‘চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধা সন্তান ও নাতি-নাতনিদের কোটা সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা হচ্ছে না। কোটানীতির বাস্তবায়ন হচ্ছে না যথাযথভাবে, যা প্রকৃতপক্ষে মুক্তিযোদ্ধাদের অধিকারকে ক্ষুণ্ন করে বর্তমান সরকারের আদেশের প্রতি অসম্মান দেখানো।’ এমনই ভাষায় ক্ষোভ জানিয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ও সিনিয়র সচিবের দফতরে ডিও (আধা-সরকারিপত্র) দিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আকম মোজাম্মেল হক।উপযুক্ত প্রার্থী সংকট ও আইনগত কারণে মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের কোটার পদ শূন্য থাকার বিষয়টি স্বীকার করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী বলেন, যোগ্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে পদ খালি রাখার সিদ্ধান্ত রয়েছে। তবে বিষয়টি নিয়ে সম্প্রতি একটি বৈঠক হয়েছে, সেখানে এ নিয়ে আলোচনাও হয়েছে। তবে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তারপরও বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে আমলে নিয়ে সম্প্রতি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে চিঠি দিয়েছে। তাতে বলা হয়েছে- ‘মুক্তিযোদ্ধা সন্তান এবং নাতি-নাতনিদের জন্য সংরক্ষিত ৩০% কোটা সঠিকভাবে পূরণ করে নিয়োগের তালিকা মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করতে হবে।’ পাশাপাশি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে অবহিত করারও নির্দেশ দেয়া হয় চিঠিতে। জানা গেছে, সরকারি সব ধরনের চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা সন্তান ও নাতি-নাতনিদের কোটা পূরণে যোগ্য প্রার্থী পাওয়া যাচ্ছে না। এ নিয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন পদস্থ কর্মকর্তা বলেন, আওয়ামী লীগের (১৯৯৬-২০০১) এবং বিএনপি-জামায়াত জোটের (২০০১-২০০৬) শাসনামলে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় উপযুক্ত প্রার্থী না পাওয়া গেলে মেধা কোটা থেকে নিয়োগের বিধান ছিল। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, বিসিএস ২১তম ব্যাচের প্রশাসন ক্যাডারের পদ ছিল ২০০টি। এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের জন্য সংরক্ষিত ছিল ৬০টি পদ। এ কোটায় উপযুক্ত প্রার্থী না থাকায় মৌখিক পরীক্ষার মুখোমুখি হয়েছিলেন মাত্র ৪৯ জন প্রার্থী। এর মধ্য থেকে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে চূড়ান্তভাবে নিয়োগ পান ৪৬ জন। ফলে প্রার্থী সংকটের কারণে ১৪টি পদ শূন্যই থাকে। তৎকালীন নিয়ম অনুযায়ী শূন্য ওই পদগুলো মেধা কোটা থেকে পূরণের সুপারিশ করে বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশন (পিএসসি)। পরে ওই ১৪ জনসহ প্রশাসন ক্যাডারের ২০০ জনের নিয়োগ সম্পন্ন করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।ওই কর্মকর্তা আরও জানান, একই অবস্থা ছিল বিসিএস ২০তম ব্যাচের ক্ষেত্রেও। প্রশাসন ক্যাডারের মুক্তিযোদ্ধা কোটায় পদ ছিল ৯০টি। এর মধ্যে মৌখিক পরীক্ষা দিয়েছিল ৭৪ জন। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে চূড়ান্ত নিয়োগের সুপারিশ পেয়েছিল ৬২ জন। এ কারণে শূন্য থাকে মুক্তিযোদ্ধা কোটার বাকি পদগুলো। পরে তা মেধা তালিকায় শীর্ষে থাকা প্রার্থীদের দ্বারা পূরণ করা হয়েছিল। ফলে চাহিদাকৃত পদ শূন্য থাকত না।মুক্তিযোদ্ধা কোটায় উপযুক্ত প্রার্থী সংকটের কথা স্বীকার করে সরকারি কর্মকমিশনের (পিএসসি) সচিব মো. শাহজাহান আলী মোল্লা বলেন, কয়েকদিন আগে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আমাদের একটি বৈঠক হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, পদ খালি রাখা হলে প্রশাসন চালানোতে সমস্যা হয়। বিষয়টি নিয়ে সরকারের শীর্ষপর্যায়ে আলোচনা করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।সূত্র জানায়, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালের ১৮ অক্টোবর তৎকালীন সংস্থাপন মন্ত্রণালয় অফিস আদেশ জারি করে। তাতে বলা হয়, ‘সরকারি ও আধাসরকারি দফতর, স্বায়ত্তশাসিত, আধাস্বায়ত্তশাসিত সংস্থা, প্রতিষ্ঠান ও কর্পোরেশনে চাকরিতে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধা এবং উপযুক্ত মুক্তিযোদ্ধা প্রার্থী না পাওয়া গেলে তাদের পুত্র ও কন্যা সন্তানের অনুকূলে ৩০% কোটা সংরক্ষণ করা হয়েছে। বিষয়টি বাধ্যতামূলক করা হয়েছে উল্লেখ করে আদেশে বলা হয়, কোনো অবস্থাতেই ওই কোটার কোনো যোগ্য প্রার্থী এ সুযোগ থেকে বঞ্চিত না হন।’ পরবর্তীকালে মেধা তালিকার মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধা কোটার শূন্যপদ পূরণের বিধান বাতিল করে ২০১০ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি সরকারি আদেশ জারি করা হয়। নতুন আদেশে বলা হয়, ‘সরকারি, আধাসরকারি দফতর, স্বায়ত্তশাসিত, আধাস্বায়ত্তশাসিত সংস্থা, প্রতিষ্ঠান ও কর্পোরেশন, বিচার বিভাগীয় পদ পূরণের ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য নির্ধারিত কোটা পূরণ করা সম্ভব না হলে ওই পদগুলো খালি রাখিতে হবে।’ এরপর থেকেই মূলত পদ শূন্য থাকতে শুরু করে এবং নানা ধরনের অভিযোগ উঠতে শুরু করে।পিএসসি সূত্র জানায়, উপযুক্ত প্রার্থী সংকটের কারণে ৩১তম বিসিএসে মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের কোটাসহ বিভিন্ন ক্যাডারের ৭৭৩টি পদে নিয়োগ দেয়া সম্ভব হয়নি। এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা সন্তান ও নাতি-নাতনিদের পদ ছিল ৩৭২টি। পরে এসব পদ ৩২তম বিশেষ বিসিএসের মাধ্যমে পূরণ করা হয়। সর্বশেষ ৩৩তম বিসিএসেও একই পরিস্থিতি বিদ্যমান ছিল। যোগ্য প্রার্থী না পাওয়ায় মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের কোটাসহ বিভিন্ন ক্যাডারে ৪৭৪টি পদে নিয়োগ দেয়া সম্ভব হয়নি। পরে মেধা তালিকায় শীর্ষে থাকা প্রার্থী নিয়ে ওই সব পদ পূরণের জন্য ২০১৩ সালের ২ মে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় বিশেষ প্রজ্ঞাপন জারি করে। পরে ওই ৪৭৪টি পদসহ কারিগরি ক্যাডারের মোট ৩ হাজার ৩৭৪টি পদ পূরণ করা হয় মেধা তালিকা থেকে।সরকারকে কোটা পদ্ধতির বিষয়ে সামগ্রিকভাবে মূল্যায়ন করার পরামর্শ দিয়েছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও মন্ত্রিপরিষদ সচিব ড. আকবর আলী খান। তিনি বলেন, শুধু মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের কোটা নিয়ে কথা বললে হবে না। কোটা পদ্ধতির বিষয়ে পুনঃমূল্যায়ন প্রয়োজন।অপর সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার্রৃ বলেন, সরকারি নিয়োগের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সময় দেখা গেছে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় উপযুক্ত প্রার্থী পাওয়া যাচ্ছে না। গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ৩ লাখেরও কম। তাদের পোষ্য ১০ লাখের বেশি নয়। তাদের জন্য ৩০ শতাংশ কোটা সংরক্ষণ করার অনেক বেশি। যেহেতু উপযুক্ত প্রার্থী পাওয়া যাচ্ছে না তাই এ কোটা কমানো বা যৌক্তিকীকরণ প্রয়োজন। এসএইচএ/এমএস
Advertisement