৯ দিনের সরকারি ছুটি সামনে রেখে শুক্রবার রাজধানীবাসীর অনেকেরই ব্যস্ততা ছিল বাড়ি ফেরা ঘিরে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি স্মারকগ্রন্থে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানকে প্রথম রাষ্ট্রপতি বলা নিয়ে বিকেলের দিকে কিছুটা উত্তপ্ত হয়ে ওঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এভাবেই শেষ হচ্ছিল শুক্রবার। কিন্তু রাত ৯টার দিকে আচমকা সম্পূর্ণ নতুন এক পরিস্থিতির মুখে পড়তে হলো বাংলাদেশকে। দেশের ইতিহাসে প্রথবারের মতো দেখা গেল জিম্মিদশা। শুক্রবার রাত ৯টার কিছু পরে প্রথমে খবর পাওয়া যায় গুলশানে পুলিশের সঙ্গে সন্ত্রাসীদের গোলাগুলি হচ্ছে। গুলশান-২ এর ৭৯ নম্বর রোডে গোলাগুলির ঘটনা ঘটছে পুলিশ সূত্রে এমন খবর পাওয়া গেলেও তখনো বোঝা যাচ্ছিল না কারা এই সন্ত্রাসী, কী তাদের উদ্দেশ্য। এর কিছুক্ষণ পরই খবর পাওয়া যায় সন্ত্রাসীদের গুলিতে দুই পুলিশসহ ছয়জন আহত হয়েছেন। তখন খবর আসে, ৭৯ নম্বর রোডের লেক ভিউ রেস্তোরাঁ থেকে পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি চালানো হচ্ছে। পুলিশও পাল্টা গুলি ছোড়ে। মোটামুটি রাত ১০টার দিকেই পুরো রেস্তোরাঁ ঘিরে ফেলে পুলিশ। গুলশান-২ এলাকার বেশ কিছু রাস্তাও বন্ধ করে দেয়া হয়। ততক্ষণে বেসরকারি বেশ কয়েকটি টিভি চ্যানেল গুলশান থেকে সরাসরি সম্প্রচার শুরু করেছে। ঘটনার গভীরতা তখনও অনেকের বোধগম্য না হলেও বিষয়টি নিয়ে আতঙ্ক বাড়ছিল। পুলিশের উপর গুলি চালানোর ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে গুলশান এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। মোতায়েন করা হয় বিপুল সংখ্যক পুলিশ, বিজিবি, র্যাব, বোমা ডিজপোজাল, সোয়াট সদস্য। টহল দেয়া শুরু করে হেলিকপ্টারও। সময় যত যেতে থাকে তত পরিষ্কার হতে থাকে প্রাথমিকভাবে যা মনে করা হয়েছিল ঘটনা তার চেয়ে অনেক বেশি ভয়ঙ্কর। তথ্য আসতে শুরু করে, পুলিশের সঙ্গে যাদের গোলাগুলি হচ্ছে তারা আসলে একটি রেস্তোরাঁয় কয়েকজনকে জিম্মি করে রেখেছে। তবে এ সংখ্যা কত তা নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছিল না। এরই মধ্যে রাত ১২টার দিকে খবর আসে সন্ত্রাসীদের গুলিতে আহত ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সালাউদ্দিন নিহত হয়েছেন। এডিসি আহাদ, গুলশান থানার ওসি সিরাজুল ইসলাম, উপপরিদর্শক (এসআই) রফিক ও এসআই জিয়া, ভাটারা থানার পরিদর্শক ইয়াছিনসহ বেশকিছু পুলিশ সদস্য তখনো ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। সালাউদ্দিনের নিহত হওয়ার খবরে নতুন মাত্রা পায় আতঙ্ক। এরপর পরিস্থিতির ব্যাখ্যা দিতে ঘটনাস্থলে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন র্যাব মহাপরিচালক। তিনি নিশ্চিত করেন কয়েকজন অস্ত্রধারী একটি স্প্যানিশ রেস্তোরাঁয় কয়েকজনকে জিম্মি করে রেখেছে। তবে হামলাকারী কতজন বা জিম্মি কতজন সে সম্পর্কে তিনি কোনো তথ্য দেননি। জাতীয় স্বার্থে ও সাংবাদিকদের নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থে টেলিভিশনের লাইভ সম্প্রচার বন্ধ রাখার আহ্বানও জানান তিনি। বেনজিরের আহ্বানে সাড়া দিয়ে টিভি চ্যানেলগুলো সরাসরি সম্প্রচার বন্ধ করে দেয়। তবে ফুটারে চলতে থাকে ব্রেকিং নিউজ। রাত ১টার দিকে খবর পাওয়া যায় জিম্মিদের মধ্যে একজন ইঞ্জিনিয়ার আশরাফ করিম রাত ১০টা ৪১ মিনিটে তার চাচা আনোয়ার হোসেনকে ফোন করে জানিয়েছেন, ‘পুলিশকে অনুরোধ করুন ভেতরে যেন গুলি না চালায়। গুলি চালালে তারা (সন্ত্রাসীরা) আমাদের মেরে ফেলবে।’ এরপর খবর আসে সন্ত্রাসীদের গুলিতে আহত ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের সহকারী কমিশনার রবিউল ইসলামও মারা গেছেন। ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি।বাংলাদেশে বিরল এ ধরনের হামলা কারা চালিয়েছে- সে বিষয়ে নিশ্চিত না হওয়া গেলেও বাংলাদেশে অবস্থানরত যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের নিরাপদে থাকার পরামর্শ দেয় মার্কিন দূতাবাস। বাংলাদেশের এই ঘটনাটি ততক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ খবর হয়ে উঠেছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোর কাছেও। ফলাও করে তারা খবর প্রকাশ করে বাংলাদেশে জিম্মি সঙ্কটের। বিবিসি, সিএনএন রাত থেকেই সরাসরি সম্প্রচার শুরু করে গুলশানের ঘটনাটির। খবর আসে, রেস্টুরেন্টে গোলাগুলি, জিম্মি নাটক এবং হতাহতের দায় স্বীকার করেছে আল কায়েদার ভারতীয় উপমহাদেশ শাখার (একিউআইএস) সংগঠন আনসার আল ইসলাম।গুলশানের ঘটনাটির প্রতিক্রিয়ায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা সতর্কতা জারি করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের পর অস্ট্রেলিয়ার নাগরিকদেরও সতর্ক থাকার পরামর্শ দেয় বাংলাদেশে অবস্থিত দেশটির দূতাবাস।ঘটনার দায় স্বীকার করে জঙ্গি সংগঠন আইএসও। সংগঠনটির মুখপত্র আমাক নিউজ এজেন্সির সূত্র দিয়ে রয়টার্সের একটি টুইটে ২০ জন নিহত হওয়ার খবরও বলা হয়। রাত ৩টার দিকে সন্ত্রাসীদের জিম্মিদশা থেকে দুইজনকে জীবিত উদ্ধার করে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তিনি হলেন স্প্যানিশ নাগরিক দিয়েগো স্তেন। তিনি রেস্তোরাঁটিতে বাবুর্চি হিসেবে কর্মরত ছিলেন। অপরজন বাংলাদেশি নাগরিক বেলারুশ। তিনি রেস্তোরাঁর কর্মচারী।জিম্মিদশার আট ঘণ্টা কেটে গেলেও পরিস্থিতিতে কার্যত কোনো পরিবর্তন আসছিল না। এ পরিস্থিতি জিম্মিদের উদ্ধারে অভিযান শুরু করতে ভোর সাড়ে ৫টার দিকে সিলেট থেকে গুলশান এসে পৌঁছায় সেনাবাহিনীর কমান্ডো টিম। সকাল ৭টা ৫০ মিনিটের দিকে শুরু হয় অভিযান। মুহুর্মুহু গুলি-বিস্ফোরণের শব্দে কেঁপে ওঠে গুলশান। ঘটনাস্থল থেকে একজনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠানো হয়। জিম্মিদশা শুরুর মোটামুটি ১২ ঘণ্টার মাথায় সকাল ৯টার দিকে র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক মিজানুর রহমান জানান, উদ্ধার অভিযান শেষ হয়েছে। র্যাবের গোয়েন্দা শাখার এক কর্মকর্তা জানান, এক বিদেশিসহ ৫ জন নিহত হয়েছেন। ১৩ জনকে উদ্বার করা হয়েছে। নিহত ও উদ্ধার হওয়াদের সংখ্যা আরো বাড়তে পারে বলেও জানান তিনি। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে বঙ্গবন্ধু আন্তজার্তিক সম্মেলন কেন্দ্রে এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানান, হামলাকারীদের ছয়জন নিহত হয়েছে। জীবিত অবস্থায় আটক করা হয়েছে একজনকে। দেড়টার দিকে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়, রাতেই ২০ জনকে গলা কেটে হত্যা করা হয়। এনএফ/আরআইপি
Advertisement