অধ্যাপক বিশিষ্ট ভাষা তাত্ত্বিক হান্স হারডার। ২০০৪ সনে `ডার ফেরুকটে গফুর স্প্রিখট` বাংলায় যার অর্থ পাগলা গফুর, নামের একটি গবেষণা গ্রন্থ প্রকাশ করেন, যেখানে তার সৃষ্ট ৭৬টি মাইজভান্ডারি গান জার্মান ভাষায় অনুবাদ করা হয়। অধ্যাপক হান্স হারডার আব্দুল গফুর হালী সম্পর্কে বলেন ``তাঁর উচ্চ ডিগ্রি বা উপাধি না থাকলেও নিজের চেষ্টায় তিনি অসাধারণ জ্ঞানের অধিকারী হতে সক্ষম হয়েছেন।``

Advertisement

ছোটবেলা থেকে শেফালী ঘোষ আর শ্যামসুন্দর বৈষ্ণব এর গান শুনেছি রেডিও এবং মায়ের মুখে। বড় হয়ে শুনেছি প্রিয় শিল্পী শিরিন যাওয়াদির কণ্ঠে। কিন্তু আমরা জানিনা এই নেপথ্যের প্রতিভাধর মানুষটিকে। যার লেখা গান গেয়ে বড় হয়েছে অনেক বড় মাপের সংগীত শিল্পীরা। অসম্ভব আবেগ আর অজ্ঞতার অপরাধ বোধ থেকে তার বিষয়ে জানার আগ্রহ থেকে বেশ কয়েকটি লিংকে তার সাক্ষাৎকার দেখেছি এবং পড়েছি। সে সূত্রে জানতে পেরেছি যুগের সাথে তাল মিলিয়ে রিমেক গানে তার আপত্তি না থাকলেও গানের কথা ও সুর বিকৃত করার ব্যাপারে তিনি বিক্ষুব্ধ এবং প্রতিবাদী। এ ব্যাপারে ঘোরতর আপত্তি জানিয়ে তিনি তাঁর গানের সুর এবং কথার স্বকীয়তা বজায় রাখার ব্যাপারে সকলকে দায়িত্বশীল হতে অনুরোধ করেন।

লালনের জাতের সাথে একাত্ততা জ্ঞাপন করে নিজের কণ্ঠে হার্মোনিয়াম বাজিয়ে অসাম্প্রদায়িক চেতনা, প্রেম ও সর্বজনীনতা নিয়ে গাইছেন `লালনের যে জাত ছিলো আমিও সেই জাতী `। তার গানের প্রতিটি শব্দ ও লাইনে মানুষের প্রতি প্রেম এবং স্রষ্টার প্রতি ভক্তি ও আধ্যাত্মিকতার পরম পূর্ণতার কথাই যেনো বার বার উচ্চারিত হয়েছে। ভক্তিই যেন তাঁর গানের প্রধান বিষয়বস্তু। তিনি মনে করেন স্রষ্টাকে পাওয়ার সহজ পথ হচ্ছে সংগীত।

আব্দুল গফুর হালী ১৯৭০-এর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর সামনেই গান গেয়ে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর পক্ষে জাগরণী গান গেয়ে প্রচারণা চালিয়েছিলেন । গানটি ছিলো `মুজিবের নৌকা পাল তুলে ছুটেছে কর্মুণফুলীর দিকে` । তিনি সরাসরি রণাঙ্গনে যুদ্ধ করেননি, তবে ক্যাম্পে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে এবং পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে বিদ্রূপ এবং ঘৃণা নিক্ষেপ করে গান গাইতেন। উদ্দীপ্ত করতেন, প্রেরণা যোগাতেন মুক্তিযোদ্ধাদের । মুক্তিযোদ্ধারা হালীর একটি গান খুব পছন্দ করতেন, গানটি হচ্ছে : ‘তোর লয় আঁর লয় ন অইব অভাই আঁই বাঙালি, তুই পাঠানতোর দেশে আর আঁর দেশে দুই হাজার মাইল ব্যবধান,কোন সাধনে তাঁরে পাওয়া যায় ।’

`মোহছেন আউলিয়ার গান` নামে চট্টগ্রামের লোকসঙ্গীতে একটি স্বতন্ত্র সঙ্গীতধারারও স্রষ্টা তিনি। সেইসাথে তিনি মাইজভাণ্ডারী গানেরও স্রষ্টা। অনেকের মতে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের তিনি অন্যতম প্রতিভূ। শুধু গান রচনাই নয়, প্রায় ছয় দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি গানের সুর করেছেন এবং চট্রগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় নাটক রচনা করেছেন। বলা হয়ে থাকে চট্রগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় মাইজভাণ্ডারী, মুর্শিদি, মারফতি প্রভৃতি ধারায় প্রায় আড়াই হাজারের অধিক গান রচনা করেছেন তিনি। তাই চট্টগ্রাম অঞ্চলে সঙ্গীত রচনায় এ পর্যন্ত কেউ আব্দুল গফুর হালীকে অতিক্রম করতে পারেনি।

Advertisement

আমাদের দেশে সত্তুর ও আশির দশক ছিল আঞ্চলিক ও মাইজভাণ্ডারি গানের এক যুগান্তকারী শ্রেষ্ঠ সময়। সে সময়ে রচিত হয়েছে অসংখ্য জনপ্রিয় গানের ভাণ্ডার। যা শুধু চটগ্রামকে নয়, বাংলাদেশের লোক সঙ্গীতকে নিয়ে গেছে এক অনন্য উচ্চতায়। মাইজভাণ্ডার গানের এই দর্শন আর সুরের মাধ্যমে তিনি আমাদের দিয়েছেন এক অসাম্প্রদায়িক শক্তির চেতনা,যা মানুষের সাথে মানুষের জাত-পাত ভুলে যাওয়ার প্রেরণা যোগায়। পঞ্চাশের দশক থেকে শুরু করে জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত এই গান গুলোর দ্বারা তিনি মানুষের মাঝে গেঁথে দিয়েছেন ভালোবাসার এক অলৌকিক বন্ধন।

আমরা আমাদের প্রিয় শিল্পীর গান গেয়ে সারাদিন গুন গুন করি। আর শিল্পীরা বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। শেফালী ঘোষ আর শ্যাম সুন্দর বৈষ্ণব হয়েছেন চট্টগ্রামের কিংবদন্তি শিল্পী। কিন্তু তাঁদের গাওয়া অসাধারণ এই গানের পেছনের অসাধারণ গীতিকার কে সে খবর আমাদের জানা নেই। আমরা জানতে চাইওনা। এটিই হলো আমাদের সমাজ সংস্কৃতির ধারা। যাদের হৃদয় নিঃসৃত সৃষ্টি শিল্পীর কণ্ঠে ধ্বনিত হয়ে অসাধারণ হয়ে ওঠে আমরা তাঁদের খোঁজ রাখিনা। ঠিক এমনটিই করেছিলাম শাহ আব্দুল করিম এর বেলায়। এই গুণীজনেরা অগোচরে আমাদের ঐশ্বর্যবান করে দিয়ে চলে যান লোক চক্ষুর অন্তরালে।

আমাদের সময় নেই জানার যে তাঁরা দু`বেলা খেতে পারছেন কিনা বা তাঁরা কোন কঠিন রোগে আক্রান্ত কিনা। গফুর হালীর জীবনের প্রথম গান `আর কতোদিন খেলবি খেলা মরণ কি তোর হবেনা, আইলো কতো গেলো কতো কোথায় তাহার ঠিকানা’। তাঁর শরীর হয়তো মরণের তরী বেয়ে ওপারে চলে গেছে, কিন্তু যে সম্পদ তিনি আমাদের দিয়ে গেছেন তাঁর যথাযথ মূল্যায়ন করার যোগ্যতা যেনো আমরা অর্জন করতে পারি ।লেখক : সহকারী ব্যবস্থাপক প্রশিক্ষণ, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স লিমিটেড ।sharminakhand007@yahoo.comএইচআর/আরআইপি