স্কুলে পৌরনীতিতে পড়েছিলাম বিভিন্ন প্রকার সরকারের কথা। সব ব্যবস্থারই ইতিবাচক ও নেতিবাচক কিংবা সবল ও দুর্বল দিকের কথাও তাতে থাকত। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাও এর বাইরে নয়, আজকাল বলা হয় এ হল মন্দের ভাল। কারণ রাষ্ট্র পরিচালনায় যে কোনো সরকারই ক্ষমতা ব্যবহারে যথেষ্ট স্বাধীনতা প্রত্যাশা করে থাকে। গণতন্ত্র মন্দের ভালো এই কারণে যে এ ব্যবস্থায় এমন কিছু প্রতিষ্ঠান এবং রীতি বা ব্যবহারিক সংস্কৃতি গড়ে ওঠে যা শাসকের এই অবাধ ক্ষমতা ভোগের আকাঙ্খায় বাদ সাধে।মার্কিন সমাজে খুব ভালো প্রার্থীর মনোনয়ন পাওয়াই নিশ্চিত নয়, বিজয়ী হওয়াও কঠিন। এবারের নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট দলের প্রার্থী হিসেবে বার্নি স্যান্ডার্স নিশ্চিতভাবে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীর চেয়ে ভালো ছিলেন, কিন্তু মনোনয়ন দৌড়ে হিলারীর কাছে তিনি পরাজিত হলেন। আবার নির্বাচনে প্রায় সকলের ধারণাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বিজয়ী হন মাথামোটা অরুচিকর ব্যক্তি ডোনাল্ড ট্রাম্প। ট্রাম্প ধনকুবের, মতাদর্শের স্থিরতা নেই এবং প্রশাসনিক কাজের অভিজ্ঞতাহীন আত্মম্ভরী উদ্ধত ব্যক্তি।তবে ক্ষমতার একমাসের মধ্যে তিনি ক্রমেই উপলব্ধি করছেন যে একক সিদ্ধান্তে নিজের খেয়াল খুশিতে নিজস্ব প্রতিষ্ঠান চালানো যায়, রাষ্ট্র নয়। অন্তত মার্কিন গণতন্ত্র অতটা দুর্বল নয়। তাঁর অনেক একগুঁয়ে সিদ্ধান্ত হয় আটকে গেছে নয়ত তাঁকে নমনীয়তা দেখাতে হচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিচার বিভাগ স্বাধীন, নাগরিকদের মত প্রকাশের স্বাধীনতাও সুরক্ষিত। তাছাড়া যাতে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি কোনো স্বৈরাচারে পরিণত হতে না পারেন তারও ব্যবস্থা আছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ক্ষমতা ও ভূমিকার কারণে।স্বদেশে বিচার বিভাগ ও সংবাদপত্র, এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশের সাথে, এমনকি প্রায় চিরকালের মিত্র, পশ্চিম ইউরোপের দেশের সাথেও দ্বন্দ্বমুখর তিক্ততায় সম্পর্ক তৈরি করে ডোনাল্ড ট্রাম্প পৃথিবীর এক নাম্বার দেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে পূর্ণ মেয়াদ থাকতে পারবেন কিনা তা নিয়ে অনেকের মনে সংশয় তৈরি হয়েছে। রাষ্ট্রপতির ইমপিচমেন্ট বা অভিশংসিত হওয়ার ঘটনা মার্কিন ইতিহাসে রয়েছে, নিক্সনের অভিশংসন অনেকের স্মৃতিতে নিশ্চয় আছে। তবে এটা বিস্ময়ের ব্যাপার হবে না যদি মার্কিন শাসনব্যবস্থা ডোনাল্ড ট্রাম্পের রাশ টেনে ধরে চার বছরের মেয়াদ পূরণ করে নেয়। আর তেমন পরিস্থিতির উদ্ভব হলে তা সামাল দেওয়ার জন্যেও তারা একজন ঠাণ্ডা মাথার উপরাষ্ট্রপতিকে নির্বাচন করে রেখেছে।আমাদের দেশে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার কথা আমরা জানি। ব্যবস্থাটি গণতান্ত্রিক হলেও এখনও পর্যন্ত বিজয়ী দল প্রায় নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী হয়ে যাচ্ছে। প্রধান দুটি দলের পক্ষে পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু করা সম্ভব হচ্ছে না। এই পথে বড় বাধা অবশ্যই বিএনপির মতাদর্শ, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার মূল আকাঙ্খা অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক মানবিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এবং বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের রাজনৈতিক ইতিহাস ও এর নেতাদের সম্পর্কে তাদের মূল্যায়ন ও অবস্থান এখনও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে আছে। খালেদা জিয়া শহীদ মিনারে যান বটে কিন্তু তিনি যে একুশের চেতনায় বিশ্বাসী এ কথার কোনো প্রমাণ নেই। একইভাবে, স্বাধীনতা ও বিজয় দিবসে নানা অনুষ্ঠানে থাকেন বটে কিন্তু সেখানে এর ইতিহাস ও তাৎপর্য নিয়ে তাঁর জন্যে আলোচনার বিষয় নেই বলেই মনে হয়। তাছাড়া বিএনপি ক্ষমতায় এলে জামায়াত ও অন্যান্য ধর্মান্ধ দলও ক্ষমতায় আসবে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পরেও এই হল বাস্তবতা। অথচ এতে খেসারত দিচ্ছে জাতি, ক্ষতি হচ্ছে গণতান্ত্রিক বিকাশের। আওয়ামী লীগ তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে বিএনপিকে দুর্বল করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে। যদিও এতে বিএনপির অভ্যন্তরে যে উদারপন্থী গ্রুপটি রয়েছে তারাও অকার্যকর হয়ে পড়ছেন। বরং চাপের মুখে থাকায় দলের অভ্যন্তরে যারা জামায়াত ঘেঁষা বা কট্টরপন্থী তারাই শক্তিশালী থাকবে।সংসদ অকার্যকর হয়ে আছে, জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও সংসদে আলোচিত হয় না। পরপর দুটি সংসদ মেয়াদ পার করছে কখনো কোনো ইস্যু নিয়ে সুস্থ প্রাণবন্ত এবং কঠিন বিতর্ক ছাড়া। সরকারের সিদ্ধান্তেই দেশ চলছে, সংসদ ছায়ামাত্র হয়ে আছে। এ অবস্থায় দেশ এবং গণতন্ত্র উভয়ই একটা বিপদের দিকে যাচ্ছে। মধ্যপন্থী কিংবা মধ্যডানপন্থীদের দুর্বল অবস্থানের কারণে আওয়ামী লীগের বিকল্প যে বিএনপি সেটা হবে ধর্মীয় কট্টরপন্থাসহ ডানপন্থী একটি দল। সরকার হেফাজতে ইসলামকে যতই প্রশ্রয় দিক তাদের স্বাভাবিক মিত্র বিএনপি, ভোটের রাজনীতিতে তারা দিক পরিবর্তন করবে বলে মনে হয় না। ফলে দেশ এমন এক বাস্তবতার দিকে চলেছে যা একদিকে আওয়ামী লীগকে হেফাজতের সাথে আপসে প্ররোচিত করছে আর অন্যদিকে এমন আশংকাই তৈরি হচ্ছে যে তাদের অনুপস্থিতিতে বিকল্প শক্তি হয়ে উঠবে ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক দল বা জোট। বাংলাদেশ কি আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়ার মত বিবদমান ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর দ্বন্দ্ব-সংঘাতের ক্ষেত্রে পরিণত হবে?বাংলাদেশের উদার মানবতাবাদের ঐতিহ্য অবশ্যই আজ ক্ষয়িষ্ণু। আওয়ামী লীগ, অন্তত স্থানীয় নেতৃত্বের মান ও প্রবণতার বিচারে, চিরায়ত এই ধারাকে আর লালন করে না। রাষ্ট্রশক্তি ধরে রাখার দিকে অতিরিক্ত মনোযোগ দিতে গিয়ে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতার নেপথ্যে নানা প্রতিষ্ঠান ও শক্তিকে খুশি রাখতে হচ্ছে। এর খেসারত হল দলের আর রাজনীতি চর্চার অবকাশ নেই, দলে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সংকুচিত হচ্ছে, প্রশাসনযন্ত্র রাজনৈতিক নেতৃত্বকে ছাপিয়েই থাকছে। ছোটবড় নেতারা এ অবকাশে নানা উপায়ে অর্থবিত্ত অর্জনে মনোযোগী হয়ে উঠছে। তাতে দুর্নীতি, কোন্দল, অপরাধেই তারা জড়িয়ে যাচ্ছে। এভাবে রাজনৈতিক দলের জনবিচ্ছিন্নতাও ঘটতে থাকে। ভোটের রাজনীতিতে মানুষের বিচারে পদ্মাসেতু বা এরকম উন্নয়নের দৃষ্টান্তকে ছাপিয়ে স্থানীয় পর্যায়ে মাস্তানী ও ক্ষমতার প্রতাপের বিরুদ্ধে নীরব প্রতিবাদ গুরুত্ব পায়। তাছাড়া, বিত্তবান, কর্তৃত্বপরায়ণ এবং বেপরোয়া হয়ে ওঠা ছোটবড় নেতাদের নির্বাচনী খায়েশের রাশ টানাও বেশ কঠিন হবে। স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলে বিদ্রোহী প্রার্থীর সংখ্যাই বলে দেয় প্রবণতা কোন দিকে।সব মিলিয়ে ব্যাপক উন্নয়নের মধ্যেও দেশের ভবিষ্যত, এবং গণতন্ত্রের ভবিষ্যত নিয়ে আমরা ভাবিত না হয়ে পারি না। আগামী নির্বাচনে একদিকে হেফাজতের সাথে আপস-সমঝোতায় পরিবর্তিত আওয়ামী লীগ আর অন্যদিকে জামায়াতের সাথে জোটবদ্ধ বিএনপি। সমাজে অসাম্প্রদায়িক, উদার মানবিক শক্তির পেছনে রাজনীতির পুষ্টি আজ সবচেয়ে কম। তাই এই চেতনা নাগরিকদের ক্ষুদ্র অংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে আছে।অথচ কি স্বাধীনতা কি জাতির মুক্তি যে আকাঙ্খা বঙ্গবন্ধু ব্যক্ত করেছিলেন তাঁর সাতই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে তাতো নির্ভর করছে এই শক্তিরই বিজয়ের ওপরে! বাস্তব হল তাঁর দলের শাসনামলে এই শক্তিটিই সবচেয়ে দুর্বল পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। তাহলে আশার জায়গা কিছু থাকে কি? একমাত্র আশা হল, বাংলাদেশের মানুষ ভালোমন্দ বিচার বোধ হারায় নি, সেটার প্রমাণ তারা দিয়েছে নারায়ণগঞ্জে। সামনের নির্বাচনে সম্ভবত এমন কোনো জোয়ার থাকবে না যে বড় নেত্রীর নামে কলাগাছ দাঁড় করিয়ে দিলেও তারা বিজয়ী হবেন। এবারে বোধহয় প্রার্থীর মান নিয়ে ভাববেন ভোটাররা, যেমনটা তারা ভেবেছেন নারায়ণগঞ্জে।লেখক : কবি, সাংবাদিক, সমাজচিন্তক। এইচআর/এমএস
Advertisement