মতামত

এয়ার হোস্টেস এবং পেশার সুসমাচার : ফেয়ার এন্ড লাভলী

গায়ের রঙ ফর্সা না হলে `এয়ারহোস্টেস` জব পাওয়া যাবেনা, কিছু বিজ্ঞাপন সংস্থা এ ধরনের হাস্যকর ধারণা বহুদিন থেকে প্রচার করে আসছে ত্বক ফর্সাকারী (?) ক্রিম `ফেয়ার এন্ড লাভলী`র বিজ্ঞাপনে। তাই তাদের মতানুসারে এয়ার হোস্টেস হতে চাইলে অবশ্যই `ফেয়ার এন্ড লাভলীই` ব্যবহার করতে হবে, অন্যথায় স্বপ্নের চাকরি `এয়ার হোস্টেস` এর নাগাল পাওয়া সম্ভব নয়। অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসের সাথেই তারা এমন একটি ভুল বার্তা বছরের পর বছর সাধারণ মানুষদের দিয়ে আসছেন। ফলে, একসময় দেখা যাবে দীর্ঘসময় ধরে তারা এই ভ্রান্ত ধারণাগুলোই সমাজে প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছে। কারণ এর কোন প্রতিবাদ বা জবাবদিহিতা নেই। বিজ্ঞাপনী সংস্থাগুলো জানাচ্ছে এ পদের জন্য একজন চাকরি পদ প্রার্থীর কাছ থেকে এর চেয়ে আর কোন বড় যোগ্যতা মুখ্য নয়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এটি নারী-পুরুষ নির্বিশেষে উভয়েরই পেশা, যেখানে পুরুষের অস্তিত্বের বিষয়টি সবসময়ই অতিগোপনে পাশ কাটিয়ে যাওয়া হচ্ছে।আমাদের সমাজ,পরিবেশ-পরিস্থিতি, সংস্কৃতি এখনো শিক্ষার চেয়ে নারীর সৌন্দর্যবর্ধনের শিক্ষা দিতেই বেশি পছন্দ করে, যা বিজ্ঞাপনে নারীদের অবস্থানকে পুরুষের অধঃস্তন রুপেই প্রকাশ করে থাকে, যে অবস্থা থেকে এই একবিংশ শতাব্দীতে মুক্ত হওয়া এখন সময়ের দাবি। বিজ্ঞাপনে এমনও বলা হচ্ছে যে `বিয়ে করে ফেল` , এই নে ‘ফেয়ার এন্ড লাভলী`। অর্থাৎ এটি ব্যবহারে শুধু এয়ার হোস্টেস জব প্রাপ্তিই নয়, বরং বিয়ে হওয়ার পূর্ব পালনীয় করণীয় কাজ হিসেবেও ফেয়ার এন্ড লাভলী ব্যবহারের মেসেজ দেয়া হচ্ছে। আরও বলা হচ্ছে ফেয়ার এন্ড লাভলী ব্যবহারের আগে ইন্টারভিউ দিয়ে যে জব পাওয়া যায়নি সেটি এই `ফেয়ারনেস` ক্রিম ব্যবহারে তা সহজেই অর্জিত হচ্ছে।দেখা যাচ্ছে পুঁজিবাদী সমাজ নারীর অবয়বকে ব্যবহার করে, নারীকে পণ্য হিসেবে উপস্থাপন করে, সেই নারীর দ্বারাই মুনাফা গুনে ঘরে তুলে, আবার কৌশলে নারীর অবস্থানকেই তারা হেয় প্রতিপন্ন করে যাচ্ছে। মডেলদের মুখ থেকে সমতার কথা বলানো হলেও বাস্তবিকপক্ষে উপস্থাপন করা হচ্ছে নারী-পুরুষের চরম অসমতা। এতে বিজ্ঞাপন নির্মাতারা এক ধরনের অনগ্রসর এবং নেতিবাচক বার্তাই সমাজকে দিয়ে আসছে। যাতে সমাজের পুরুষতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণাগুলোর বীজই আজন্ম বপন করা হচ্ছে বলেই মনে হয়। যেখানে নারীকে প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে পুরুষ নির্ভর রুপ সর্বস্ব অধঃস্তন যৌনবস্তু হিসেবে। কথা হচ্ছে কেবিন ক্রুর মতো একটি দায়িত্বপূর্ণ পেশাকে গায়ের রঙ ফর্সাকারী প্রসাধনের উপর নির্ভরতাকে যুক্ত করে একটি পেশাকে শুধু অবমাননাই করা হচ্ছে তা নয়, এখানে একজন চাকরি প্রার্থীর অন্যান্য যোগ্যতাকেও খাটো করা হচ্ছে। সাথে সাথে বর্ণ-বৈষম্য লিঙ্গ-বৈষম্য পেশাদারিত্বের অপরিপক্বতা এবং সমাজের প্রতি দায়িত্বহীনতাও প্রকাশ করা হচ্ছে। তাছাড়া রঙ ফর্সাকারী ক্রিমের সাথে এ পেশাকে যুক্ত করে এ পেশায় নিয়োজিত পুরুষ কর্মীদেরকেও খাটো করা হয়েছে। এতে মনে হয় এই পেশায় হয়তো পুরুষদের কোন অবস্থান নেই। থাকলেও তারাও এ প্রসাধন ব্যবহার করে বলেই মনে হয়, যা প্রকৃত পক্ষে সঠিক নয়। আসলে এ ধরনের পেশাকে কেন্দ্র করে যখন নির্মাতারা বিজ্ঞাপন তৈরি করেন তখন এ পেশা সম্পর্কে ন্যূনতম অভিজ্ঞতা অর্জন করেই বিজ্ঞাপনটি তৈরি করা উচিত। অন্যথায় সাধারণ মানুষের কাছে কাল্পনিক পেশা কাল্পনিক জগতেই থেকে যাবে, যেখানে পেশার প্রকৃত দায়িত্বশীলতার ভূমিকাটি অতি গোপনে বাদ দিয়ে যাওয়া হয়। ফেয়ারনেস নয়, জরুরি অবস্থা মোকাবেলায় উড়োজাহাজের ভেতরের জরুরি ইকুইপমেন্ট গুলো ব্যবহার করার জন্য শারীরিক উচ্চতা এই পেশার একটি আবশ্যিক বিষয়।বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় শুদ্ধভাবে কথা বলার যোগ্যতা, শিক্ষাগত যোগ্যতা, বয়সের সীমা এবং স্মার্টনেস এই চাকরির প্রারম্ভিক যোগ্যতা হিসেবে চাওয়া হয়। একটি দু`টি অতিরিক্ত ভাষা জানা এবং সাঁতার অতিরিক্ত যোগ্যতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই সকল কিছুই প্রারম্ভিক যোগ্যতা হিসেবে বিবেচিত হলেও প্রশিক্ষণে সফল ভাবে নিজ যোগ্যতায় কৃতকার্য না হলে নায়িকা শ্রীদেবীর মতো সুন্দরী হলেও সেটি এ পেশার জন্য আদতে কোন যোগ্যতা নয়। বরং সুন্দরী হয়ে যোগ্যতা সম্পন্ন হলেই অর্থাৎ সুন্দরের সাথে যোগ্যতা যুক্ত হলেই যেনো এ পেশায় সোনায় সোহাগা ব্যাপার। কারণ এটি শুধু রুপ-সৌন্দর্য বিতরণ নির্ভর পেশা নয়। ঠিক তেমনিভাবে গায়ের রঙ চাপা হয়ে অন্যান্য যোগ্যতা থাকলে এ পেশায় নির্বাচিত হওয়া এ ক্ষেত্রে কোন বাঁধা নয়। অর্থাৎ গায়ের রঙ সাদা বা কালো সেটি এ পেশার যোগ্যতা হিসেবে সম্পর্কিত নয়।হাজার হাজার ফুট উচ্চতায় সম্পূর্ণ কৃত্রিম পরিবেশে যাত্রাকালীন সময়ে যাত্রীদের জীবনের নিরাপত্তা বিধান করে নিরাপদ গন্তব্য পৌঁছে দেয়াই এই পেশার মুখ্য কাজ। যদিও এ পেশা সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণা হচ্ছে `যাত্রীদের খাবার এবং পানি সরবরাহ করাই এ পেশার অন্যতম দায়িত্ব। সেবামূলক পেশা হিসেবে ভ্রমণকালীন যাত্রীদের আরাম আয়েশের সাথে শারীরিক অসুস্থতা দেখাশোনার দায়িত্বটিও একজন কেবিন ক্রুকেই পালন করতে হয়। কারণ যাত্রাকালীন সময়ে যাত্রীদের চিকিৎসার জন্য চিকিৎসকের কোন পদ নেই। তাই কেবিন ক্রুদের অন্যান্য জরুরি প্রশিক্ষণের সাথে সাথে প্রাথমিক চিকিৎসারও প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। সাধারণ মানুষ জানে না যে সম্পূর্ণ কৃত্রিম পরিবেশে অসুস্থ হয়ে গেলে, অক্সিজেনের প্রয়োজন হলে, ডিকম্প্রেশন হলে, পানিতে অথবা কাঁচা মাটিতে অবতরণ করলে অথবা জঙ্গলে জীবন রক্ষা করতে হলে, এমনকি ইনফ্লাইটে গর্ভবতী মাকে সন্তান প্রসব করানোর প্রশিক্ষণও তাঁরা পেয়ে থাকেন।নির্বাচনী প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার পর একজন কেবিন ক্রুকে জরুরি নিরাপত্তা বিষয়ক যে সকল প্রশিক্ষণ গুলোতে সফলতার সাথে কৃতকার্য হতে হয়, তা হচ্ছে, ফার্স্ট এইড, ফায়ার ফাইটিং, জরুরি অবতরণ বহির্গমন পদ্ধতি, পানিতে অবতরণ পদ্ধতি, ডেঞ্জারাস গুডস রেগুলেশন্স, হাইজ্যাকিং ও বোম থ্রেট , বিভিন্ন ধরনের যাত্রী ব্যবস্থাপনা, একাকী শিশু যাত্রী, ডিকম্প্রেশন, স্টাইড বেলুনকে পানিতে অবতরণের পর তা ডিঙ্গিতে পরিবর্তন, কাস্টমার সার্ভিস, ফিজিকাল এক্সারসাইজ, এনাউন্সমেন্ট মোটিভেশন, লিডারশীপ, ফুড হাইজিন ইত্যাদি এবং আরও অনেক। এ সকল প্রশিক্ষণ ও পেশার ধরন দেখে খুব সহজেই বোঝা যায় যে যাত্রাকালীন সময়ে যাত্রীদের আরাম আয়েশের ব্যবস্থা করাই এ পেশার একমাত্র লক্ষ্য নয়। যাত্রীর জীবনের নিরাপত্তাই এ পেশার অন্যতম দায়িত্ব। ১৯৮৬ সালে ভারতের নিরজা ভানোট নামে একজন এয়ারহোস্টেস প্যান এম ফ্লাইট ৭৩ বিমানটি ছিনতাই হ`লে বিমানের যাত্রীদের বাঁচাতে গিয়ে নিজের জীবন বিপন্ন করে সন্ত্রাসীদের হাতে খুন হন। মাত্র ২৩ বছর বয়সেই নিরজা নিজের জীবনের বিনিময়ে মোট ৩৬০ জন মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন। তাই নিরজা ভানোটকে ভারত, পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্রে সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননায় ভূষিত করা হয়েছে। বাইশ বছর বয়সী এক ব্রিটিশ নারী কেবিন ক্রু উড়োজাহাজে আগুন লেগে গেলে কেবিন থেকে যাত্রীদের সফলভাবে নামানোর পরে নিজে নামার ঠিক আগে এক পঙ্গু নারীকে বাঁচাতে গেলে উড়োজাহাজটি সম্পূর্ণভাবে বিস্ফোরিত হয়। যাত্রীর জীবনের প্রতি এহেন আত্মত্যাগ এ পেশার পেশাজীবীদের জন্য এক বিরাট অনুপ্রেরণা। তাই এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ একটি পেশার সাথে গায়ের রঙের বিষয়টি অত্যন্ত হাস্যকর ও অযৌক্তিক এবং পেশার প্রতি অসম্মানজনক। তাছাড়া এ ধরনের ভ্রান্ত প্রচারণায় নির্মাতা হিসেবে তাদের অপেশাদার বলেই মনে হয়। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে সকল শ্রেণির এবং ধরনের গ্রাহককে আকর্ষণ করার জন্য অনেক সময় বিজ্ঞাপন নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলোকে অনৈতিক, অস্বচ্ছ এবং ভ্রান্ত প্রণোদনায় নামতে হয়,যা বিজ্ঞাপন নির্মাণের নৈতিকতার দিক গুলোকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। পুরুষ কিংবা মেয়ে যেই হোক না কোনো একজন চাকরি প্রার্থী হিসেবে মানুষের শিক্ষগত যোগ্যতার পাশাপাশি অন্যান্য যোগ্যতাগুলোও অত্যন্ত জরুরি। এখানে নারীদের রূপের মাধ্যমে পুরুষকে আকৃষ্ট করা নারীর জন্যে মোটেও সম্মানজনক বিষয় নয়। কিন্তু দেখা যাচ্ছে টেলিভিশন, বিজ্ঞাপন এবং অন্যান্য মাধ্যম গুলোতে নারীকে সকল সময় রুপ সর্বস্ব হিসেবেই উপস্থাপন করা হয়।বর্তমান সময়ে ক্ষমতায়নের দিক থেকে বাংলাদেশের নারীরা বিভিন্ন সেক্টরে অগ্রগামী হয়ে উঠলেও দেখা যাচ্ছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ তা খুব সহজে মেনে নিতে পারেনি। তাই সমাজ থেকে সুবিধাপ্রাপ্ত পুরুষের হাতে নারীর প্রকৃত অবস্থান কৌশলগত কারণেই ঢাকা পরে যায়। যে কারণে নারীদের অবলাধবলা নির্বোধ নারী হিসেবে বাক্স বন্দি করতেই যেনো পুরুষতান্ত্রিক সমাজ গো ধরে বসে আছে শত শত বছর ধরে। উন্নয়নের এই জোয়ারে বাংলাদেশে নারীরা স্বাবলম্বী হয়ে চারদিকে উন্নয়নের দ্যুতি ছড়ালেও, প্রচারণার কাজটিতে দেখা যাচ্ছে নারী যেন ঠিক পণ্যসামগ্রীর মতোই। সামাজিক নিয়ম কানুন এবং প্রথাগত কারণে নারীরা পুরুষের চেয়ে অনেক সময় বেশি মেধাবী হয়েও দিনের শেষে পুরুষ দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হতে হচ্ছে। যার দরুন নারীরা পুরুষ দ্বারা প্রচণ্ড বিদ্বেষপূর্ণভাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। তাই মুনাফা লাভের আশায় অনেকটা নীতি বহির্ভূতভাবেই নারীর ফর্সা রঙের প্রয়োজনীয়তা এ পেশার যোগ্যতা নির্ধারণের মাপকাঠি হিসেবে তারা দেখাতে সদা সচেষ্ট। প্রকৃতপক্ষে যাত্রীসেবায় যাত্রীদের নিরাপদ গন্তব্য পৌঁছে দেবার জন্য তাদের জীবনের নিরাপত্তা বিধানের বিষয়গুলোকে সঠিকভাবে পরিপালনের যোগ্যতাই একজন কেবিন ক্রূর সবচেয়ে বড় দায়িত্ব। তাই প্রকৃত সত্য গোপন করে বছরের পর বছর মিডিয়াগুলো নারীর বিরুদ্ধে এবং সর্বোপরি একটি দায়িত্বশীল পেশার প্রতি নেতিবাচক অবস্থান নিলে দিনশেষে এই পুরুষতন্ত্রের জ্বরেই হয়তো হুমকির মুখে পড়ে যেতে পারে যাত্রীসেবার মান। তাই নারী-পুরুষ, সাদা-কালো এই বৈষম্যগুলো পরিহার করে প্রকৃত দায়িত্বশীল পেশার ধরনটিই বিজ্ঞাপন মাধ্যমগুলোকে তুলে ধরতে হবে।লেখক : সহকারী ব্যবস্থাপক প্রশিক্ষণ, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স লিমিটেড ।sharminakhand007@yahoo.comএইচআর/আরআইপি

Advertisement