উইনিং শট। নেইমারের নেয়া শটটি জড়িয়ে গেলো জার্মানির জালে। মুহূর্তেই উদ্বেলিত হয়ে উঠলো মারাকানার গ্যালারি। ঢেউটা মারাকানা থেকে রিও ডি জেনিরো, এরপর পুরো ব্রাজিলে ছড়িয়ে পড়লো। যুগ যুগ ধরে যে আক্ষেপে পুড়ছিল ফুটবল জাতিটি। পেলে, জিকো, সক্রেটিস, রোমারিও, রোনালদো, রোনালদিনহো কিংবা কাকারা যে স্বপ্নটাকে অধরাই জ্ঞান করে আসছিলেন, সেটাই এনে দিলেন নেইমার। উৎসবে-উল্লাসেই তো মেতে ওঠার কথা ব্রাজিলিয়ানদের।কিন্তু এ কী! উইনিং শটটা দিয়েই কান্নায় ভেঙে পড়লেন নেইমার। মারাকানার গ্যালারিতে উল্লাস চললেও, মাঠের সবুজ ঘাসে চলছে কান্নার রোল। দুই পক্ষই কাঁদছে। কেউ জয়ের আনন্দে আর কেউ পরাজয়ের বেদনায়। জার্মানি এবং ব্রাজিল- দুই দলই মাঠে নেমেছিল নিজেদের ইতিহাসে প্রথম সোনা জয়ের লক্ষ্যে। সুতরাং, পরাজয়ের বেদনা বেশ ছুঁয়ে গিয়েছিল জার্মানিকেও।ফাইনালে পরাজিত দলের কেউ কেউ কান্নায় ভেঙে পড়েন- এটা প্রায় নিয়মিত দৃশ্য; কিন্তু জয়ী দলের কেউ এতটা কান্নায় ভেঙে পড়তে সম্ভবত এর আগে আর দেখা যায়নি। নেইমারের কান্না থামছিল না কিছুতেই। তার চোখের পানি দেখে সতীর্থদেরও কেউ কেউ কান্নায় ভেঙে পড়লেন। এমনকি কোচ রোজারিও মিকালেও ভেসে গেলেন সেই আনন্দাশ্রুতে। কোন স্বান্তনাই তখন নেইমার-মিকালেসহ অন্যদের কান্না থামাতে পারছিলো না।নেইমারের কান্না পরে ছুঁয়ে গিয়েছিল পুরো ব্রাজিলকেও। শুধু ব্রাজিলই নয়, ঝড় উঠেছিল সোশ্যাল মিডিয়াও। ফেসবুক-টুইটার থেকে শুরু করে সবগুলো মাধ্যমেই আলোচনার বিষয়বস্তু নেইমারের কান্না। সোনা জয় নিশ্চিত হওয়ার পর নেইমারের এই আবেগ ছুঁয়ে গিয়েছে তার ভক্তদেরও।ভক্তদের উৎসুক মনে উঁকি দিয়েছিল, কেন নেইমারের এই কান্না। এটা মূলতঃ বিশাল এক প্রত্যাশার চাপ থেকে মুক্তির কান্না বললে কমই বলা হবে। নিজ দেশে অলিম্পিকের আসর। শুধু ব্রাজিলেই নয়, লাতিন আমেরিকাতেই প্রথমবারের মত দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আার্থের আয়োজন। ফুটবল জাতি হিসেবে পরিচিত ব্রাজিলের অলিম্পিক ফুটবলেই স্বর্ণ নেই। যুগ যুগ ধরে অসংখ্য প্রচেষ্টার ফলেও সোনালি হাসিটা হাসতে পারেনি ব্রাজিল।এবার স্বাগতিক হিসেবে তাই তাদের একমাত্র লক্ষ্যই যেন দাঁড়িয়ে যায় ফুটবলে স্বর্ণ জিততেই হবে। অলিম্পিক শ্রেষ্ঠত্বের মঞ্চে সোনার খণ্ডটা জিততে না পারার যে হাহাকার, সেটা বোঝা গিয়েছিল কিছুদিন আগে সমাপ্ত কোপা আমেরিকার শতবর্ষী আসরের দিকে তাকালেই। মহাদেশীয় এই টুর্নামেন্টটির গুরুত্ব অনেক বেশি অলিম্পিকের ফুটবলের চেয়ে। কারণ, ওটা পূর্ণাঙ্গ জাতীয় দলের। আর এটা অনুর্ধ্ব-২৩ দলের। যদিও এই দলে ২৩ বছর বয়সের বেশি তিনজনকে খেলানোর নিয়ম রয়েছে।ব্রাজিল কোপা আমেরিকাকে জলাঞ্জলি দিল। আগলে রাখলো নেইমারকে। বার্সার দেয়া শর্ত অনুযায়ী নেইমারকে ছাড়াই খেললো কোপা আমেরিকা। ফল হলো, গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায়। বিদায় ঘটলো কোচ দুঙ্গারও। নতুন কোচ তিতে; কিন্তু অলিম্পিকের ভার আর তিতের ওপর না দিয়ে দেয়া হলো রোজারিও মিকালের ওপর। দুঙ্গার রক্ষানাত্মক ফুটবল ছেড়ে আক্রমণাত্মক ফুটবলের পথে পা বাড়ালো ব্রাজিল।প্রস্তুতি যেমনই হোক, খেলার ধরণ পরিবর্তন হোক আর না হোক- ব্রাজিলিয়ানদের প্রত্যাশার পাহাড় ক্রমেই চেপে বসছিল নেইমারের ওপর। এই একটি সোনার আক্ষেপ ঘোচাতে সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নিল ব্রাজিল; কিন্তু এই দলটিই যখন অলিম্পিকের শুরুতে দক্ষিণ আফ্রিকা আর ইরাকেরমত দলের বিপক্ষে কোন গোল করতে পারে না। তখন সমালোচনার বাদও ভেঙে পড়ে।ব্রাজিল জুড়ে নেইমারের নামে ধিক্কার শুরু হলো। সমালোচনায় তার মুণ্ডুপাত হলো। সবচেয়ে বড় লজ্জাজনক কাজ করা হয়েছিল নেইমারের চেয়েও মহিলা ফুটবলার মার্তাকে সেরা উপাধি দিয়ে। মিডিয়াজুড়ে বার বারই বলা হচ্ছিল, নেইমারের চেয়ে সেরা ফুটবলার মার্তা।এতো গেলো, সমালোচনার বিষয়। তারওপর, দুই বছর আগে জার্মানির কাছে ব্রাজিলের ৭-১ গোলে পরাজয়ের লজ্জায় ডোবানোর ঘটনাটিও একটা বড় চাপ হিসেবে ছিল নেইমারের ওপর। একে তো অলিম্পিক ফুটবলে সবগুলো দল মিলিয়ে নেইমার ছাড়া আর কোন বড় তারকা ছিলেন না, তারওপর সেই জার্মানিকে যখন ফাইনালে পাওয়া গেলো, তখন দু’বছর আগের ক্ষত শুকানোর সুযোগটাও একটা বড় চাপ।ইতিহাসও তো কথা বলবে। ৬৬ বছর আগে, এই মারাকানাতেই তো রচিত হয়েছিল ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে ট্র্যাজিক ঘটনাটি। উরুগুয়ের কাছে হেরে বিশ্বকাপের শিরোপা জিততে না পারার পর মারাকানায় যে ট্র্যাজেডি সৃষ্টি হয়েছিল, সেটাই হয়ে গিয়েছে একটি ঐতিহাসিক মিথ। মারাকানাজ্জো। সেই বিখ্যাত ট্র্যাজেডির ৬৬ বছর পর এসে পূনরাবৃত্তি যাতে না হয়, সে চাপও ছিল নেইমারের ওপর।সবচেয়ে তিনি যখন দুর্দান্ত ফ্রি কিক থেকে ব্রাজিলকে এগিয়ে দেন, পুরো খেলায় ব্রাজিলকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন এবং টাইব্রেকারের শ্যুটআউটে শেষ ফিনিশিং টাচটিও তিনি দিয়ে দিলেন, তখন তো তার বাধ ভেঙে আবেগ ছড়িয়ে পড়ার কথাই। যেটা বর্ষিত হয়েছে মূলত অঝোর ধারায় কান্না হিসেবেই। নেইমারের এই কান্নার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বফুটবলে যে আক্ষেপ আর হাহাকার ছিল ব্রাজিলের, সেটা অবশেষে ঘুচে গেলো ব্রাজিলেরও।আইএইচএস/এবিএস
Advertisement