জাতীয় সংসদের সরকারি দলের একজন নারী সদস্য যেদিন সংসদে বঙ্গবন্ধুর খুনি ও যুদ্ধাপরাধীদের সব স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার প্রস্তাব করেন এবং সেই প্রস্তাব যখন সংসদে সর্বসম্মতভাবে গ্রহণ করা হয় তার দুদিন না যেতেই এই সংসদেরই আরেকজন সদস্য যুদ্ধাপরাধীদের ফুলের মালা দিয়ে আওয়ামী লীগে বরণ করে নিয়েছেন। এই স্ববিরোধী কর্মকাণ্ড আওয়ামী লীগকে কোথায় নিয়ে যাবে সেটা বোধকরি শেখ হাসিনা ছাড়া আর কেউ চিন্তা করেন না। তাই তিনি স্পস্ট নির্দেশ দিয়েছিলেন জামায়াতিদের যেন দলে না ভেড়ানো হয়। কিন্তু তার সেই নির্দেশও মানছেন না দলেরই ওইসব নেতারা। তাই প্রশ্ন জাগে শেখ হাসিনাও কী তাহলে তাদের কাছে অসহায় হয়ে আছেন?গত ২৯ সেপ্টেম্বরের খবর: সংসদে সরকারদলীয় সদস্য বেগম ফজিলাতুন্নেছা বাপ্পির ‘সংসদের অভিমত এই যে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকারীদের সকল স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হোক’ সিদ্ধান্ত প্রস্তাবটি সংশোধিত আকারে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। সংশোধনীতে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের সঙ্গে মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে জড়িতদের সব স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার প্রস্তাবটি সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। নূরজাহান বেগম, মো. মনিরুল ইসলাম ও সানজিদা খানম এ সংশোধনী প্রস্তাব করেন। পরে সংশোধিত আকারে উভয় প্রস্তাবই একসঙ্গে গৃহীত হয়। গত ১ অক্টোবরের খবর : চাঁপাইনবাবগঞ্জে বিএনপি, হেফাজত ও জামায়াত-শিবিরের আট শতাধিক নেতাকর্মী আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছে । চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে অনুষ্ঠানের আয়োজন করে তাদের দলে বরণ করে নেয় আওয়ামী লীগ । নাশকতার মামলার আসামিসহ হেফাজত ও জামায়াতের পাঁচশ`র বেশি নেতাকর্মী ও পৌর বিএনপির তিনশতাধিক নেতাকর্মী আওয়ামী লীগে যোগ দেন। যোগদানকারীদের মধ্যে রয়েছেন- জামায়াত নেতা আফরোজ জুলমাত, হেফাজত ও জামায়াত নেতা সোহরাব আলী। সদ্য আওয়ামী লীগে যোগদানকারী একাত্তরের আলবদর নেতা, চাঁপাইনবাবগঞ্জের হেফাজতে ইসলাম ও জামায়াত নেতা সোহরাব আলীর বিরুদ্ধে নাশকতাসহ ৫টি মামলা আছে। যার সবকটিতেই তাকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দিয়েছে পুলিশ। চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ইকবাল মাহমুদ খানের সভাপতিত্বে যোগদান সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন- জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সদর আসনের এমপি আব্দুল ওদুদ ।চাপাইনবাবগঞ্জের ওই সাংসদ জামায়াতিদের আওয়ামী লীগে ভেড়াতে সিদ্ধহস্ত হয়ে ওঠেছেন এরইমধ্যে। তিনি আগেও যুদ্ধাপরাধীদের কয়েকদফায় আওয়ামী লীগে ঠাঁই করে দিয়েছেন। গত ১২ মে চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও জামায়াত নেতা আফজাল হোসেন পিন্টুকে দলে টেনে নেন। যিনি ডজনখানেক মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি। এর কিছুদিন আগেও চাঁপাইনবাবগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় জামায়াত-বিএনপির হাজারখানেক নেতাকর্মী আওয়ামী লীগে যোগ দেন। দেখা গেছে ওই এলাকায় বিগত সময়ে যেসব জামায়াত নেতা হুকুম দিয়ে বা সরাসরি আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বাড়ি ঘর ভাংচুর করেছেন, তাদেরই আওয়ামী লীগে নেওয়া হয়েছে। শুধু চাপাইনবাবগঞ্জই নয় জামায়াতিদের আওয়ামী লীগের বুকে টেনে নেওয়ার দৃশ্য দেশের অনেক জায়গায় আমরা দেখেছি। কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের উপস্থিতিতেও আওয়ামী লীগকে জামায়াতিকরণের প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে দেখেছি। প্রশ্ন হলো, যেদিন সংসদে ফজিলাতুন্নেছা বাপ্পি সিদ্ধান্ত প্রস্তাবটি সংসদে উত্থাপন করলেন সেদিন কী চাঁপাইনবাবগঞ্জের সাংসদ আব্দুল ওদুদ সংসদে উপস্থিত ছিলেন? সংসদেতো সর্বসম্মতভাবেই ওই প্রস্তাব পাস হয়েছে। তাহলে ধরে নেওয়া যায় যুদ্ধাপরাধীদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার পক্ষে তিনিও সায় দিয়েছেন। তাহলে স্বাধীনতাবিরোধীদের তিনি কিভাবে দলে ভেড়ালেন? তিনি কি জামায়াতিদের সম্পদ রক্ষার দায়িত্ব নিয়েছেন? দেশজুড়ে জামায়াতে ইসলামীকে যখন নিষিদ্ধের দাবি ওঠেছে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ভেতর থেকেই যখন আইন করে জামায়াত নিষিদ্ধের কথা বলা হচ্ছে তখন দলে দলে জামায়াতিদের আওয়ামী লীগে জায়গা করে দেওয়া হচ্ছে। তাও আবার সেই সব জামায়াতি যারা ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ঠেকাতে জ্বালাও পোড়াও আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, যাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আছে, যাদের বিরুদ্ধে পুলিশ তদন্ত করে ঘটনার সত্যতা পেয়ে আদালতে অভিযোগপত্র দিয়েছে, যাদের বিরুদ্ধে বিচার চলছে। সেইসব জামায়াতিদের দলে নিচ্ছে যেসব আওয়ামী লীগার তারা কি দলীয় সভানেত্রীর নির্দেশ মানছেন? দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনার স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে, আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থক যথেষ্ট আছে, নতুন করে দলে লোক নেওয়ার দরকার নেই। গত বছর ৮ নভেম্বর গণভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে দলীয় নেতাকর্মীদের সতর্ক করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, বিএনপি-জামায়াত থেকে যারা আমার দলে আসতে চায়, তাদের আমরা নেব না। গ্রুপিংয়ে দল ভারী করতে অনেকে ভিন্ন দলের লোকজন দলে ভেড়ান। তারা (যোগদানকারী) আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে কলহ সৃষ্টি করে এবং পরবর্তী সময়ে দলের নেতা-কর্মীদের হত্যা করে। এর আগে জেলহত্যা দিবসের সমাবেশে তিনি বলেছিলেন, আওয়ামী লীগ এতটা দৈন্য হয়ে যায়নি যে, বিএনপি-জামায়াতের লোকজনকে দলে টানতে হবে। সুযোগসন্ধানী কেউ যেন দলে ঢুকতে না পারে সে ব্যাপারে দলীয় নেতাকর্মীদের সজাগ থাকার নির্দেশ দেন। এটা এখন স্পষ্ট শেখ হাসিনার এসব কথা দলের অনেক নেতাই গুরুত্ব দেননি। তারা নিজেদের স্বার্থে দলের মধ্যে জামায়াতিদের ঠাঁই দিচ্ছেন। আওয়ামী লীগের নীতি নির্ধারকদের নিশ্চয়ই জানা আছে দল বদল হলেও নীতি-আদর্শের পরিবর্তন হয় না। আর জামায়াতিদেরতো কোনদিনই সেই আদর্শে পরিবর্তন আসবে না। এখন জেল যাওয়া থেকে বাঁচতে হোক আর সম্পদ বাঁচাতে হোক অথবা আওয়ামী লীগের কিছু নেতাকে কিনে হোক যেভাবেই তারা দল পাল্টান না কেন সুযোগ পেলে ছোবল আওয়ামী লীগকেই দিবে। এটা জানার পরেও কেন কিসের বিনিময়ে ওইসব জামায়াতিরা আওয়ামী লীগে ঠাঁই পায়? দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনা তাহলে ঠিকই বলেছিলেন, “আওয়ামী লীগের সব নেতাকে কেনা যায়। এটাই সমস্যা। শেখ হাসিনা ছাড়া।”লেখক : সম্পাদক, ডিবিসি নিউজএইচআর/এমএস
Advertisement