মতামত

বৃদ্ধাশ্রমের মায়ের চিঠি

সন্তানের উদ্দেশ্যে লেখা বৃদ্ধাশ্রমে ৬ বছর ধরে বসবাসরত ৮০ বছরের বৃদ্ধা অসহায় মায়ের চিঠিটা দিয়েই শুরু করতে চাইছি। “ বাবা.. আমার আদর, ভালোবাসা নিও। অনেক দিন তোমাকে দেখি না, আমার খুব কষ্ট হয়। কান্নায় আমার বুক ভেঙে যায়। আমার জন্য তোমার কী অনুভূতি আমি জানি না। তবে ছোটবেলায় তুমি আমাকে ছাড়া কিছুই বুঝতে না। আমি যদি কখনও তোমার চোখের আড়াল হতাম মা মা বলে চিৎকার করতে।  মাকে ছাড়া কারও কোলে তুমি যেতে না।  সাত বছর বয়সে তুমি আমগাছ থেকে পড়ে হাঁটুতে ব্যথা পেয়েছিলে। তোমার বাবা হালের বলদ বিক্রি করে তোমার চিকিৎসা করিয়েছেন। তখন তিন দিন, তিন রাত তোমার পাশে না ঘুমিয়ে,  না খেয়ে, গোসল না করে কাটিয়েছিলাম। এগুলো তোমার মনে থাকার কথা নয়। তুমি একমুহূর্ত আমাকে না দেখে থাকতে পারতে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমার বিয়ের গয়না বিক্রি করে তোমার পড়ার খরচ জুগিয়েছি। হাঁটুর ব্যথাটা তোমার মাঝে মধ্যেই হতো। এখনও কি তোমার সেই ব্যথাটা আছে?  রাতের বেলায় তোমার মাথায় হাত না বুলিয়ে দিলে তুমি ঘুমাতে না। এখন তোমার কেমন ঘুম হয়? আমার কথা কি তোমার একবারও মনে হয় না?  তুমি দুধ না খেয়ে ঘুমাতে না। তোমার প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই।  আমার কপালে যা লেখা আছে হবে। আমার জন্য তুমি কোনো চিন্তা করো না।  কেবল তোমার চাঁদ মুখখানি দেখতে আমার খুব মন চায়। তোমার কাছে আমার শেষ একটা ইচ্ছা আছে। আমি আশা করি তুমি আমার শেষ ইচ্ছাটা রাখবে।  আমি মারা গেলে বৃদ্ধাশ্রম থেকে নিয়ে আমাকে তোমার বাবার কবরের পাশে কবর দিও। এজন্য তোমাকে কোনো টাকা খরচ করতে হবে না। তোমার বাবা বিয়ের সময় যে নাকফুলটা দিয়েছিল সেটা আমার কাপড়ের আঁচলে বেঁধে রেখেছি। নাকফুলটা বিক্রি করে আমার কাফনের কাপড় কিনে নিও।  (ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)দুই.জীবনের মূল্য কত? চোখ বন্ধ করলে কিছুই সাথে নিতে পারবেন না। কিসের অহঙ্কার আপনার? ক্যারিয়ার, সঞ্চয় বৃদ্ধির মোহে জীবনটাই শেষ করে দিলেন। আপনার আয় কম, স্ত্রীর সাথে বোঝাপড়া হয় না, ঘরের জায়গা কম, সন্তানের পড়ালেখায় সমস্যা হয়, এইসব অজুহাতে আপনি আপনার মাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসলেন। আপনার পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ আপনি হেলায় হারিয়ে ফেলছেন। ভালোবাসা সবসময় নিম্নগামী। আপনার জন্য আপনার মায়ের যে অনুভূতি, আপনার প্রতি আপনার সন্তানেরও সেই পরিমাণ অনুভূতি নেই। অন্যদের কথা বস্তায় ভরে রাখুন।আজ আপনি দামী গাড়ি চড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। স্ত্রী, সন্তানসহ বিভিন্ন পর্যায়ের আত্মীয় স্বজন নিয়ে দেশ বিদেশে নিয়মিত যাতায়াত। বড্ড বেমানান লাগে বৃদ্ধা মাকে সাথে নিতে। অনেক তথাকথিত উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিত্ত্ব মা বেঁচে আছেন, সে কথা বলতেই লজ্জা পান। আবার পরিচয় করিয়ে যদি দেয়া লাগে। মাঝে, মাঝে মনে হয় আমাদের মায়েরা সন্তান মানুষ করতে গিয়ে বড় ধরনের ভুল করে থাকেন। সন্তানের জন্য এত কষ্ট করার কি দরকার। লেখাপড়া না শিখিয়ে যদি ছোটবেলায় কৃষি কাজে কিংবা কারখানার কাজে লাগিয়ে দিতেন, তবে সন্তান অন্তত নিজের মায়ের পরিচয় দিতে লজ্জা পেত না।  তিন.তৎকালীন অলীদের সরদার হযরত বায়েজীদ বোস্তামী (রহঃ) বলেন, আমার যতটুকু যা সম্মান ও মর্যাদা তা আমার মায়ের আন্তরিক আশীর্বাদেরই ফল। একদা বায়েজীদ (রহঃ) এর মা শয্যায় শায়িত ছিলেন। ঘরের দরজা খোলা ছিল। ঠাণ্ডা বাতাস ঘরে প্রবেশ করার কারণে তিনি বায়েজীদকে ঘরের একটি দরজা বন্ধ করতে বলে ঘুমিয়ে পড়লেন। বায়েজীদ (রহঃ) তখন দুখানি দরজার সমস্যায় পড়ে গেলেন। কিন্তু মায়ের কাছে জিজ্ঞেস করতে গেলে তার ঘুম ভাঙাতে হবে। এই চিন্তা করে বায়েজীদ (রহঃ) কিছু সময় একটি দরজা খুলে অন্যটি বন্ধ করে রাখলেন এবং কিছু সময় পর বিপরীত দরজা বন্ধ করে অন্যটি খুলে রাখলেন। দরজায় এভাবে সারা রাত কাটিয়ে দেবার পর মা ঘুম থেকে উঠে বায়েজীদ (রহঃ) কে এই অবস্থায় দেখে জিজ্ঞেস করলেন, বায়েজীদ! তুমি এমন করছ কেন? তখন বায়েজীদ (রহঃ) মায়ের কাছে ব্যাপারটি খুলে বলার পর মা খুশি হয়ে তাঁর সন্তানের জন্য আল্লাহর দরবারে দোয়া করলেন। হযরত বায়েজীদ বোস্তামী (রহঃ) বলেন, মায়ের হৃদয়ের সেই অকপট মনের দোয়া হয়ত আল্লাহর দরবারে সঙ্গে সঙ্গে কবুল হয়েছিল।চার.একটি অনলাইন নিউজ পোর্টালে প্রকাশিত আরেকটি মায়ের চিঠির উল্লেখযোগ্য কিছু অংশ তুলে ধরছি। “বাবা, আমার বুকের ভেতর কেমন হু হু করে উঠছে! তুই কি ভালো নেই বাবা! তুই ভালো থাকবি বলেই তো বৃদ্ধাশ্রমের এই চার দেয়ালের মধ্যে আমাকে রেখে গেলি। তারপর আর কোন দিন তোর মায়াচ্ছন্ন মুখটা দেখিনি। এখনো রোজ ওই পথের দিকে চেয়ে থাকি, কখন তুই একটু আসবি। তোর দাঁতের ব্যথা কি ভালো হয়নি বাবা! একদিন মাঝ রাতে হঠাৎ তোর দাঁতের ব্যথা উঠলো। মাঝরাতে অনেকটা দিশেহারা হয়ে তোর বাবার কবরের পাশে গিয়ে বুক চাপড়িয়ে কেঁদেছিলাম। পুতুল খেলার বয়স ফুরোনোর আগেই আমি বধূ হয়ে এসেছিলাম । তারপর একদিন হঠাৎ তোর বাবা আমাকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেলো না ফেরার দেশে। বহুদিন হলো তোর বাবাকে স্বপ্নে দেখিনা। কাল শনিবার। তোর বাবার মৃত্যু দিবস। সুযোগ হলে দু’জন মিসকিন দাওয়াত করিস। এখানে আমার আর ভালো লাগে না বাবা! কয় দিন আর বাঁচবো- আমি তো মৃত্যুর বয়সের কাছাকাছি। চোখে ঝাঁপসা দেখি। হাঁটা চলা করতে পারি না। কথাবার্তা এলোমেলো হয়ে গেছে। আমি আর আগের মতো খেতে পারি না। আধাপোয়া চাল হলেই পুরো দিন চলে যায়। সাথে চেপা শুঁটকি ভর্তা হলে আর কিছুই লাগে না। আমার কোনো বাড়তি চাহিদা নেই। আগে পান খেতাম। ওটাও ছেড়ে দিয়েছি। তোর সংসারে কি আমার জন্য দিনে আধাপোয়া চালের জোগান হবে না? তোর বাবার ভিটায় ছয়তলা বিল্ডিং করেছিস। দু’তলায় তোরা থাকিস। বাকিগুলো ভাড়া। তোর ওই বিল্ডিং এর কোনো রুমে আমি উঠবো না। বাইরে একটা ছাপড়া করে দিস, ওখানেই থাকব। সকাল বিকাল তোকে দেখব। গভীর রাতে তুই বাড়ি ফিরলে তোর পায়ের আওয়াজ শুনতে পাবো।”পাঁচ.আধুনিকতার নামে আমরা সত্যিই অসভ্য, বর্বর হয়ে যাচ্ছি। সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট একটি রায় দিয়েছে, বৃদ্ধ এবং ছেলের ওপর নির্ভরশীল বাবা-মায়ের থেকে স্বামীকে নিয়ে আলাদাভাবে বসবাস করতে জোর করলে স্বামী বিবাহ বিচ্ছেদের মামলা করতে পারবেন। পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ হলে কোর্ট এই রায় দেয়, সেটা সহজেই অনুমেয়। আমাদের দেশেও ক্রমে বৃদ্ধাশ্রমের সংখ্যা বেড়ে চলেছে, যা কাম্য হতে পারে না। এখনও যেসব সন্তানের চিন্তা শক্তি নষ্ট হয়ে যায়নি, তারা তাদের অসহায় মায়ের কথা একটু চিন্তা করুন। বয়স কিন্তু কারো কমছে না। সন্তানকে মানুষ করতেই জীবনের মূল্যবান সময়গুলো মায়েরা ব্যয় করে থাকেন। আজ যখন সেই মা অসহায়, তাঁর জন্য আপনার কিছু সময় ব্যয় করতে এতো কার্পণ্য কেন?লেখক : উপ-পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক।riazul.bb@gmail.comএইচআর/পিআর

Advertisement