শারীরিক অসুস্থতার জন্য ২০০৮ সালে ছোট ভাই রাউল ক্যাস্ত্রোর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের পর থেকে প্রায় আড়ালেই ছিলেন ফিদেল ক্যাস্ত্রো। মাঝে মধ্যে দুয়েকবার জনসমক্ষে এলেও ফিদেল ক্যাস্ত্রো শারীরিকভাবে ভালো ছিলেন না। গোটা বিশ্ব এমন একটি শোকের জন্য একধরনের মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে অপেক্ষা করছিল। এটা আমরা সবাই জানি, মানুষের দৈহিক জীবনের অনিবার্য পরিণতি মৃত্যু। ৯০ বছর বয়সী একজনের মৃত্যু স্বাভাবিক হিসেবেই গণ্য হবে। তবুও ক্যাস্ত্রোর মৃত্যু যে হাহাকার বয়ে এনেছে, তা সামলানো সহজ নয়। ক্ষমতায় না থাকলেও শারীরিকভাবে বেঁচে আছেন, এটাই বিশ্বজুড়ে মুক্তিকামী মানুষের হৃদয়ে বিপ্লবের চেতনা জাগরুক রেখেছিল, নানা প্রতিকূলতায়ও ফিদেল ছিলেন বিপ্লবীদের অনুপ্রেরণার উৎস।নব্বইয়ের দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ধস নামে সমাজতান্ত্রিক বিশ্বেও। বিশ্বের নানা প্রান্তে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন হোঁচট খায়। বিশ্বের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়। এককেন্দ্রিক বিশ্বের নেতৃত্ব চলে যায় যুক্তরাষ্ট্রের হাতে। বিশ্বের নানা দেশে সন্ত্রাসী সংগঠন গঠন করে, আবার সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র কৌশলে গোটা বিশ্বকেই অস্থিতিশীল করে রাখে। এভাবেই ‘সাপ হয়ে দংশন করো, ওঝা হয়ে ঝারো’ নীতিতে নিজেদের ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করার পথে চলছে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের এই একাধিপত্যের বিরুদ্ধে যিনি একা প্রতিবাদের লাল ঝাণ্ডা উড্ডীন রেখেছিলেন, তিনি ফিদেল ক্যাস্ট্রো।১৯২৬ সালের ১৩ আগস্ট জন্মেছিলেন ফিদেল আলেসান্দ্রো কাস্ত্রো রুজ। যুক্তরাষ্ট্রের মদদে ক্ষমতায় থাকা বাতিস্তার বিরুদ্ধে লেখালেখি দিয়ে তার রাজনৈতিক চেতনার শুরু। তারপর সক্রিয় হন রাজনীতিতে। ১৯৫৩ সালে মনকাডা ব্যারাকে ব্যর্থ আক্রমণ দিয়ে আলোচনায় আসেন ক্যাস্ট্রো। এই ব্যর্থতাতেই লুকিয়ে ছিল ক্যাস্ট্রোর বিপ্লবের সাফল্যের বীজ। মনকাডা ব্যারাকে আক্রমণের পর গ্রেফতার হন ক্যাস্ট্রো। ছাড়া পেয়ে চলে যান মেক্সিকো। সেখানেই সংগঠিত হয়ে দেশে ফিরে আসেন এবং বাতিস্তা সরকারের বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী লড়াই শুরু করেন। ১৯৫৯ সালে ক্যাস্ট্রোর নেতৃত্বে পতন ঘটে বাতিস্তা সরকারের। ১৯৫৫ সালে বিশ্বের বিপ্লবের ইতিহাসে মহান ঘটনাটি ঘটে- আর্জেন্টাইন চে গুয়েভারার সাথে পরিচয় হয় ফিদেলের। এই দুই বিপ্লবী মানুষের সম্মিলিত শুভ আকাঙ্খার পরিণতিই কিউবা বিপ্লব। চিকিৎসক থেকে বিপ্লবীতে বদলে যাওয়া চে গুয়েভারাকে বলা হতো ‘ক্যাস্ট্রোর মস্তিষ্ক’।মহান বিপ্লবী ফিদেল ক্যাস্ট্রো শুধু কিউবা নয়, যুগে যুগে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন বিশ্বের কোটি কোটি মুক্তিকামী মানুষকে। ১৯৭৩ সালে আলজেরিয়ায় জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের সভায় বাংলাদেশের জাতির জনকের সাথে দেখা হয় কিউবার মহান নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রোর। বৈঠকের পর বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে ক্যাস্ট্রো বলেছিলেন, ‘আমি হিমালয় দেখিনি, কিন্তু শেখ মুজিবকে দেখেছি।’ ক্যাস্ট্রোর কণ্ঠে যেন অন্নদাশঙ্কর রায়- ‘যতদিন রবে পদ্মা মেঘনা গৌরী যমুনা বহমান।/ ততদিন রবে কীর্তি তোমার /শেখ মুজিবুর রহমান।’আমরা লিখছি বটে, ফিদেল ক্যাস্ট্রো মারা গেছেন। কিন্তু এ নিছকই শারীরিক মৃত্যু। ফিদেল ক্যাস্ট্রো কেবল একজন ব্যক্তি নন, বিপ্লবী চেতনার নাম। বিপ্লবী চেতনার কোনো মৃত্যু নেই। এই যে আমার জন্মের দুই বছর আগেই মারা গেছেন বিপ্লবী চে গুয়েভারা। কিন্তু গত ৫০ বছর ধরে বিপ্লবের প্রতীক হয়ে বিপ্লবী মানুষের হৃদয়ে বেঁচে আছেন চে গুয়েভারা। ষাটের দশক থেকেই বিশ্ব বুঁদ হয়ে আছে লেনিন, মার্কস, অ্যাঙ্গেলস, চে, ক্যাস্ট্রোর বিপ্লবী চেতনায়। আমরা খুব সৌভাগ্যবান যে আমরা বেঁচে ছিলাম ফিদেল ক্যাস্ট্রোর সময়ে। কোথাও কোথাও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের পতন ঘটেছে, চলে গেলেন শেষ বিপ্লবীও। তবুও বিপ্লবী চেতনার বিনাশ নেই, বিপ্লবীর মৃত্যু নেই। সভ্যতা যতদিন টিকে থাকবে, সাম্যের বিশ্ব গড়ার সংগ্রাম ততদিন চলবে। ততদিনই বেঁচে থাকবেন ফিদেল ক্যাস্ট্রো।২৬ নভেম্বর, ২০১৬এইচআর/এমএস
Advertisement