ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে বড় ধরনের প্রস্তুতি নিতে হবে

মনিরুজ্জামান উজ্জ্বল
মনিরুজ্জামান উজ্জ্বল মনিরুজ্জামান উজ্জ্বল , বিশেষ সংবাদদাতা
প্রকাশিত: ০২:৩০ পিএম, ০৩ জুলাই ২০২৪
  • চলতি বছরের ২ জুলাই পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ৩৭৫১, মৃত্যু ৪৬
  • আক্রান্ত ও মৃত্যুতে শীর্ষে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন, কম সিলেটে
  • ঢাকার বাইরে সর্বোচ্চ রোগী চট্টগ্রাম সিটির বাইরের এলাকায়
  • ১৬ থেকে ৩০ বছর বয়সী রোগীর সংখ্যা সর্বাধিক
  • ডেঙ্গুতে বেশি আক্রান্ত পুরুষ, মৃত্যু বেশি নারীর

দেশে এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু জ্বরে গত বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালে রেকর্ডসংখ্যক রোগী আক্রান্ত ও মৃত্যু হয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান অনুসারে, আক্রান্ত হয় ৩ লাখ ২১ হাজার ২৭ জন। এর মধ্যে মৃত্যু হয় ১ হাজার ৭০৫ জনের। এর আগের ২৩ বছরে (২০০০ থেকে ২০২২) ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় ৮৬৮ জনের। সে হিসাবে গত বছর ঘরে ঘরে ডেঙ্গু নিয়ে মহাতঙ্ক বিরাজ করে।

এবারও ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে অনেকেই উদ্বিগ্ন। চলছে বর্ষা মৌসুম। থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে। এমন আবহাওয়া এডিস মশা প্রজননের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ উল্লেখ করে রোগতত্ত্ববিদরা বলছেন, হঠাৎ করেই সারাদেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ বৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে।

চলতি বছরের এখন পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে অনেক কম। তবে আক্রান্তের সংখ্যানুপাতে মৃতের সংখ্যা অনেক বেশি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশনস্ সেন্টার অ্যান্ড কন্ট্রোল রুমের সর্বশেষ (২০২৪ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২ জুলাই) তথ্যানুসারে, রাজধানীসহ সারাদেশে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি মোট রোগীর সংখ্যা ৩ হাজার ৭৫১ জন। আক্রান্তদের মধ্যে পুরুষ ২ হাজার ২৭৬ ও নারী ১ হাজার ৪৭৫ জন।

রোগীদের মধ্যে জানুয়ারিতে ১ হাজার ৫৫ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৩৩৯, মার্চে ৩১১, এপ্রিলে ৫০৪, মে মাসে ৬৪৪, জুনে ৭৯৮ এবং জুলাইয়ের প্রথম দুদিনে ১০০ জন আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে।

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে বড় ধরনের প্রস্তুতি নিতে হবে

একই সময়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগীদের মধ্যে ৪৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে জানুয়ারিতে ১৪ জন, ফেব্রুয়ারিতে তিনন, মার্চে পাঁচ, এপ্রিলে দুই, মে মাসে ১২, জুনে ৮ এবং জুলাইয়ের প্রথম দুদিনে দুজনের মৃত্যু হয়েছে। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগীদের মধ্যে চিকিৎসা নিয়ে এরই মধ্যে বাড়ি ফিরে গেছেন ৩ হাজার ৪৭৩ জন। বর্তমানে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগীর সংখ্যা ২৩২ জন।

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে বড় ধরনের প্রস্তুতি নিতে হবে

এক সময় ডেঙ্গু রাজধানী ঢাকায় সীমাবদ্ধ থাকলেও বর্তমানে বিভিন্ন বিভাগীয় শহর এমনকি গ্রামগঞ্জেও ছড়িয়ে পড়েছে। গত বছরের তুলনায় এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগী ও মৃত রোগীর সংখ্যা কম ও নিয়ন্ত্রণে রয়েছে মনে হলেও আগামী দিনগুলোতে ডেঙ্গু পরিস্থিতি কী হতে পারে, ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা সুবিধা, সীমাবদ্ধতা ও করণীয় নিয়ে জাগো নিউজের সঙ্গে কথা বলেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন। সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন জাগো নিউজের প্ল্যানিং এডিটর মনিরুজ্জামান উজ্জ্বল।

জাগো নিউজ: বর্তমান ডেঙ্গু পরিস্থিতি কেমন দেখছেন?

ডা. মুশতাক হোসেন: চলতি বছর এখন পর্যন্ত যে পরিসংখ্যান দেখা যাচ্ছে, তাতে ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বলা যেতে পারে। গত বছরের তুলনায় এ বছর আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম। তবে রোগীর সংখ্যানুপাতে মৃতের সংখ্যা বেশি।

জাগো নিউজ: গত বছর আপনি আশঙ্কা করেছিলেন এ বছর আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা অনেক বেশি হবে? বছরের মাঝামাঝি এসে এখন কী বলবেন? হঠাৎ করে কি ডেঙ্গু রোগী ও মৃতের সংখ্যা বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন?

ডা. মুশতাক হোসেন: বর্ষা মৌসুম শুরু হয়েছে। থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে। আগামী দিনগুলোতে এর প্রকোপ বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ সেই অর্থে সারাদেশে এডিস মশার উৎপত্তিস্থল ধ্বংসে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযান পরিচালিত হচ্ছে না। শহরে কিছুটা হচ্ছে, ফল পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু এটা তো স্থায়ী সমাধান নয়। সারাদেশে যদি একসঙ্গে মশার উৎপত্তিস্থল ধ্বংস করা না হয়, তাহলে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল পাওয়া যাবে না। গত বছরের চেয়ে এ বছর ডেঙ্গু রোগের সংখ্যা বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। রোগীর সংখ্যা বাড়লে মৃত্যুর ঝুঁকিও বাড়বে।

জাগো নিউজ: এখন পর্যন্ত ডেঙ্গু প্রতিরোধে যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তা কি ইতিবাচক মনে করছেন?

ডা. মুশতাক হোসেন: ডেঙ্গু প্রতিরোধে গৃহীত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা এখনো নিশ্চিতভাবে ইতিবাচক বলা যাবে না। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযান যতটুকু পরিচালিত হচ্ছে তার ফলাফল পেতে কয়েক বছর লাগে। এডিস মশার যেই অ্যান্টমলজিক্যাল সার্ভে রয়েছে তাতে কিন্তু প্রকোপ বেশি দেখাচ্ছে।

জাগো নিউজ: সারাদেশে ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসার সুযোগ-সুবিধা পর্যাপ্ত রয়েছে কি?

ডা. মুশতাক হোসেন: হাসপাতালে প্রচলিত ডেঙ্গু রোগীর স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাপনায় খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে হাসপাতালের বিকেন্দ্রীকরণ প্রয়োজন। এক্ষেত্রে ডেঙ্গু রোগীর ব্যবস্থাপনায় প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা, পরে টারশিয়ারি লেভেলে হাসপাতালে চিকিৎসার সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু আমরা হাতেগোনা কয়েকটি টারশিয়ারি লেভেলের হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা দিচ্ছি।

কিন্তু সত্যিকার অর্থে প্রাথমিক পর্যায়ে ডেঙ্গু রোগী শনাক্তকরণ এবং তাদের পর্যবেক্ষণে রেখে চিকিৎসা দিতে পারলে গুরুতর রোগের সংখ্যা কমানো সম্ভব। কিন্তু হাসপাতালে রোগীর ব্যবস্থাপনা অতিমাত্রায় কেন্দ্রীভূত, তাও কয়েকটা বড় বড় হাসপাতালে। এক্ষেত্রে পরিবর্তন আনা প্রয়োজন।

জাগো নিউজ: হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা আগের তুলনায় ভালো হয়েছে না কি অপরিবর্তিত রয়েছে?

ডা. মুশতাক হোসেন: বর্তমানে একজন ডেঙ্গু রোগীকে সেবা ব্যবস্থাপনার আওতায় আনতে কয়েকদিন সময় লেগে যায়। সারাদেশে ডেঙ্গু রোগীর সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে হলে রোগী যেন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে প্রাথমিকভাবে পরীক্ষা করতে পারে সে ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। এরপর কিছু দূরে সেকেন্ডারি হাসপাতালে (উপজেলা) চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে হবে। সেখানে খুব বেশি গুরুতর নয়, কিন্তু ঝুঁকিপূর্ণ বয়সের রোগীরা প্রশিক্ষিত চিকিৎসক ও নার্সদের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসাধীন থাকবেন। সেখানে কারও শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তাকে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হবে। এই যে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার বিকেন্দ্রীকরণ এটা আমাদের হয়নি।

জাগো নিউজ: এক সময় ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা রাজধানীতেই সীমাবদ্ধ ছিল, কিন্তু বর্তমানে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে এর কারণ কী বলে আপনি মনে করেন?

ডা. মুশতাক হোসেন: কয়েক বছর ধরে ঢাকার চেয়ে ঢাকার বাইরে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। কারণ ঢাকার বাইরে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে বলতে গেলে কোনো কার্যক্রমই নেই।

জাগো নিউজ: একজন রোগতত্ত্ব বিশেষজ্ঞ হিসেবে আপনি বিভিন্ন সভা, সেমিনার ও সরকারি প্রতিষ্ঠানে উপদেষ্টা হিসেবে রয়েছেন। সেক্ষেত্রে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা বিকেন্দ্রীকরণসহ বিভিন্ন পরামর্শ নিশ্চয়ই দেন, কিন্তু পরামর্শ অনুযায়ী কি ব্যবস্থা নেওয়া হয়?

ডা. মুশতাক হোসেন: যারা দায়িত্বে আছেন তাদের মধ্যে আত্মসন্তুষ্টির ভাব আছে বলে আমার মনে হয়। এটাই সবচেয়ে খারাপ কথা। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে বড় ধরনের প্রস্তুতি নিতে হবে। কিন্তু তা না করে আত্মসন্তুষ্টিতে ভুগলে বিপদে পড়তে হবে।

জাগো নিউজ: বর্ষাকাল চলছে। থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে। এমন আবহাওয়ায় এডিস মশার প্রজনন সহায়ক। এক্ষেত্রে করণীয় কী?

ডা. মুশতাক হোসেন: আমাদের বিদ্যমান স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় ঢাকা শহরে রোগীর চিকিৎসা বড় বড় হাসপাতালে সীমাবদ্ধ। সেখানে বড় বড় চিকিৎসক ও নার্সসহ প্রয়োজনীয় জনবল এবং লজিস্টিক বিভিন্ন সাপোর্ট রয়েছে। কিন্তু শহরে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্বাস্থ্যসেবা নেই। ফলে যে কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য বড় বড় হাসপাতালে লম্বা লাইন হয়, রোগীর সংখ্যা বেশি হলে সুচিকিৎসা নিশ্চিত করাও দায় হয়ে পড়ে।

অপরদিকে, গ্রামাঞ্চলে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র, মাধ্যমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র অর্থাৎ উপজেলা হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ ও জেলা সদর হাসপাতাল রয়েছে। কিন্তু সেখানকার অধিকাংশ স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে উপযুক্ত জনবল ও লজিস্টিক সাপোর্টের অপ্রতুলতা রয়েছে। যেখানে জনবল ও লজিস্টিক সাপোর্ট হয়েছে সেখান থেকে রোগী ঢাকা শহরে আসে না। যেখানে নেই সেখান থেকে রোগী সোজা ঢাকায় চলে আসে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থাটা এমন যে ‘গ্রামে বন্দুক আছে গুলি নেই, শহর গুলিতে ভর্তি, বন্দুক নেই।’

জাগো নিউজ: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

ডা. মুশতাক হোসেন: জাগো নিউজ ও আপনাকে ধন্যবাদ।

এমইউ/এমএএইচ/এমএমএআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।