ব্যবসা শুরুর চার বছর পার হলেও বিশেষ কোনো নতুনত্ব আনতে পারেনি চতুর্থ প্রজন্মের ৯ ব্যাংক। গতানুগতিক ধারায় চলছে কার্যক্রম। উচ্চ সুদে আমানত সংগ্রহ আর আগ্রাসী ঋণ বিতরণেই ব্যস্ত তারা। ফলে খেলাপি ঋণ বাড়ার পাশাপাশি নানা অনিয়মেও জড়িয়ে পড়ছে ব্যাংকগুলো। রাজনৈতিক বিবেচনায় চতুর্থ প্রজন্মের ৯ ব্যাংকের অনুমোদন প্রাপ্তির পূর্বশর্ত ছিল, কৃষি ও গ্রামীণ অর্থনীতিকে গুরুত্ব দেয়া ও সেবায় নতুনত্ব আনা। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো নতুন পণ্য আনতে পারেনি এসব ব্যাংক। নানা চ্যালেঞ্জের মধ্যে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে আগ্রাসী ব্যাংকিং কার্যক্রম চালাচ্ছে তারা। এদিকে গ্রামে শাখা খোলার ক্ষেত্রে কিছুটা অগ্রগতি হলেও পিছিয়ে আছে ঋণ বিতরণে। তবে প্রত্যাশা অনুযায়ী কাজ করতে না পারলেও চেষ্টা অব্যাহত আছে বলেছেন সংশ্লিষ্টরা।এদিকে কৃষি ও গ্রামীণ অর্থনীতিকে গুরুত্ব দিতে বলা হলেও তা বাস্তবায়নে তেমন অগ্রগতি নেই ব্যাংকগুলোর। শাখা খোলার ক্ষেত্রে সাধারণ নিয়ম মানছে না নতুন ব্যাংকগুলো। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নতুন ৯টি ব্যাংকের মোট শাখা খোলা হয়েছে ৩২৪টি, যার মধ্যে শহরে ১৬৯টি ও গ্রামে ১৫৫টি। চতুর্থ প্রজন্মের ব্যাংকগুলোর মধ্যে সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংকের শহরের তুলনায় গ্রামে শাখা বেশি। ব্যাংকটির মোট ৫৩টি শাখার মধ্যে ২৭টি গ্রামে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদন পাওয়া নতুন ব্যাংকগুলোর সুনির্দিষ্ট কোনো দিকনির্দেশনা নেই।এছাড়া নতুন ব্যাংক হিসেবে তাদের কোনো নতুনত্বও নেই। তারা এখন পর্যন্ত বিশেষ কোনো পণ্য বাজারে আনতে পারেনি। গ্রাম পর্যায়ে শাখা করার কথা থাকলেও তেমন আগ্রহ নেই ব্যাংকগুলোর। এছাড়া তাদের কোনো সৃজনশীলতাও নেই। পুরনো ব্যাংকগুলোর মতোই আমানত সংগ্রহ করে ঋণ প্রদান করছে। তিনি বলেন, ব্যাংকগুলো পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা রয়েছে। ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে তেমন যাচাই-বাছাই করতে পারছে না। ফলে নানা অব্যবস্থাপনা অনিয়মে খেলাপি ঋণ বেড়ে যাচ্ছে। তাই নতুন ব্যাংকগুলোর বিভিন্ন কার্যক্রমের ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরদারি বাড়ানোর পরামর্শ দেন তিনি।এদিকে নতুন ব্যাংকগুলো কৃষি ও পল্লী ঋণ বিতরণেও পিছিয়ে পড়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চলতি (২০১৬-১৭) অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসের (জুলাই-নভেম্বর) প্রতিবেদনে দেখা গেছে, চলতি অর্থবছর ফারমার্স ব্যাংকের ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে ১০৫ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে এ ব্যাংক কৃষি খাতে মাত্র দেড় কোটি টাকা বিতরণ করেছে, যা ব্যাংকটির লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ১ দশমিক ৪৩ শতাংশ।এ সময় মেঘনা ব্যাংক লক্ষ্যমাত্রার ১৯ দশমিক ৩৯ শতাংশ, এনআরবি কমার্শিয়াল ছয় দশমিক ১০, মধুমতি ব্যাংক এক দশমিক ১০, ইউনিয়ন ব্যাংক দশমিক ৮০, এনআরবি গ্লোবাল ৮ দশমিক ৯৪ ও সাউথ বাংলা ব্যাংক ২৩ দশমিক ৩৮ শতাংশ কৃষিঋণ বিতরণ করেছে। তবে মিডল্যান্ড ব্যাংক লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি ঋণ বিতরণ করেছে। পুরো অর্থবছরের জন্য ব্যাংকটির বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪৫ কোটি টাকা। আর গেল পাঁচ মাসেই ব্যাংকটি বিতরণ করেছে ৫৮ কোটি ২৭ লাখ টাকা।মেঘনা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ নূরুল আমিন জাগো নিউজকে বলেন, নতুন ব্যাংকগুলোকে যেসব বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে অনুমোদন দেয়া হয়েছে তা অবশ্যই পালন করা উচিত। তবে আমরা যে কাজ করছি না এটা বলা ঠিক নয়। আমরা একেবারে নতুন কিছু না করতে পারলেও কাজে কিছুটা ভিন্নতা আনার চেষ্টা করছি। আমাদের সবচেয়ে বড় অর্জন শুরু থেকেই গ্রামের মানুষের কাছে পৌঁছাতে পেরেছি। এক্ষেত্রে অন্য ব্যাংকগুলোর সময় লেগেছে ২৫ থেকে ৩০ বছর। তিনি বলেন, একদিকে বাংলাদেশের মার্কেট ছোট, অন্যদিকে ব্যবসার শুরুতে আমাদের মূলধন বেশি লেগেছে। সব কিছু বিবেচনায় নতুন ব্যাংকগুলোর কিছুটা চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছে। তারপরও তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগ, নারীদের স্বল্প সুদে ঋণ প্রদানসহ নতুন ব্যাংকগুলো বেশকিছু কাজে ভিন্নতা নিয়ে আসছে। তবে নানা কারণে প্রত্যাশা অনুযায়ী কাজ করতে না পারলেও আমাদের চেষ্টা অব্যাহত আছে বলে জানান নতুন ব্যাংকের এ এমডি। এদিকে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে ব্যাংকগুলো আগ্রাসী ব্যাংকিং করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বেশি মুনাফার আশায় যাচাই-বাছাই না করেই দেয়া হচ্ছে ঋণ। ফলে বাড়ছে খেলাপির পরিমাণ। খেলাপি ঋণের ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তৈরি (এপ্রিল-জুন ২০১৬) হালনাগাদ প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত নতুন ৯টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে মোট ৩৯৩ কোটি ৩১ লাখ টাকা। এর আগে মার্চের শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ২২৪ কোটি ৯০ লাখ টাকা। সে হিসাবে তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৬৪ কোটি ৪১ লাখ টাকা।এ কারণে নতুন ৯ ব্যাংককে আগ্রাসী ব্যাংকিং না করতে সতর্ক করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। একইসঙ্গে অসুস্থ প্রতিযোগিতা বন্ধ করে খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনার তাগিদ দেয়া হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে নতুন ব্যাংকগুলো কিছু কিছু অনিয়ম করেছে, যা বাংলাদেশ ব্যাংকের নজরে এসেছে। সেগুলো থেকে উত্তরণের নির্দেশনাও প্রদান করা হয়েছে। একইসঙ্গে তারা যেন বুঝে শুনে ঋণ বিতরণ করে সে বিষয়ে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।রাজনৈতিক বিবেচনায় ২০১২ সালে অনুমোদন দেয়া হয় চতুর্থ প্রজন্মের ৯টি নতুন ব্যাংক। ব্যাংকগুলোর মধ্যে প্রবাসী বাংলাদেশিদের উদ্যোগে তিনটি, এনআরবি, এনআরবি গ্লোবাল ও এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক। বাকি ছয়টি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেছেন দেশীয় উদ্যোক্তারা। এগুলো হলো- ইউনিয়ন, মেঘনা, মিডল্যান্ড, মধুমতি, দ্য ফারমার্স ও সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক।এসআই/ওআর/আরআইপি
Advertisement