তোমাদের দেশের ছবিগুলো কি আসলে মিউজিক ভিডিও বানানোর সাথে কিছু গল্প দিয়ে দেয়? নাহলে নায়ক নায়িকা ঘরে বসে গল্প করছে, হঠাৎ এক দৌড়ে পার্কে গিয়ে নাচতে শুরু করে দেয় কেন? - না ঘরে তো জায়গা নাই, তাই। তো নায়ক নায়িকা নাচে, নিজেদের একান্তই রোমান্টিক মুহূর্ত; পেছনে চৌদ্দ গুষ্টি মিলে নাচে কেন? -এই আমরা খুব বন্ধুবৎসল, পরিবার কেন্দ্রিক তো, তাই।তোমাদের নায়িকা কাজের বেটি- ঘর মুছে, নায়ক রিক্সা চালায়; পরের দৃশ্যেই নায়িকা জজ ব্যারিস্টার, নায়ক কোটিপতি কেমনে হয়ে যায় ? -আরে নায়িকা নাইট শিফটে ল`কলেজে পড়তো, নায়ক স্মাগলিং করেছে বা লটারি জিতেছে। এতোসব তো দেখাতে হয় না। এইসব “বুঝে নিতে হবে” সিন, এইসবই তো টুইস্ট!এমন আজগুবি সব প্রশ্নের কাউন্টার এবং ততোধিক মর্মান্তিক উত্তর দেই ভিনদেশিদের। নিজে যতই সকালে উঠেই অনলাইনে দেশের পত্রিকা পড়ে দেশের গালিগালাজে সকালের মাউথ ওয়াশ সারি, অন্যের মুখে তো নিজের দেশের বদনাম সহ্য হয় না। কিছু একটা ভুজং ভাজং দিয়ে নিজের মেজাজ তিরিক্ষি করে ফিরি। মাথায় গ্রামোফোনের পিন আটকে থাকে, কেন ভারতীয় উপমহাদেশের সব সিনেমার জন্য এই একই প্রশ্ন প্রযোজ্য হলেও আমি এই দোষ আমি নিজের দেশের ঘাড়ে নিচ্ছি? মিশরীয়, আরবদের কাছে তুমুল জনপ্রিয় শাহরুখ খান। “ মাই নেইম ইজ খান” ছবিটার মধ্যে বিরাটসংখ্যক অভিবাসী মুসলমান নিজেদের খুঁজে পান। ( বিঃ দ্রঃ কিং খানের অতি অভিনয়, মাথা কাঁপানো, “কা ক্কক্ক-কিরন” মার্কা সংলাপ প্রক্ষেপণ আমার মত দুর্বল চিত্তদের জন্য নয়। তাই তাঁর এই ছবিও দেখি নাই, কাজেই নিজস্ব অভিমত দিতে পারছি না।)চায়নায় তরুণ সমাজ একটিই মাত্র ইন্ডিয়ান ছবি দেখেছে, “থ্রী ইডিয়টস”- অল টাইম মাস্ট ওয়াচে টাইটানিক, ফরেস্ট গাম্পের পাশে এই ছবির স্থান। আমার ক্লাসের চাইনিজ শিক্ষার্থীদের সবার কাছেই একই উত্তর পেয়েছি, চায়নায় বাচ্চাদের পড়াশোনার অমানুসিক চাপ, পোশাক সজ্জা সবকিছুতে মিলিটারি শাসনে হাঁপিয়ে ওঠা বাচ্চারা আমির খানের মুখ থেকে নিজেদের না বলা সব কথাগুলিই শুনতে পেয়েছে । এদিকে জাপানে সম্প্রতি সাড়া জাগিয়েছিল আশির দশকে পর্দা কাঁপানো অভিনেত্রী শ্রীদেবীর কাম ব্যাক ম্যুভি “ইংলিশ ভিংলিশ”। জনপ্রিয়তার চাপে শ্রীদেবী এই ছবির শোতে নিজেও এসেছিলেন জাপান। ছবির জনপ্রিয়তার কারণ? জাপানি স্ত্রীরা প্রধানত গৃহিনী। বাচ্চা বড় হয়ে প্রাইমারি বা জুনিয়র হাই স্কুলে গেলে কেউ কেউ পার্টটাইম অফিস সহকারী জাতীয় চাকরি করে, যেটাও খুবই বিরল। ঘরে থেকে সংসার সামলানো, বাচ্চা বড় করার যাপিত জীবনের অধিকারহীন জাপানি নারীরা “ইংলিশ ভিংলিশ” এর শশী চরিত্রে নিজেদেরকে খুঁজে পেয়েছ্নে। প্রাণিত হয়েছেন। ভারতে ১২৯ কোটি লোকের মার্কেট। অভিবাসীও অনেক। তাই সারা বিশ্বে এমন আগ্রাসন, তারা ভবিষ্যৎ সুপার পাওয়ার- এমন অনেক যুক্তি, সান্ত্বনা বাক্য আমরা অন্যের কাছে উচ্চারণ করে আসলে নিজেকেই শোনাই। বঙ্গবন্ধু বিদেশি সিনেমা আসা বন্ধ করেছিলেন দেশীয় সিনেমার উন্নয়নের জন্য। দেশীয় সকল নির্মাতাদের প্রতি পরম শ্রদ্ধা রেখেই জানতে ইচ্ছে করে কয়টা সিনেমা তৈরি হয়েছে ৪৫ বছরে তেমন উল্লেখ করার মতন? উপরন্তু, আজকে মনে হয়, প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন মার্কেটের কারণেই কি দেশী সিনেমার মৃত্যু হয়েছে! স্টার প্লাস বা ভারতীয় চ্যানেলের আগ্রাসনের তুমুল বিপক্ষে আমি। কারণ আমি নিজে দেখে নিজের ক্ষুদ্র দর্শকমেধার উপর নির্ভর করেই বলবো বাংলাদেশের নাটকের তুলনায় ভারতের নাটকের মান অনেক জীবন অঘনিষ্ট, অলিক, দুর্বল, ধীর গতির এবং বাণিজ্যিক চিন্তা থেকে অয্থা টেনে চুইংগামের মতো লম্বা করতে করতে ধৈর্য্যের অসীম পরীক্ষা। তবুও কি শুধু জৌলুশ, চাকচিক্য, ফ্যাশন দেখতেই আমাদের মেয়ে, ভাবী, মা, নানী, বুয়া সবাই বুঁদ হয়ে আছে? প্রথিতজনেরা বলে গেছেন কোন কিছু জনপ্রিয় হলে কেন তা জনপ্রিয় হলো তার সঠিক কারণ বের করতে না পেরে না বুঝে অনুসরণ ব্যর্থতার নতুন মাত্রা যোগ করবে কেবল। সিনেমা জগত নিয়ে এই হতাশার শুরু কি অবাধ বৈদেশিক সাংস্কৃতির প্রাপ্যতা দিয়েই? নাকি এসব ছিল আমাদের অনেক দিনের বিশাল এক শূন্যতার শূন্যস্থান পূরণ?- এসব নিয়ে বোধ করি অনেক আলোচনা, গবেষণাই হয়েছে। হতাশা ছাড়া আর কিছুই বাড়েনি। হতাশার এই নিকষ কালো মেঘের ফাঁকে সাম্প্রতিককালে কিছু মূল ধারার সুস্থ চলচ্চিত্র নির্মাণের সফলতায় আবার একটু একটু আশার কুসুম রোদ উঁকি দিচ্ছে। এখানে দুটি বিবেচ্য শব্দ; “মূলধারা”- পুর্ণদৈর্ঘ্য টেলিফিল্ম না। “সুস্থ চলচ্চিত্র” - যার উদাহরণ হূমায়ুন আহমেদের চলচ্চিত্র শুধু নয়, আমজাদ হোসেনের চলচ্চিত্রও আবশ্যিকভাবেই। যে ছবি দেখতে নিম্নবিত্তের পাশাপাশি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণিও হলমুখি হবে। শুনতে কটু, বলতে আরো কষ্টকর যখন পরীক্ষিত গুণী নির্মাতারা ভাল গল্পের অতি দুর্বল নির্মাণ, খাপছাড়া, অসংলগ্ন উপস্থাপনে দর্শকের আস্থার জায়গাটায় অজ্ঞাতসারেই আঘাত হানেন। হয়তো বহুলাংশে তিনি নিজেও আহত হন। কারণ একটা টিম ওয়ার্কে গোটা টিমের প্রফেশনালিজম লাগে, দলের মধ্যে হারমোনি লাগে। যেকোন এক বা একাধিক ক্ষেত্রে এর ঘাটতি অনেকখানি ছাপ ফেলে যায়। তবুও পরীক্ষিত নির্মাতাদের তো দক্ষতা আর মুন্সিয়ানাই এইসব ত্রুটিসহই ভাল কিছুর প্রসবে! খুব হতাশ করেছে “জালালের গল্প”, হতাশ করেছে “টেলিভিশন” এর মতো অত্যন্ত সুনির্মিতির সমাপ্তিটাও । অথচ সুদক্ষ পরীক্ষিত সেরা সুনির্মাতাদের নির্মাণ। বাকিগুলির হতাশা আর উল্লেখ করছিনা। মানুষের জীবনে হতাশা, কষ্ট স্থান কাল পাত্র ভেদে সবার নিজ নিজ জায়গায় কম বেশি আছেই। লুকোতে সক্ষমদেরটা দেখা যায় না কেবল। তাই সবাই জীবনের গল্পটাই দেখতে চায়, শেষে আনন্দ বেদনার একটা সুন্দর পরিসমাপ্তি চায়। শেক্সপিয়ারের নাটক দেখে কাঁদতে কেন ছুটে যায় লোকে, যুগে যুগে কালভেদে- এই গবেষণাতেও এই তথ্য বের হয়ে এসেছিল। কষ্ট জমে নীল হওয়া মন ব্যথাতুর কালো পর্দায় অন্যের দুঃখ দেখে সহমর্মিতা বোধ করে। সমব্যথী কষ্টে গলাগলি করে কাঁদতে সক্ষম হলে তার নিজের ভেতরের দুঃখটা বের হতে পারে। গলে বের হওয়া জমাট দুঃখে ব্যথায় নীল হওয়া মনটা আবার নতুন আশায় উদ্দীপিত হয়। ছবিটা ভালবেসে ফেলে। আর আজকে এই প্রসংগ উত্থাপনের দাবিদার অবশ্যই অন্যতম গুণী নির্মাতা অমিতাভ রেজার “আয়নাবাজি”র অভাবনীয় সাফল্য! এই সাফল্য ইঙ্গিত দেয় মানুষের জীবনের গল্পকে সুনির্মাণের মোড়কে ছুঁয়ে দিতে পারলে দর্শক অবশ্যই হলমুখি হবে। আবার বন্ধ হয়ে যাওয়া হলগুলো, জীবিকাগুলো বেঁচে উঠবে। ইঙ্গিত দেয় আমাদের সুস্থ জীবনের প্রতি আকুলতা। ইঙ্গিত দেয় আমাদের ছবির বহির্বিশ্বের ছবির সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় টিকে থাকার সামর্থ্যর ভ্রূণ জন্ম নেয়া। এমন ছবি, এমন নাটক জন্ম দিন, আমরা অগ্রিম টিকেট কেটে লাইন ধরে হলে যাব; নিজেদের চ্যানেলের প্রাইম টাইমে আমরা আবার “এইসব দিন রাত্রি”, “অয়োময়” , “ কোথাও কেউ নেই”-এর মতন অধীর আগ্রহে সব কাজ সেরে গোটা পরিবার টিভির সামনে আমাদের নিজেদের চ্যানেল দেখতে বসবো। আমরা অতীতের গল্প করবোনা, ভবিষ্যতের গল্প করবো। আশাজাগানিয়া আরো অনেক “আয়নাবাজি”র সাফল্য দেখে আশায় বুক বেঁধে ধরতে পারবো সর্বস্ব বাজি!লেখক : কলামিস্ট; প্রাক্তন রিসার্চ ফেলো, কিউশু বিশ্ববিদ্যালয়; বিভাগীয় প্রধান, বিজনেস প্ল্যানিং ডিপার্টমেন্ট, স্মার্ট সার্ভিস টেকনোলজিস কো. লিমিটেড, ফুকুওকা, জাপানneeta2806@yahoo.comএইচআর/এমএস
Advertisement