স্তন ক্যানসার

লাখ টাকার অস্ত্রোপচার মাত্র ৫ হাজার টাকায়

মনিরুজ্জামান উজ্জ্বল
মনিরুজ্জামান উজ্জ্বল মনিরুজ্জামান উজ্জ্বল , বিশেষ সংবাদদাতা
প্রকাশিত: ১১:১৪ এএম, ০১ জুলাই ২০২৪

•• স্তন ক্যানসারে প্রতিবছর গড়ে ১৩ হাজার আক্রান্ত, ৬ হাজারের বেশি সংখ্যকের মৃত্যু
•• স্তন ক্যানসার প্রতিরোধে এখনো অসচেতন রোগীরা
•• প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত হলে ৯৫ শতাংশ নিরাময় যোগ্য
•• স্তন ক্যানসার দিবসের ১০০ দিনের কাউন্ট ডাউন ও ১৫০ দিনের কর্মসূচি
•• টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া রোড শো হবে

দেশে নীরব ঘাতক হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে স্তন ক্যানসার। বিভিন্ন ধরনের ক্যানসারের মধ্যে সবচেয়ে বেশি স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছেন নারীরা। প্রতিবছর গড়ে প্রায় ১৩ হাজার নারী স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছেন। মৃত্যু হচ্ছে ছয় হাজারেরও বেশি নারীর।

প্রাথমিক পর্যায়ে স্তন ক্যানসার দ্রুত শনাক্ত ও প্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারের পাশাপাশি সুচিকিৎসা গ্রহণ করলে এ ক্যানসারে আক্রান্ত ৯৫ শতাংশ রোগীকে সম্পূর্ণ সুস্থ করে তোলা সম্ভব। বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে এই অস্ত্রোপচারে লক্ষাধিক টাকা খরচ হয়। সেখানে মাত্র পাঁচ হাজার টাকায় ৫০ জন রোগীকে অস্ত্রোপচারের সুযোগ দিচ্ছে বাংলাদেশ স্তন ক্যানসার সচেতনতা ফোরাম।

স্তন ক্যানসার সম্পর্কে প্রয়োজনীয় জনসচেতনতার অভাব, সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে চিকিৎসা সুবিধার অপ্রতুলতা এবং ব্যয়বহুল হওয়ায় অধিকাংশ রোগীর চিকিৎসা বিলম্বিত হয়। বিলম্বিত চিকিৎসার কারণে রোগীকে দুর্ভাগ্যজনকভাবে মৃত্যুবরণ করতে হয়।

দেশে স্তন ক্যানসার প্রতিরোধ ও জনসচেতনতা সৃষ্টিতে এক যুগেরও বেশি সময় ধরে নিরলস পরিশ্রম করে চলেছে বাংলাদেশ স্তন ক্যানসার সচেতনতা ফোরাম। ২০১৩ সালে মাত্র ১১টি সংগঠন নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও বর্তমানে এ ফোরামের সদস্য সংখ্যা ৪৬টি। দেশে স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীর হার, সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে চিকিৎসা সুবিধা, অস্ত্রোপচার ও চিকিৎসা ব্যয় এবং সচেতনতা সৃষ্টিতে বিভিন্ন কার্যক্রম নিয়ে জাগো নিউজের সঙ্গে কথা বলেন বাংলাদেশ স্তন ক্যানসার সচেতনতা ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান সমন্বয়কারী অধ্যাপক ডা. হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন।

১৯৯৪ সাল থেকে ক্যানসার প্রতিরোধ ও সচেতনতা সৃষ্টিতে নিবেদিত চিকিৎসক হিসেবে কাজ করছেন ডা. হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন। বর্তমানে তিনি গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক ক্যানসার হাসপাতাল প্রকল্পের সমন্বয়কারী ও প্রিভেন্টিভ অনকোলজি বিভাগের প্রধান হিসেবে কর্মরত। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জাগো নিউজের প্ল্যানিং এডিটর মনিরুজ্জামান উজ্জ্বল

প্রশ্ন: বাংলাদেশে প্রাণঘাতী ক্যানসার রোগের সার্বিক পরিস্থিতি কী?

উত্তর: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যানসারের (আইএআরসি) গ্লোবাল ক্যানসার অবজারভেটরি প্রকাশিত সর্বশেষ (২০২২) তথ্যানুসারে বাংলাদেশে প্রতিবছর নতুন করে ১ লাখ ৬৭ হাজার ২৫৬ জন বিভিন্ন ধরনের ক্যানসারে আক্রান্ত হন। তাদের মধ্যে পুরুষ ৯৪ হাজার ৯২২ ও নারী ৭২ হাজার ৩৩৪ জন। একইভাবে প্রতিবছর ১ লাখ ১৬ হাজার ৬৯৮ জন ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করছেন। তাদের মধ্যে পুরুষ ৬৮ হাজার ৫৯১ ও নারী ৪৮ হাজার সাতজন।

আরও পড়ুন

বিভিন্ন ধরনের ক্যানসারের মধ্যে নারীরা সর্বোচ্চ সংখ্যক স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছেন। প্রতিবছর গড়ে নতুন করে প্রায় ১৩ হাজার নারী স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত ও ছয় হাজারেরও বেশি সংখ্যকের মৃত্যু হচ্ছে।

প্রশ্ন: বাংলাদেশ স্তন ক্যানসার সচেতনতা ফোরাম কবে এবং কী উদ্দেশ্যে গঠিত হয়?

উত্তর: স্তন ক্যানসার প্রাণঘাতী ব্যাধি হলেও প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্তের পর প্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচার ও সুচিকিৎসা নিশ্চিত করা সম্ভব হলে ৯৫ শতাংশ রোগীকে সুস্থ করে তোলা সম্ভব। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতা হলো রোগ শনাক্ত ও অস্ত্রোপচারে বিলম্ব তথা সুচিকিৎসার অভাবে আক্রান্ত অধিকাংশ রোগীকে দুর্ভাগ্যজনকভাবে মৃত্যুবরণ করতে হচ্ছে।

স্তন ক্যানসার সম্পর্কে সারাদেশে ব্যাপক জনসচেতনতা গড়ে তোলার লক্ষ্যে ২০১৩ সালে স্তন ক্যানসার সচেতনতা ফোরাম গঠিত হয়। শুরুতে মাত্র ১১টি সংগঠনকে সঙ্গে নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও বর্তমানে এ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪৬টি।

প্রশ্ন: প্রাথমিকভাবে কি কি নমুনা বা উপসর্গ দেখলে একজন ধারণা করতে পারবেন যে তিনি স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত?

উত্তর: নারীরা নিজে নিজেই নমুনা ও উপসর্গ দেখে স্তন ক্যানসার হয়েছে কি না পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। স্তনে হাত বুলালে যদি গোটা, মার্বেল কিংবা সুপারির মতো কোনো কিছুর অস্তিত্ব অনুভব করেন, স্তনের বোটা থেকে কস বের হয় বা লালচে দেখতে হয় অথবা বগলের তলায় গোটা হয় তবে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।

প্রশ্ন: প্রাথমিক পর্যায়ে স্তন ক্যানসার ধরা পড়লে কি রোগী সুস্থ হয়?

উত্তর: আক্রান্তদের মধ্যে ৯৫ শতাংশ রোগী (শর্ত হলো প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ শনাক্ত, দ্রুত অস্ত্রোপচার, বায়োপসি শেষে কেমো থেরাপি কিংবা রেডিওথেরাপি প্রদান) সুস্থ হয়ে উঠতে পারেন। তবে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে ৪ শতাংশ মারাত্মক ধরনের স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হন। বিলম্বিত চিকিৎসার কারণে তাদের বাঁচানো সম্ভব হয় না।

আরও পড়ুন

প্রশ্ন: সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে স্তন ক্যানসার চিকিৎসার সুযোগ-সুবিধা কতটুকু রয়েছে?

উত্তর: সরকারি পর্যায়ে চিকিৎসা সুবিধা অপ্রতুল। সরকারিভাবে শুধু রাজধানী ঢাকা, খুলনা ও চট্টগ্রামে চিকিৎসা সুবিধা রয়েছে। স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীদের অস্ত্রোপচারের জন্য বিশেষজ্ঞ সার্জনের সংখ্যা অপ্রতুল। রোগীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় অস্ত্রোপচারের সিরিয়াল পেতে দু-তিন মাস অপেক্ষা করতে হয়। বেসরকারি পর্যায়ে চিকিৎসা সুবিধা থাকলেও চিকিৎসা খরচ বেশি হওয়ায় অধিকাংশ রোগী চিকিৎসা গ্রহণ করতে পারেন না।

প্রশ্ন: স্তন ক্যানসার সচেতনতা দিবস কবে পালিত হয়? ১০০ দিন গণনা ও ১৫০ দিনের কর্মসূচি বিষয়টি কী?

উত্তর: ২০১৩ সাল থেকে বাংলাদেশ স্তন ক্যানসার সচেতনতা ফোরামের উদ্যোগে প্রতিবছর ১০ অক্টোবর স্তন ক্যানসার সচেতনতা দিবস পালিত হয়ে আসছে। সাধারণ মানুষের মধ্যে স্তন ক্যানসার প্রতিরোধে জনসচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি প্রাথমিক অবস্থায় নির্ণয় ও সময়মতো চিকিৎসা গ্রহণে উদ্বুদ্ধকরণের লক্ষ্যে ১ জুলাই থেকে ১০ অক্টোবর পর্যন্ত ১০০ দিনের দিন গণনা ও ১৫০ দিনের কর্মসূচি পালিত হবে।

আজ সোমবার (১ জুলাই) বিকেল ৩টায় ধানমন্ডির গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে ১০০ দিন গণনা শুরু ও ১৫০ দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। এ কর্মসূচির আওতায় এবার বাসযোগে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত জনসচেতনামূলক কর্মসূচি পরিচালিত হবে।

প্রশ্ন: ১৫০ দিনের কর্মসূচিতে রোগীদের জন্য বিশেষ কোনো ব্যবস্থা থাকছে?

উত্তর: ১৫০ দিনের কর্মসূচির আওতায় স্তন ক্যানসার প্রতিরোধে ব্যাপক জনসচেতনতামূলক কর্মসূচির পাশাপাশি আক্রান্ত ৫০ জন দরিদ্র রোগীকে প্রতীকী খরচে অস্ত্রোপচার করা হবে।

সরকারি হাসপাতালে লম্বা সিরিয়ালের কারণে অস্ত্রোপচার হতে বিলম্ব হয়। তাছাড়া বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকে এই অস্ত্রোপচারে লক্ষাধিক টাকা খরচ হয়। সেখানে ফোরামের পক্ষ থেকে মাত্র পাঁচ হাজার টাকায় রোগীরা অস্ত্রোপচারের সুযোগ পাবেন।

আরও পড়ুন

প্রশ্ন: এ বছর প্রতীকী খরচে অস্ত্রোপচারের উদ্যোগটি কেন গ্রহণ করা হলো?

উত্তর: স্তন ক্যানসারের অনেক রোগী আমরা শনাক্ত করি ঠিকই কিন্তু নানা কারণে (অসচেতনতা, আলসেমি কিংবা টাকা-পয়সার অভাব) অপারেশনের স্টেজ পার হয়ে যায়। প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়লে যেহেতু অস্ত্রোপচারই প্রথম চিকিৎসা তাই এ উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। চিকিৎসা ব্যয় বেশি হলেও সবাই মিলে চেষ্টা করলে এ ব্যয় মেটানো সম্ভব।

প্রশ্ন: স্তন ক্যানসার সচেতনতা ফোরামের সঙ্গে জড়িত ৪৬টি সংগঠনের মধ্যে অন্যতম কোন কোন সংগঠন রয়েছে?

উত্তর: বিভিন্ন সংগঠনের মধ্যে ক্যানসার রোগতত্ত্ব, প্রতিরোধ ও গবেষণা কেন্দ্র (সিসিপিআর), কমিউনিটি অনকোলজি সেন্টার ট্রাস্ট, বাংলাদেশ ক্যানসার ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ ওয়াইডাব্লিউসিএ, নারীপক্ষ, নারী উদ্যোগ কেন্দ্র, অপরাজিতা সোসাইটি এগেইনস্ট ক্যানসার, রাজশাহী ক্যানসার হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার, গণস্বাস্থ্য সমাজ ভিত্তিক ক্যানসার হাসপাতাল, পল্লীমা মহিলা পরিষদ, প্রশিকা মানবিক উন্নয়ন কেন্দ্র, ওয়ার্ল্ড ক্যানসার সোসাইটি বাংলাদেশ, শেরপুর কমিউনিটি অনকোলজি ফাউন্ডেশন, টিএমএসএস, হারমনি ট্রাস্ট, ট্রিটমেন্ট কমিউনিটি, খুরশীদ জাহান হক ইনস্টিটিউট অব ক্যানসার রিসার্চ অ্যান্ড হসপিটাল দিনাজপুর, ১৬টি রোটারি ক্লাব, ৪টি ইনার হুইল ক্লাব ও ক্যানসার কেয়ার কমিউনিটি বাংলাদেশ স্তন ক্যানসার সচেতনতা সৃষ্টিতে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে চলেছে।

এমইউ/এমএমএআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।