ঢামেকে ডেঙ্গুরোগীর চাপ থাকলেও নেই চিকিৎসা সংকট
দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ কমছেই না। প্রতিদিনই বাড়ছে আক্রান্ত রোগী। বাড়ছে মৃতের সংখ্যাও। এরই মধ্যে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন হাসপাতালে বাড়ছে রোগীর চাপ। ডেঙ্গুরোগীদের চিকিৎসাসেবাও কোথাও কোথাও ঘাটতি বা ওষুধপত্রের অপর্যাপ্ততার তথ্য মিলছে। তবে ডেঙ্গুরোগীদের চিকিৎসায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে কোনো ধরনের চিকিৎসা সংকট নেই। স্যালাইন ও ওষুধপত্রসহ অন্য সরঞ্জামাদিও রয়েছে পর্যাপ্ত পরিমাণে। যদিও সেখানে বিশেষায়িত ওয়ার্ডে রয়েছে রোগীর চাপ।
সারাদেশ থেকে আসা ডেঙ্গুরোগীদের সেবা দিতে ঢামেক হাসপাতালের নতুন ভবনের চার তলায় স্পেশালাইজড ডেডিকেটেড ডেঙ্গু ওয়ার্ড চলতি বছরের ১০ আগস্ট থেকে কার্যক্রম শুরু করেছে। সরেজমিনে পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, ওয়ার্ডে জায়গা না থাকায় বাইরেও শয্যা বিছিয়ে রোগীদের চিকিৎসাসেবা দেওয়া হচ্ছে। বাইরে প্রায় আটটি শয্যার সবগুলোতে রোগী ভর্তি আছে।
ওয়ার্ডের দায়িত্বে থাকা একজন নার্সের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ডেঙ্গু ওয়ার্ডটিতে মোট ৪০টি বেড রয়েছে। প্রতিবেদনটি তৈরির সময়ও ৩৭টি বেডে রোগী ছিল। যাদের মধ্যে চারজনের অবস্থাই ছিল গুরুতর।
আরও পড়ুন
সেখানেই কথা হয় আব্দুল্লাহ নামে একজনের সঙ্গে। তিনি থাকেন রাজধানীর আজিমপুর বিজিবি কোয়ার্টারে। গত শুক্রবার ছোট ছেলেকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছেন। এই অভিভাবক বলেন, শুক্রবার ছেলেটা বন্ধুদের সঙ্গে কোথায় যেন ঘুরতে গিয়েছিল। বাসায় আসার পরই গায়ে জ্বর আসে। ডেঙ্গুর নমুনা পরীক্ষার পর পজিটিভ আসে।
‘এখানে সব ধরনের সুবিধাই পাচ্ছি। দিনরাত ২৪ ঘণ্টাই ডাক্তার থাকে, সুবিধা-অসুবিধা দেখভাল করে। আমার এখনো বাইরে থেকে কোনো স্যালাইন কিনতে হয়নি। ওয়ার্ড থেকেই সব দিয়েছে’- বলেন আব্দুল্লাহ।
ঢামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, ‘স্পেশাল কেস বাদে সব ধরনের স্যালাইন, ওষুধ আমাদের ওয়ার্ড থেকে দেওয়া হয়। আমাদের ওয়ার্ডে স্যালাইনের কোনো ঘাটতি নেই। পর্যাপ্ত পরিমাণে স্যালাইন আছে। আগামীতে কোনো সমস্যা হলে সে প্রস্তুতিও আছে।’
প্রতিনিয়ত দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে রোগী আসছে। তাদের সার্বক্ষণিক সেবা দিতে সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে জানান এ কর্মকর্তা।
মুঞ্জিগঞ্জের মাওয়া থেকে স্বামীকে নিয়ে এসেছেন কামনা আক্তার। কথা হলে তিনি বলেন, ‘পাঁচদিন ধরে এখানে সেবা নিচ্ছি। বেড পেতে তেমন সমস্যা হয়নি। সেবার মানও ভালো। আমার স্বামী ১৫ দিন হলো দেশে এসেছেন। এসেই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, গত ২৩ বছরে দেশে ডেঙ্গুতে মোট মারা গেছেন ৮৬৮ জন। কিন্তু ২০২৩ সালেই মারা যান ১ হাজার ৭০৫ জন ডেঙ্গুরোগী। ইনজেকশনযোগ্য স্যালাইনের অভাবে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছিল।
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আসাদুজ্জামান বলেন, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ঢামেক হাসপাতালে ৩ হাজার ১১৭ জন ডেঙ্গুরোগী ভর্তি হয়েছেন। তাদের মধ্যে ৮৫ জন মারা গেছেন। বর্তমানে ১০৩ জন ভর্তি আছেন।
স্যালাইন সংকটের বিষয়ে তিনি বলেন, এই বছর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে স্যালাইন প্রস্তুতকারক সব কোম্পানির মিটিং হয়েছিল। সেখানে কোম্পানিগুলোকে বলা হয়েছিল, যেন পর্যাপ্ত স্যালাইন প্রস্তুত রাখে। কারণ, বিদেশ থেকে স্যালাইন আমদানি করা সম্ভব নয়।
ঢামেক হাসপাতালের সামনে ফার্মেসিগুলো ঘুরে দেখা গেছে, ডেঙ্গুরোগীর জন্য ব্যবহৃত ডিএনএস স্যালাইনের কোনো সংকট নেই।
জান্নাত ফার্মেসির কর্ণধার হাসান বলেন, ‘আমার দোকানে পর্যাপ্ত পরিমাণে ডিএনএস স্যালাইন আছে। পাইকারি দাম ৮৫ টাকা, আমরা ১০০ টাকায় বিক্রি করি। ১০০ টাকার বেশি কোনো স্যালাইন নেই।’
ঢামেক হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. সৈয়দ মোহাম্মদ মনোয়ার আলী জাগো নিউজকে বলেন, ডেঙ্গু ভাইরাসের ভ্যারিয়েন্ট মূলত চার ধরনের। একজন রোগী যখন একটি ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত হন তখন যদি ভালো হয়েও যায়, দ্বিতীয়বার যে ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত হন সেক্ষেত্রে মৃত্যুর সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
তিনি বলেন, অনেক সময় অন্যান্য রোগ যেমন- ডায়াবেটিস, কিডনি, হার্টের সমস্যা থাকলে রোগীর মৃত্যুঝুঁকি বেড়ে যায়। এক্ষেত্রে একজন ষাটোর্ধ্ব সাধারণ রোগীর চেয়ে অন্য দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত রোগীর মৃত্যুঝুঁকি বেশি।
আরও পড়ুন
ডা. মনোয়ার আরও বলেন, লক্ষ্য করে দেখবেন এখন কিন্তু সারা বছরই ডেঙ্গু হচ্ছে এবং আক্রান্তের সংখ্যা কমলেও মৃতের সংখ্যা বাড়ছে। এটি ভবিষ্যতে আরও বাড়তে পারে। তার মানে, কেউ একবার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ভালো হলেও তিনি কিন্তু পুরোপুরি ঝুঁকিমুক্ত নন। কারণ, পরবর্তী ভ্যারিয়েন্টের আক্রমণে সিরিয়াস ঝুঁকি থেকে যায়।
ডেঙ্গু নিয়ে নতুন গাইডলাইন তৈরি হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, ডেঙ্গু নিয়ে নতুন গাইডলাইন হচ্ছে। শ্রীলঙ্কার মতো দেশগুলো যারা ডেঙ্গু প্রতিরোধে সফল হয়েছে তাদের মডেল অনুসরণ করে নতুন গাইডলাইন করা হচ্ছে।
তিনি মনে করেন, নিজেদের সচেতনতা বৃদ্ধি, ডেঙ্গুর লক্ষণ দেখা দিলে দেরি না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া, প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ, মশক নিয়ন্ত্রণে দায়িত্বপ্রাপ্তদের যথাযথ ভূমিকা পালনের মাধ্যমে ডেঙ্গুর প্রকোপ কমানো যেতে পারে।
এসআরএস/এমকেআর/এমএমএআর/এমএস