চলতি বছরের পাঠ্যবইয়ে বেশ কিছু ভুল নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বইছে। দেশের উচ্চমানের শিক্ষক, লেখকদের সমন্বয়ে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) কালিকুলাম প্রণয়নের পরও কেন এতো ভুল? এজন্য দায়ী কারা? এসবের প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে অনুসন্ধানে ধরা পড়ে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নানা অনিয়ম অসঙ্গতি, যা তুলে ধরা হলো জাগো নিউজের তিন পর্বের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে। আজ থাকছে এর তৃতীয় পর্ব।ভুলে ভরা পাঠ্যপুস্তকের কারণ ও অপরাধীদের শনাক্ত করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটি। এ তালিকা সোমবার জমা দেয়া হবে। এছাড়া নির্ভুল পাঠ্যবই তৈরিতে এ কমিটি পরবর্তী ফর্মুলা দেবে বলেও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।সূত্র জানিয়েছে, অপরাধীদের মধ্যে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) শীর্ষ পর্যায়ের সাত কর্মকর্তাকে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাদের অসাধু ভাবনা ও অবহেলাই ভুলের প্রধান কারণ বলে জানিয়েছে তদন্ত কমিটি।২০১৭ সালের পাঠ্যবইয়ে কবি-সাহিত্যিকদের কবিতার নাম-শব্দ পরিবর্তন, অর্থহীন ও বিতর্কিত শব্দ-ছবি সংযুক্ত, সাম্প্রদায়িকতা, বইভর্তি বিদেশি গল্পসহ নানা অপসংস্কৃতি পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এর পেছনে কারণ ও দোষীদের চিহ্নিত করতে গত ১২ জানুয়ারি সাত কার্যদিবস মেয়াদের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।এ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব রূহি রহমানকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। রোববার তাদের কাজ শেষ করার কথা রয়েছে।তদন্ত কমিটির প্রধান শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব রূহি রহমানের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এনসিটিবিতে মেধাবী-গবেষকদের স্থান হওয়ার কথা থাকলেও সেখানে অধিকাংশ পদ অদক্ষদের দখলে। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সমন্বয়ে সেখানে একটি সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে। তাদের কলকাঠিতেই এনসিটিবি চলছে।তিনি আরও বলেন, পাঠ্যবইয়ে ভুলের কারণ খুজতে ‘কেঁচো খুড়তে সাপ’ বেরিয়ে আসার উপক্রম। এনসিটিবির সাত কর্মকর্তার কারণে পাঠ্যপুস্তকের এ অবস্থা হয়েছে। ভুলের কারণ খুঁজতে গিয়ে কর্মকর্তাদের বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতিও বেরিয়ে আসছে। আমরা কয়েক দফায় তাদের আলাদা করে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। প্রাথমিকভাবে দোষী ব্যক্তিদের শনাক্ত করা হয়েছে। তিনি জানান, আগামীকাল রোববার সকাল থেকে তদন্ত টিম আবারও নতুনভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করবে। পরদিন তারা তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করবেন। পাশাপাশি পরবর্তীতে যাতে মানসম্মত পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন সম্ভব হয় সে বিষয়েও নির্দেশনা দেবে। তবে তদন্তের স্বার্থে অভিযুক্তদের নাম প্রকাশে রাজি হননি এ কর্মকর্তা।জানা গেছে, একটি বই রচনা ও সম্পাদনার দায়িত্বে থাকেন কয়েকজন শিক্ষক ও শিক্ষাবিদ। এরপর পরিমার্জনের দায়িত্বে থাকে আরেক পরিষদ। তবে একটি বইয়ের সার্বিক দায়িত্ব দেয়া হয় একজন বিশেষজ্ঞকে। তিনিই মূলত ওই বইয়ের ভুলত্রুটির জন্য দায়ী। চলতি শিক্ষাবর্ষের বইয়ের জন্য মোট ৭৭ জন বিশেষজ্ঞ দায়িত্ব পালন করেন। এর মধ্যে এনসিটিবির নিজস্ব ৬৪ জনের মধ্য থেকে দায়িত্ব পালন করেন ৫২ জন। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের চার কর্মকর্তা এনসিটিবিতে সংযুক্ত অবস্থায় দায়িত্ব পালন করেন। আর ১৮ বিশেষজ্ঞ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি প্রকল্প থেকে আনা হয়েছে। বাকি দুজন এনসিটিবির আর্টিস্ট কাম ডিজাইনার।তবে এনসিটিবির প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা মো. নাসির উদ্দিনকে হিসাব সামলানোর পাশাপাশি দাখিল এবং মাধ্যমিকের বাংলা ও ইংরেজি ভার্সনের নবম শ্রেণির গণিত বইয়ের দায়িত্ব নিতে হয়। আর ঊর্ধ্বতন ভাণ্ডার কর্মকর্তাও দায়িত্ব নেন ক্যারিয়ার শিক্ষা বইয়ের।সূত্র জানায়, প্রাথমিক তদন্তের ভিত্তিতে এনসিটিবির দুই কর্মকর্তাকে ওএসডি ও একজনকে সাময়িক বহিষ্কারের পর প্রতিষ্ঠানটিতে চলছে বদলি আতঙ্ক। একটি সদস্যপদ থেকে শুরু করে বিশেষজ্ঞ, ঊর্ধ্বতন বিশেষজ্ঞ, গবেষণা কর্মকর্তারাও এর বাইরে নন। তদন্ত কমিটি এনসিটিবির বিভিন্ন কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে অনেকেরই নোট-গাইড ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পেয়েছে।এনসিটিবিতে তিন বছরের প্রেষণে এসে এক যুগ পার করেছেন এসব কর্মকর্তার নামের তালিকাও সংগ্রহ করেছে কমিটি। তবে এনসিটিবি সদস্য (প্রাথমিক পাঠ্যক্রম) অধ্যাপক ড. মো. আবদুল মান্নান, সম্পাদক গৌরাঙ্গ লাল সরকার, প্রাথমিক তদন্তের ভিত্তিতে ওএসডি হওয়া এনসিটিবির প্রধান সম্পাদক প্রীতিশ কুমার সরকার, ঊর্ধ্বতন বিশেষজ্ঞ লানা হুমায়রা খানকে মূল অপরাধীর শীর্ষ তালিকায় রাখা হয়েছে বলে জানা গেছে।এদিকে প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান বলেছেন, এনসিটিবি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধিনস্থ হওয়ায় তাদের ওপর নির্ভর করতাম। তবে আগামী বছর থেকে প্রাথমিকের বই নিজেরাই প্রণয়ন ও ছাপার চিন্তাভাবনা করছি।এমএইচএম/এএইচ/আরআইপি
Advertisement