ডিজিটাল দেশ গড়ার লক্ষ্যে ও স্বচ্ছতা নিশ্চিতে সব সরকারি কেনাকাটার দরপত্রে ই-টেন্ডারিং পদ্ধতি চালুর নির্দেশ দেয়া হয় সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে। ২০১৬ সালের মধ্যে এ কার্যক্রম বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেয়া হলেও বছর শেষে আশানুরূপ ফল মেলেনি। সব দায়িত্ব বুঝিয়ে দেয়ার পর এখনও অনেক প্রতিষ্ঠানেই এ পদ্ধতি চালু হয়নি। জানা গেছে, সরকারি ক্রয়ে কাগজের টেন্ডারে ব্যাপক দুর্নীতি, অনিয়ম, সন্ত্রাস ও টেন্ডারবাজির অভিযোগ ওঠায় তা ঠেকাতে ই-টেন্ডারিংয়ের উদ্যোগ নেয় সরকার। এছাড়া স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে দরপত্র প্রস্তাব, মূল্যায়ন, চুক্তি ব্যবস্থাপনা ও ইলেক্ট্রনিক পেমেন্টসহ সংশ্লিষ্ট অনেক কাজই স্বল্প সময়ে খুব সহজে সম্পাদন হবে। আবার এটি বাস্তবায়ন হলে দেশ ডিজিটালের পথে আরো এক ধাপ এগিয়ে যাবে। এমনটাই আশা ছিল সংশ্লিষ্টদের। কিন্তু বাস্তবে এর প্রতিফলন তেমন ঘটেনি। ই-টেন্ডারে না যাওয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে দুর্নীতিকেই দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, এ পদ্ধতিতে দুর্নীতির কোনো সুযোগ নেই। আর কাগজের টেন্ডারে নিজেদের পছন্দের ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে অনিয়মের মাধ্যমে কাজ দেয়া যায়। এ কারণেই প্রতিষ্ঠানগুলো ই-টেন্ডারে যাচ্ছে না। জানা গেছে, সাধারণ টেন্ডারে অনেক সময় প্রভাবশালী বা ক্ষমতাসীন দলের লোকজনের বাধার কারণে সাধারণ ঠিকাদাররা টেন্ডার ড্রপ করতে পারেন না। এনিয়ে বিভিন্ন সময় সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে। আর ই-টেন্ডারিংয়ের মাধ্যমে যে কেউ দেশ কিংবা দেশের বাইরে থেকেও অনলাইনের মাধ্যমে কাগজপত্র জমা দিতে পারেন, এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। এতে বাধা দিয়ে কাউকে টেন্ডার থেকে বিরত রাখা কিংবা দুর্নীতির কোনো সুযোগ নেই। ২০১১ সালের ২ জুন এ প্রক্রিয়ার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিশ্বব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় প্রকল্পটি হাতে নেয় পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়। তখন স্বল্প পরিসরে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর, সড়ক ও জনপথ অধিদফতর, বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডে পরীক্ষামূলকভাবে ই-টেন্ডারিং কার্যক্রম শুরু করে। এতে দরপত্র আহ্বান থেকে শুরু করে ওয়ার্ক অর্ডার পর্যন্ত সব কিছুই অনলাইনে সম্পন্ন হয়। পরে আরো ১০০টি সংস্থাকে এ পদ্ধতির আওতায় আনার জন্য কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণসহ প্রয়োজনীয় কাজ সম্পন্ন করা হয়। এতে সময় লাগে পাঁচ বছর। তবে গত বছরের শুরুতেই অন্যান্য সব সংস্থা ই-টেন্ডারে আনার রোডম্যাপ করে সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিট (সিপিটিইউ)। তারা ২০১৬ সালের মধ্যেই দেশের মোট ১২০০ সংস্থায় পুরোপুরি ই-টেন্ডারিং চালুর সিদ্ধান্ত নেয়। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ও বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে তদারকি করছে। বিভিন্ন সময়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়েও এ নিয়ে একাধিক বৈঠক হয়েছে। সিপিটিইউর শীর্ষ কর্মকর্তারাও সংশ্লিষ্টদের প্রশিক্ষণের জন্য তৃণমূলে গেছেন। কিন্তু বছর শেষে তা বাস্তবায়নের সংখ্যা শূন্যই রয়ে গেছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১৫ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি মন্ত্রিসভার বৈঠকে দেশের সব সরকারি ক্রয়ে ই-টেন্ডারিং পদ্ধতি অনুসরণের নির্দেশনা দেয়া হয়। একই বছরের ৬ আগস্ট ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ টাস্কফোর্স’র সভায় ২০১৬ সালের মধ্যে সব সরকারি ক্রয় ইলেক্ট্রনিক গভর্মেন্ট প্রকিউরমেন্টের (ই-জিপি) আওতায় আনার সিদ্ধান্ত হয়। পরে একই বছরের ১৬ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিবের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় দেশের সব মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থাকে ই-জিপির আওতায় আনার কর্মপরিকল্পনা নেয়া হয়। কর্মকর্তা ও দরদাতাদের ই-জিপি প্রশিক্ষণও এ পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী ২০১৬ সালের ১৭ নভেম্বর পর্যন্ত ৬৫১টি মন্ত্রণালয়, বিভাগ বা সংস্থা ইলেক্ট্রনিক গভর্মেন্ট প্রকিউরমেন্টের (ই-পিজি) অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। প্রকল্পটি চালুর পর থেকে ব্যাপক সাড়া পড়ে। ই-জিপিতে অন্তর্ভুক্ত মন্ত্রণালয় বা সংস্থার দুই কর্মকর্তাকে একদিনের এবং ৫ ই-জিপি ব্যবহারকারী কর্মকর্তাকে তিনদিনের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। কিন্তু এতেও মেলেনি সফলতা। মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, ২০১২ সালের জুনে ই-জিপির আওতায় আহ্বান করা দরপত্রের সংখ্যা ছিল ১৪। ২০১৩ সালের জুনে ৪৯৮। ২০১৪ সালের জুনে ৮ হাজার ৪৩৬। ২০১৫ সালের জুনে ২৬ হাজার ১০২টি। ২০১৬ সালে বেড়েছে এর দ্বিগুণ। কিন্তু এরপরও প্রতিটি প্রতিষ্ঠান এর আওতায় আসেনি। এজন্য ক্ষোভ প্রকাশ করেছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। গত ২০ ডিসেম্বর পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ থেকে দেশের সব প্রতিষ্ঠানকে চিঠি দেয়া হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, ২০১৪ সালের ৬ অক্টোবর থেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে ই-টেন্ডারিংয়ের জন্য অনলাইনে একসেজ (অনুমিত) দেয়া ও পরবর্তীতে কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দেয়ার পর দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হলেও আপনার মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও অধিনস্থ দফতরের ই-জিপিতে দরপত্র আহ্বান ‘শূন্য’ প্রদর্শিত হচ্ছে। এতে ই-জিপিতে সরকারি ক্রয় বাস্তবায়নে সরকারের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ব্যাহত হচ্ছে। এ অবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়কে অবহিতের জন্য পরবর্তী সাত কার্যদিবসের মধ্যে সরকারি ক্রয় ই-জিপিতে প্রক্রিয়াকরণ না করার কারণ জানাতে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে যারা এখনো এ প্রশিক্ষণ নেয়নি তাদের সংস্থা প্রতি পাঁচ কর্মকর্তাকে প্রশিক্ষণের জন্য পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সিপিটিইউ মনোনয়নপত্র পাঠাতে বলা হয়েছে।এ বিষয়ে সিপিটিইউ মহাপরিচালক ফারুক হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতামূলক ও দুর্নীতিমুক্ত টেন্ডার ব্যাবস্থা নিশ্চিত করতে ই- টেন্ডারিংয়ের বিকল্প নেই। যেসব প্রতিষ্ঠান এখনো পুরোপুরি কিংবা মোটেও ই-টেন্ডারিংয়ের আওতায় আসেনি তাদের চিঠি দেয়া হয়েছে।এমএসএস/এএইচ/এমএমজেড/এমএস
Advertisement