বিখ্যাত এক গল্প আছে। জগদ্বিখ্যাত নাট্যকার জর্জ বার্নাডশ এবং আমেরিকান জনপ্রিয় নৃত্যশিল্পী এবং অনবদ্য সুন্দরী ইসাডোরা ডানকানকে নিয়ে। কোন এক পার্টিতে ইসাডোরা বার্নাডশ কে বলেছিল। “ধরুন আপনার আমার যদি বিয়ে হয়! তবে আমার রুপ আর আপনার বুদ্ধি পাবে আমাদের সন্তানেরা। তারা হবে পৃথিবীর বিখ্যাত সন্তান”। বার্নাডশ এর তড়িৎ জবাব ছিল, “যদি আমার রুপ আর আপনার বুদ্ধি পায়?” এই গল্পটার সত্যতা জানা নেই। ১৯২৩ সালে বোস্টন গ্লোব নিউজপেপারে এরকম একটা গল্প ছাপানো হয়। সেই থেকে দেখতে ‘অপূর্ব সুন্দরী মেয়েদের বুদ্ধি কম’ এর উদাহরণ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত পেয়েছে এই কৌতুকটি। আজকাল বাংলাদেশের বিভিন্ন অনলাইন পোর্টালে এই কৌতুকটি নতুন ফর্মে আইনস্টাইন এবং মেরিলিন মনরোকে নিয়ে লেখা হয়। কিন্তু তারা একটু নেট ঘাটাঘাটি করলেই জানত, মেরিলিন মনরোর আইকিউ ১৬৮ যা আইনস্টাইনের চাইতেও বেশি! সেদিন এক সহকর্মীর কাছে পেনড্রাইভে একটা সফটওয়ার নিচ্ছিলাম। আমাকে জিজ্ঞেস করা হল, ‘কম্পিউটার টা কি?’ আমি সফটওয়ার এর জন্য প্রয়োজনীয় র্যাম কত লাগবে সেই উত্তর দিলাম! প্রশ্নটা আমি বুঝি নি! তারা কনফিগারেশন কি সেটা জানতে চেয়েছিল না কম্পিউটারের ব্র্যান্ড? তারা সেটা স্পষ্ট করে না বলে আমার দিকে তাকিয়ে একটা বিদ্রুপ হাসি দিল। আর বলল, “কম্পিউটারটার কালার কি? পিংক না কালো?” নয়া জামানার নয়া কৌতুক! মেয়েরা তাদের কম্পিউটার এর কনফিগারেশন বুঝে না। বুঝে সেটার কালার! অথচ আমার এমআইএসটিতে ছেলের চাইতে বেশি মেয়ে ছিল কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টে। আমি এরকম ডজন খানেক কৌতুক দেখাতে পারব যেখানে মেয়েদের ক্ষমতা, না বোঝা কিংবা হাঁটুতে তাদের বুদ্ধি থাকে এইসব বিষয় নিয়ে কথা বলা হয়েছে। কৌতুক আনন্দের জিনিস। আনন্দ পেতেই ভালো লাগে। কিন্তু জোকসের প্যাকেটে কি দিচ্ছি আমরা সেটা কি ভেবেছি? সেক্সিজম এর জয়গান গাচ্ছি! নারী কিচ্ছু পারে না তার উদাহরণ দেখাচ্ছি। বাড়ির বউ আমাদের কাছে শুধুই জোকসের বিষয়বস্তু হয়ে উঠছে। আমি বহু ছেলেকে তাদের গার্লফ্রেন্ড এর ব্যাপারে বলতে শুনেছি, “ ঐ পড়াশুনা বেশি পারে না বুঝলি। ইন্টার কোন মতে পাস করুক। তারপর বিয়ের কথা বলব পরিবারে”। আমার মনে হয়েছে বিয়ে করে উদ্ধার করছে সে ‘কম পড়াশুনা পারা’ মেয়েটিকে। আমার আংকেলদের বলতে শুনেছি, “আরে বুঝলেন আমার বউ তো পুরাই হাবলা। ব্যাংকে গিয়ে কেমনে কি করতে হবে সে জীবনেও পারবে না।” আমি পাস ফিরে স্বামীর কথিত “হাবলা” আন্টির বিব্রত হবার হাসি দেখেছি। আমি আমার বাবাকে দেখেছি, সময় অসময়ে মাকে ইংলিশের বানান ধরতে। মা ইংরেজিতে কিছু কথা বললেই টিটকারি মেরে বলতে, “এটার মানে কি? ওটার বানান কি?”। আমার মা ইংলিশ কম জানেন না! কিন্তু যখন তার সন্তানের সামনে এভাবে হেনস্থা করা হয়, তখন একটা মায়ের কেমন লাগে সেটা কোনদিন আমার বাবা বুঝতেও চাননি। আমার মা চিৎকার করে কখনও কখনও এই নোংরা মানসিক নির্যাতনের প্রতিবাদ করেছে। মাকে নিয়ে এই পৈশাচিক জোক করার জন্য বাবাকে পেনাল্টি দিয়েছে। কিন্তু বহু মেয়ে তো তাও পারে না!বন্ধুমহলে বউকে কত বোকা প্রমাণ করতে পারা বন্ধুটি সেরা! যে বউ যত বোকা সে তত সবার কাছে প্রিয় বউ। যে মেয়ে যত কম বুদ্ধি সে তত ভাল সংসারী হয়! তাস পিটাতে পিটাতে বহু অবিবাহিত ছেলের তাই স্বপ্ন কম বুদ্ধির মেয়েকে বিয়ে করে। একে তো সুন্দরী মেয়েরা কম বুদ্ধির হয় (তাদের মতে) এবং অন্যদিকে কম বুদ্ধির মেয়েরা পরিবারের কোন সিদ্ধান্তেও থাকতে পারবে না। যুগে যুগে “আমার বাবুটা কত্ত বোকা!” বলে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নিঃশব্দে চড়ই মেরে এসেছে নারীর গালে। কটা নারী সেটা বুঝেছে? কিংবা বুঝলেও কিছু বলতে পেরেছে! আমি বলি না, একটা মানুষ সব পারবে। সব জানবে, সবেতে ভূরি ভূরি জ্ঞান থাকবে। জ্ঞানের এবং জানার সীমাবদ্ধতা আছে আমাদের। এটা কোনভাবেই জোকসের বিষয় নয়। এইটা নিয়ে কাউকে খুঁচানোর বিষয়ও নয়। এটা শুধু নারী নয়, একজন পুরুষের অক্ষমতার ব্যাপারেও আমার একই যুক্তি। শুধু নারীর বুদ্ধি নিয়ে নয়! সোশ্যাল মিডিয়াতে কোন নারী একাধিকবার বিয়ে করলে কিংবা একাধিকবার প্রেম করলে এমন নোংরা ট্রল আসে যাতে মনে হয় নারী কে হতেই হবে একগামী যৌন অনুভূতিহীন একটা প্রাণি। না হলেই সে “খ” “ম” জাতীয় কিছু! একটা ছেলের তিন নাম্বার বিয়ের খবর মানুষ যত না খায়, একটা মেয়ের তিন নাম্বার বিয়ে তে মানুষ তার চেয়ে বেশি লালা ফেলে। তাকে নিয়ে নতুন কৌতুক চলে, ট্রল চলে। আর কমেন্টে থাকে গালির পসরা। আমি বা আমরা এমন একটা সময়ে বাস করছি যখন নারীরা স্বাবলম্বী হচ্ছে। কি আইটি, কি কমার্স, কি কৃষি সবখানে বাড়ছে নারীর যোগদান। সেই সময়ে দাঁড়িয়ে আমাদের মগজে ঢুকে আছে সেক্সিজমের জোক। “রান্না আর স্মার্টফোন তো এক জিনিস না” কিংবা “মাথায় গোবর আছে তো, তা ঢাকতেই মেকআপ” এর মত নোংরা ট্রলের কথা আমরা প্রায়শই বলি। চা খেতে বলি, বিড়ি ফুঁকতে বলি। হয়ত পুরুষ নারীর এই বিজয়রথ থামাতে পারছে না বলেই এই নোংরা কৌতুক করে মেয়েদের ক্ষমতার বিদ্রুপ করছে। মানসিক নির্যাতন করে মেয়েকে আরও দশ পা পিছিয়ে দিতে চাচ্ছে। কিন্তু তারা অক্ষম। সেক্সিজমের জোকস বন্ধের একটাই উপায়, উল্টা জোকস করা। “আমার বউ বোকা” বলে আপনাকে হেনস্থা করলে আপনার উচিৎ সেটার প্রতিবাদ করা। সে যে পারফেক্ট নয় তা তাকে বোঝানো। সহকর্মী আপনাকে তেলতেলে হাসি দিয়ে আপনার জ্ঞান নিয়ে বিদ্রুপ করলে যেচে পড়ে তার কাছেই শিখতে যাওয়া। সময় পেলে তাকে বুঝিয়ে দেওয়া “তুমিও অনেক কিছু জানো না ভায়া”! ভার্চুয়াল জগতে নোংরা ট্রল দেখলেই প্রতিবাদ করা।অস্থিতে মিশে থাকা নারীদেরকে নিয়ে জোক করার স্বভাব পুরুষের পক্ষে একদিনে যাওয়ার আশা আমি করি না। তাই কথার প্রতিবাদ কথার খোঁচা থেকেই শুরু হোক। হয়ত বেডরুম থেকেই সেই শুরুটা করতে হবে আপনাদেরকে! আর সেটা পারবেন তখনই, যখন মনে প্রাণে বিশ্বাস করতে পারবেন কোনভাবেই আপনি বিদ্রুপের বিষয় নন ! You are not a matter of joke! লেখক : ফাউন্ডার, ফেমিনিজমবাংলা এইচআর/এবিএস
Advertisement