একুশে বইমেলা

রাতের ঘোড়া থেকে তিনটি কবিতা

এ-পর্যন্ত কবি ও গবেষক আহমেদ ফিরোজের কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ-গবেষণা ও সম্পাদনাসহ মোট ২৫টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এবার বইমেলায় প্রকাশ হচ্ছে ২৬তম বই। এটি কবির ৩য় কাব্যগ্রন্থ, নাম ‘রাতের ঘোড়া’। বইটি থেকে তিনটি কবিতা পাঠকের সামনে তুলে ধরা হলো-ভাগাড়ভাগাড়,যেন তার নিচে চাপা পড়া মানুষেরা শিশুর রূপ ধরে কাঁদছে;একদল লোক পালাতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালবিজলি চমকানোর আলোয় অন্ধকার উদ্ভাসিত হয়ে উঠলহতচকিত হয়ে দেখতে পেল, কী সামান্য পথই না পার হয়েছে তারামাথা নত হয়ে আসছিল পরাজয়েরর গ্লানিতেতারা হাঁটু গেড়ে বসে গন্ধ শুঁকে শুঁকে        ক্ষীণ কান্নার উৎসের দিকে এগলোহঠাৎ তাদের চোখে পড়ল একদলা শাদা বস্তুহতবুদ্ধ দাঁড়িয়ে থাকল কিছুক্ষণতারপর...একজনচলে যাবার জন্য ইতস্তত কয়েক পা এগিয়েওবেশি দূর যেতে পারল নাকান্নার শব্দ পেছনে টেনে ধরে রাখলএকটু একটু করে আবার ফিরে এলো, ঘন ঘন শ্বাস নিলহাঁটু গেড়ে বসল, তখনো দ্বিধান্বিততারপর দু’হাত বাড়িয়ে দিলশাদা পিণ্ডের মোড়কটি নড়েচড়ে উঠলকতগুলো খবরের কাগজের পাতার মধ্যে যুদ্ধ করছে        ছোট্ট একটি মানবশিশুলোকটি তাকে কোলে তুলে নিলতার ভাবভঙ্গি অনিশ্চিতঅনেকটা যেন প্রবৃত্তিতাড়িতের মতোযেন সে কী করছে নিজেই জানে নাঅথচ না করেও পারছে নাধীরে ধীরে সে সোজা হয়ে দাঁড়ালআচমকা অপ্রত্যাশিত কোমল ভাবাবেগের জন্য নিজের ওপর বিরক্ত হলোতারপর নিজের অজ্ঞাতেই গায়ের জ্যাকেট খুলে জলে ভেজা কান্নারত শিশুটির গায় জড়িয়ে দিলএরপর হঠাৎ গতি বাড়িয়ে দিয়ে অনেকটা দৌড়ানোর ভঙ্গিতেসে ঐ কান্নাকে সঙ্গে নিয়ে ভাগাড় থেকে বেরিয়েঅন্ধকারে মিলিয়ে গেল...****কানঅদ্ভুত পাণ্ডুর বর্ণ কান‘কমিকে’র নৃপতির মতো স্থির, অভিব্যক্তিহীন;কোনো এক দূরাগত সতর্কসঙ্কেত শুনেবিন্দুমাত্র দ্বিধা না করেপথ অনুসরণ করললতি বেয়েএরপর ফোঁকরে, আশপাশ, মুহূর্তে দখল করে ফেললপিঁপড়েরা;লোকটি নদীর দিকে এমনভাবে তাকিয়ে ছিলযেন খোদাই করা কাঠের মূর্তিপিঁপড়েরা গোটা কানটাই গ্রাস করতে শুরু করেছেসে শুধু দেখছিল অপলক চোখেউদ্বেগ, আনন্দ, ঘৃণায়যেন কোনো সম্পর্ক নেইসবই অপ্রতিরোধ্য, অনিবার্যতানীল আকাশগোধূলিবেলারক্তিমাভাছায়া ঘনিয়ে আসছিলকী এক রহস্য যেনকণ্ঠ নীরবকেবল এলোমেলো ডাকাডাকিএকঘেয়ে...এখানে জলের শব্দ ভিন্ন রকমযেন মৃত্যুভাবনায় আত্মমগ্ন ঈশ্বরের আর্তস্বর;কাঁপন লাগা ঠান্ডা হাওয়া ছুটে আসছেচোয়াল শক্ত করে চেপে ধরলএক এক করে সব গ্রাস করছে পিঁপড়েরাঅথচ লোকটির কাছে জগতের সব মানে হারিয়ে গেছেযখন বুক ফুঁড়ে ময়লা-গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে বাতাসেআলোকে পালিয়ে যেতে বাধ্য করা হচ্ছেচতুর্দিকে খাটাসের দল, পাল বেঁধে দৌড়ূচ্ছে, হাঁফাচ্ছেতখন লোকটা শরীরটা সম্পূর্ণভাবে আটকে রাখল        একটা বইয়ের ভাঁজে... ****স্মৃতিভ্রষ্ট বারান্দায় আয়না অদরকারিরাত কিংবা দিনে আলাদা করে স্বপ্নেরা হানা দেয় না এখনক্যালেন্ডারের পাতায় ঘড়ির মিনিট সেকেন্ডের কাটা বেজে ওঠেঘণ্টা বাজে সোনার তলোয়ারের মতোতীব্র ঝড়ের মিছিলেস্বপ্নগুলো কখনো কখনো শিশু হয়ে যায়ডুবসাঁতারে ফেরার চোখে, তবু সে সতর্কআবছা গোধূলি ঢুকে পড়ে ঘরে, ঘরের ঈশানকোণেযেখানে অশান্ত আগুনের শিস জ্বলজ্বলেগ্রীষ্মের জ্বলন্ত উত্তাপ পুড়িয়ে দিচ্ছিল জলের প্রবাহ ও সম্ভাবনাআমি, তুমি ও সে চোখ ধাঁধানো আন্দোলনের ফাঁদে পড়ে যাইড্রেসিংরুমে আয়নায় যন্ত্রণার বিপরীতেখালি পা পালিয়ে চুপি চুপি আরেকটি তীব্র রোষে কেঁপে ওঠেঅমানিশাকাল, ঠান্ডা আলোর আভায় বিবর্ণ শিরায় রক্তদাগনগ্ন রাস্তার মাঝে রাষ্ট্রপিঠ ফিরিয়ে একদিকে শোয়াএতটা বছর মেকি হাসি সহ্য করেছিল সে, অথচ জানতো না যে,কখনো মুক্তিযুদ্ধে যায়নি, যাবেও না কোনোদিনতার কাছে হাসি, চঞ্চলতা, উন্মত্ততা, ভালোবাসার মূল্য কি?কুঁচকে যাওয়া মুখে পর্দাগুলো ঝকঝকেএকটু যেন কুৎসিত, বীভৎসতায় ভরাএক ভোরে মুক্ত করে দেওয়া গোপনতা কেড়ে নিয়েছিল ওরামিথ্যে তার আত্মসমর্পণতারা রোদ্দুরের মুখোশ পরে দাঁড়িয়ে আছেঅথচ সময় স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে : স্মৃতিভ্রষ্ট বারান্দায় আয়না অদরকারি...এসইউ/এমএস

Advertisement