কথা ছিল সাংবাদিকদের সঙ্গে সকাল ১১ টায় কথা বলবেন। কিন্তু টিম বাংলাদেশের সব কোচিং স্টাফদের সাথে মিটিং করে একবারে তৈরি হয়ে নামতে নামতে দুপুর সাড়ে বারোটার বেশি বেজে গেল। ক্লিন শেভ, টি-শার্ট আর জিন্স প্যান্ট পরা চণ্ডিকা হাথুরুসিংহে লিফট দিয়ে লবিতে নেমেই দেখেন তামিম-সাকিবরা দল বেঁধে বসা।সাংবাদিক পরিবেষ্টিত অবস্থায় কোচ এগিয়ে আসলেন তামিম ইকবালের সামনে। ক্রাইস্টচার্চ টেস্টের অধিনায়ককে জানিয়ে দিলেন, ‘আমি আরও একটি মিটিং করবো। এবং সেটা তোমার সাথে। নাহ, হোটেল রুমে নয়। আমরা কথা বলবো কাছাকাছি কোনো ক্যাফে কিংবা রেস্তোরায়।’তারপর সোজা মিডিয়ার সামনে চলে আসা। হঠাৎ মনে হলো আরে আমি তো জাতীয় দলের জার্সি, জ্যাকেট, ট্রাউজার্স আর ক্যাপ কিছুই পরা না। মিডিয়া ম্যানেজার রাবিদ ইমামকে যেচে জানতে চাওয়া, ‘রাবিদ, আমি তো ক্যাজুয়াল ড্রেসে। কোনো অসুবিধা নেই তো? ক্যাপ কি নিয়ে আসবো?’ রাবিদ জানালেন, না না, এটা তো আর খেলার আগে কিংবা পরের মিডিয়া সেশন নয়। এটা কোন সংবাদ সন্মেলন নয়। বাংলাদেশি সাংবাদিকদের সঙ্গে পুরো সিরিজ, বিশেষ করে শেষ টেস্ট নিয়ে খোলামেলা আলোচনার মতো। টিম হোটেল ‘রদেভুর’ লবির ঠিক বাইরে খোলা আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের প্রচারমাধ্যমের সাথে সত্যি অনেক কথোপকোথনই হয়েছে তার। অনেক কথাই বলেছেন হাথুরু। চোখ মুখ আগেই বলে দিচ্ছিল যে আশা ও স্বপ্ন নিয়ে নিউজিল্যান্ড এসেছিলেন, সে স্বপ্নপূরণ হয়নি। আশাভঙ্গের বেদনা পোড়াচ্ছে তাকে। তাইতো এক সিনিয়র সাংবাদিক যখন জানতে চাইলেন, আচ্ছা, কোচ আপনার লক্ষ্য কি পূরণ হয়েছে? নিশ্চয়ই নিউজিল্যান্ড আসার আগে মনের ভেতরে কিছু লক্ষ্য-পরিকল্পনা নিয়ে এসেছিলেন। তার কতটা পূর্ণ হয়েছে? কিছুটা ধরা গলার উত্তর বাংলাদেশ কোচের- ‘সব ম্যাচ হারলে তৃপ্ত হওয়ার কথা না। সে আলোকে বলা, ট্যুর শুরুর আগে যে টার্গেট ছিল আমার, সে লক্ষ্য পূরণ হয়নি।’ এরপর আরেক সিনিয়র সাংবাদিকের প্রশ্ন, চণ্ডিকা, আপনার দল সীমিত ওভারের ছয় ম্যাচ আর দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজসহ ৬ +২ = ৮-০ তে হারলো। সিরিজ শেষে আপনার কি মূল্যায়ন, আপনি কি এমন পরিণতি চিন্তা করেছিলেন? এটা কতটা প্রত্যাশিত ছিল? হাথুরুর জবাব, ‘হ্যা, ফলাফলের দিকে তাকালে হতাশই মনে হবে। কারণ আমরা সব ম্যাচই হেরেছি।’ এইটুকুই শেষ নয়। আরও কিছু যোগ করলেন বাংলাদেশ কোচ এমন নয়, ‘আমরা ব্যর্থতার ঘানি টেনেছে কিছু পজিটিভও আছে। আমরা পুরো সফরের বেশির ভাগ সময় ও ম্যাচে প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তুলেছি। বেশ কয়েকবার সাফল্যের পথও খুঁজে পেয়েছি। কিন্তু নিজেদের সৃষ্ট সে জেতার সম্ভাবনাগুলো কাজে লাগিয়ে সাফল্যের মঞ্চে ওঠা সম্ভব হয়নি।’ এর বাইরে আরও একটু যোগ করেন, ‘হ্যাঁ, মানছি সবারই প্রত্যাশা ছিল। সব ম্যাচ হার হয়তো অনেকেই আশা করেননি। তবে এটাও সত্য, নিউজিল্যান্ডের কন্ডিশনে বেশ ক’বছর পর হঠাৎ এসে জয়ের সম্ভাবনা তৈরি করা সহজ না।’ তবে হাথুরুর দূঃখ ও অতৃপ্তি অন্য জায়গায়। তিনি নিজে আসলে দলের ব্যর্থতার প্রকৃত কারণ খুঁজতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন। তার অনুভব, ‘ক্রিকেটারদের ক্রিকেটীয় স্কিল, টেকনিকে বড় ধরনের সমস্যা নেই। তারা মোটেই অদক্ষ নয়। যদি অদক্ষ হতো, টেকনিক ও স্কিলে ঘাটতি থাকতো, তাহলে তো আমরা পাত্তাই পেতাম না। নাস্তানাবুদ হতাম। আমরা দাঁড়াতেই পারতাম না। মুখ থুবড়ে পড়ে থাকতাম। আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারতাম না। কিন্তু কই তা কি হয়েছে? আমরা তো চরমভাবে পর্যুদস্ত হইনি।’ ‘তাই আমার মনে হয়- সমস্যাটা টেকনিকে ঘাটতি নয়। ক্রিকেট মেধা বা স্কিল যাই বলা হোক না কেন, তাতেও সমস্যা নেই। আমিও নিজেও খুঁজে বেড়াচ্ছি প্রকৃত সমস্যা কোথায়? হতে পারে মানসিক দৃঢ়তার ঘাটতি আছে। পাঁচদিনের ম্যাচে ভালো করতে হলে শুধু ক্রিকেট টিকনিক আর স্কিল দিয়ে হবে না। ম্যাচের নানা ওঠা-নামার সাথে মানসিক দৃঢ়তা আর শারীরিক সক্ষমতাও খুব জরুরি। এখন দেখতে হবে সে সব জায়গায় কোনো ঘাটতি আছে কিনা?’ টেস্টে ক্রিকেটারদের সামগ্রীক এ্যাপ্রোচ ভালো লাগেনি কোচের। কথায় পরিষ্কার- তিনি অখুশি। তাইতো মুখে এমন কথা, ‘শুধু ক্রাইস্টচার্চ নয়, ওয়েলিংটনেও আমাদের এ্যাপ্রোচ ভালো ছিল না। আমার মনে হয়, পাঁচদিন লড়াই করার জন্য যে মানাসিক দৃঢ়তা দরকার ক্রিকেটারদের মাঝে তা ফুটে ওঠেনি।’ সাংবাদিকদের কাছ থেকেই শুনলেন, আগের দিন তামিম ইকবাল সব ব্যর্থতার দায় দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন। কোচের ধারণা ছিল, তামিম বুঝি শুধু নিজের ব্যাটিং ব্যর্থতার দায় স্বীকার করেছেন। কিন্তু যখন শুনলেন, নাহ, ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক হিসেবে পুরো দলের দায় ও দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন, তামিম- তখন মনে হয় একটু ভালো লাগলো। তাই কোচের মুখে এমন কথা, ‘এটা খুব ভালো ও ইতিবাচক লক্ষণ যে, কেউ একজন ব্যর্থতার দায় দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিল। তার মানে ক্রিকেটাররা আগের চেয়ে আরও দায়িত্ব সচেতন হচ্ছে।’ অনেকেই ৪৫ টেস্ট খেলে ফেলেছেন। কিন্তু এখনো সে অর্থে দায়িত্ব-সচেতনতার পরিচয় দিতে পারেননি। এ সম্পর্কে আপনার মত কি? কোচ ঘুরিয়ে বলেন, ‘আমি ৪৫ টেস্ট বুঝি না। কে আট-নয় বছর ধরে জাতীয় দলে টানা খেলছে সেটাও বিবেচ্য নয়। আমি দেখবো- কে কত তাড়াতাড়ি নিজের ভুলত্রুটি শুধরে নেয়। বেশি দিন ধরে খেলা ও অনেক ম্যাচ খেলা দিয়ে কিছুই বোঝায় না। আসল বিষয় হলো, দ্রুত শিখা। যে যতো শীঘ্রই শিখবে ততোই মঙ্গল!’এনইউ/এমএস
Advertisement