গরমে ডায়রিয়ার প্রকোপ, ঈদের পর রোগী আরও বাড়তে পারে
গ্রীষ্মকাল শুরুর আগেই বাড়ছে তাপমাত্রা। প্রতিদিনই প্রখরতা দেখাচ্ছে সূর্য। এতে গরমে হাঁসফাঁস জনজীবন। সবচেয়ে বেশি অস্বস্তিতে ঢাকাসহ দেশের বড় শহরগুলোর বাসিন্দারা। এসময়ে হাসপাতালগুলোতেও বাড়ে রোগীর চাপ। এ বছরও চৈত্রের ভ্যাপসা গরমে ডায়রিয়াসহ নানা ধরনের পানিবাহিত রোগের প্রকোপ বেড়েছে। হাসপাতালগুলোতে এ ধরনের রোগীর উপস্থিতিও বেড়েছে।
ঢাকায় যারা ডায়রিয়াসহ পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন তাদের বেশিরভাগই মহাখালীর আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর’বি) বা কলেরা হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। এছাড়া প্রতিদিন এ ধরনের রোগী আসছেন ঢাকার বাইরের পার্শ্ববর্তী জেলাগুলো থেকেও। মহাখালীর কলেরা হাসপাতালে সাধারণ সময়ে প্রতিদিন গড়ে তিনশো থেকে সাড়ে তিনশো রোগী এলেও বর্তমানে গরমের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এ সংখ্যা বেড়ে সাড়ে চারশো থেকে পাঁচশো বা তারও বেশি হয়ে গেছে।
চিকিৎসকরা বলছেন, রমজানে পানি পান কম হয়। বাইরের খাবারও কম খাওয়া হচ্ছে। এখনো ডায়রিয়ার প্রকোপ সেভাবে বাড়েনি। তবে ঈদ পরবর্তী সময়ে সপ্তাহখানেকের মধ্যে ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা আরও অনেক বেড়ে যেতে পারে। এখন যারা অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে আসছেন তাদের বেশিরভাগই বয়স্ক ও শিশু
আইসিডিডিআরবির চিকিৎসকরা বলছেন, রমজানে সারাদিন পানি পান কম হয়। বাইরের খাবারও কম খাওয়া হচ্ছে। এখনো ডায়রিয়ার প্রকোপ সেভাবে বাড়েনি। তবে ঈদ পরবর্তী সময়ে সপ্তাহখানেকের মধ্যে ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা আরও অনেক বেড়ে যেতে পারে। এখন যারা অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে আসছেন তাদের বেশিরভাগই বয়স্ক ও শিশু।
গাজীপুর থেকে ১৭ মাস বয়সী শিশু আজানকে নিয়ে আইসিডিডিআরবি হাসপাতালে আছেন তার মাস শাহিনা আক্তার। হাসপাতালের বেডে বসে সন্তানকে স্যালাইন খাওয়াচ্ছিলেন তিনি। কথা হলে শাহিনা জাগো নিউজকে বলেন, কয়েকদিন ধরেই ছেলের বমি আর পাতলা পায়খানা হচ্ছে। প্রাথমিকভাবে ওষুধ সেবন করলেও সারছেই না। শরীর একেবারে দুর্বল হয়ে পড়ছে। বুকের দুধও নিচ্ছে না। এরপর এখানে চলে আসি। চিকিৎসা চলছে। বারবার একটাই দোয়া করছি, আল্লাহ যেন আমার সন্তানকে সুস্থ করে দেন।
আরও পড়ুন
সাজেদুল ইসলাম নামে ১৬ বছরের এক কিশোরও ভর্তি একই হাসপাতালে। কথা হলে সে বলে, ঢাকায় মেসে থাকি। হঠাৎ দুদিন আগে রাত থেকে পাতলা পায়খানা শুরু হয়। এরপর প্রচণ্ড পেটে ব্যাথা। ওষুধ খেয়েছিলাম, কাজ হয়নি। পরে এখানে এসে ভর্তি হয়েছি। এখন অবস্থা আগের চেয়ে কিছুটা ভালো।
গরমের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে পানিবাহিত রোগ
গত সোমবার (৮ জুলাই) সরেজমিনে আইসিডিডিআরবি হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেছে, হাসপাতালের বেশিরভাগ শয্যা ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগীতে পূর্ণ। কিছু রোগীকে সাধারণ চিকিৎসা দিয়ে ছুটি দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। যাদের সমস্যা বেশি তাদের বেশ কয়েকদিন ধরে ভর্তি থেকে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে। সকালের দিকে ভিড় কিছুটা কম থাকলেও প্রতিদিন বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে বাড়ে রোগীর চাপ। তবে ঈদের ছুটির কারণে রোগীর সংখ্যা কিছুটা কমেছে।
চিকিৎসকরা বলছেন, স্বাস্থ্য সচেতন না থাকা এসব রোগের প্রধান কারণ। একদিকে হঠাৎ গরম শুরু হয়, অন্যদিকে এসময়ে জীবাণুযুক্ত পানি পান, অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে বসবাস ও শিশুদের নিরাপদে না রাখা ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ায়। এছাড়া গরমে অনেকের মাঝে পানিশূন্যতাও তৈরি হয়ে থাকে। এজন্য প্রয়োজন গরমে বেশি বেশি বিশুদ্ধ পানি পান করা, ফলমূলের শরবত পান, পচা-বাসি ও বাইরের খাবার না খাওয়া এবং জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে যাওয়া থেকে বিরত থাকা।
কলেরা হাসপাতালে একাধিক রোগীর স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এই গরমে শুধু ঢাকা নয়, ঢাকার বাইরে থেকেও অনেক রোগী এসে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন। ডায়রিয়ার ফলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রোগীর বমি, ঘন ঘন মলত্যাগ, পেটে ব্যথা ও শরীর দুর্বল হয়ে যায়। অনেকের ক্ষেত্রে গায়ে জ্বর থাকতেও দেখা যায়। তারা জানান, অনেক রোগীকে বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে এ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়।
স্বাস্থ্য সচেতন না থাকা এসব রোগের প্রধান কারণ। জীবাণুযুক্ত পানি পান, অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে বসবাস ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ায়। গরমে অনেকের মাঝে পানিশূন্যতাও তৈরি হয়ে থাকে। এজন্য প্রয়োজন গরমে বেশি বেশি বিশুদ্ধ পানি পান করা, ফলমূলের শরবত পান, পচা-বাসি ও বাইরের খাবার না খাওয়া এবং জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে যাওয়া থেকে বিরত থাকা
আইসিডিডিআরবির পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত ২৮ মার্চ একদিনে ৫০৭ জন ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগী ভর্তি হন। ২৯ মার্চ থেকে ৩ এপ্রিল পর্যন্ত প্রতিদিন গড়ে ৫০০ জনের বেশি ডায়রিয়ার রোগী ভর্তি হন। এরপর গত ৪ এপ্রিল ৪৯৬ জন, ৫ এপ্রিল ৪৯০ জন, ৬ এপ্রিল ৫১২ জন ও ৭ এপ্রিল ৪৬১ জন ডায়রিয়ার রোগী ভর্তি হয়েছেন। তবে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে এখন পর্যন্ত কারও মৃত্যু হয়নি বলে জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আইসিডিডিআরবির অ্যাসিটেন্ট সায়েন্টিস্ট শোয়েব বিন ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, গত কদিনের অসহনীয় গরমে রোগীর চাপ স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেড়েছে। স্বাভাবিক সময়ে প্রতিদিন গড়ে ২৫০-৩০০ রোগী ভর্তি হন। এখন তা ৫০০ ছাড়িয়েছে। কিছুদিন আগে রোগীর চাপ আরও বেশি ছিল। এখন যে তাপমাত্রা বিরাজ করছে তা অব্যাহত থাকলে ঈদের পর এ হাসপাতালে ডায়রিয়া রোগীর চাপ আরও বাড়বে।
আরও পড়ুন
গরমের সময়ে ডায়রিয়া বা পানিবাহিত রোগ থেকে কীভাবে সুরক্ষিত থাকা যায়, এ নিয়ে হাসপাতালের চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা নানা পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
ফুটপাতে বা খোলা স্থানে তৈরি খাবার না খাওয়াই ভালো
ডায়রিয়া থেকে বাঁচতে যা করণীয়
আইসিডিডিআরবি হাসপাতালের কর্তব্যরত চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, ডায়রিয়া থেকে সুরক্ষিত থাকতে প্রথমত পানি ফুটিয়ে পান করতে হবে। পানি ফোটানোর সময় বলক ওঠার পর আরও পাঁচ মিনিট চুলায় রাখুন এবং ঠান্ডা করে পান করুন। ফোটানোর ব্যবস্থা না থাকলে প্রতি তিন লিটার পানিতে একটি পানি বিশুদ্ধকরণ ক্লোরিন ট্যাবলেট দিয়ে পানি নিরাপদ করা যেতে পারে।
স্ট্রিট ফুড কম খেতে হবে
আমরা সাধারণত রাস্তার পাশের বা উন্মুক্ত স্থানের খাবার খেয়ে থাকি। কিন্তু মুখরোচক এসব খাবার বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই খুব অস্বাস্থ্যকর। যা সুস্থ মানুষকেও অসুস্থ করে দিতে পারে। এসব খাবার ডায়রিয়ার ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
এছাড়া প্রতিবার খাবার আগে ২০ সেকেন্ড ধরে সাবান পানি দিয়ে ভালোভাবে হাত ধুতে হবে। পায়খানার পর অথবা শিশুর পায়খানা পরিষ্কার করার পর সাবান দিয়ে ভালো করে হাত ধুয়ে নিতে হবে।
গত কদিনের অসহনীয় গরমে রোগীর চাপ স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেড়েছে। স্বাভাবিক সময়ে প্রতিদিন গড়ে ২৫০-৩০০ রোগী ভর্তি হন। এখন তা ৫০০ ছাড়িয়েছে। কিছুদিন আগে রোগীর চাপ আরও বেশি ছিল। এখন যে তাপমাত্রা বিরাজ করছে তা অব্যাহত থাকলে ঈদের পর এ হাসপাতালে ডায়রিয়া রোগীর চাপ আরও বাড়বে
ফিডারে শিশুকে কিছুই খাওয়ানো যাবে না। যদি খাওয়াতেই হয়, তবে ফোটানো পানি ও সাবান দিয়ে ভালো করে ফিডারটি ধুয়ে নিতে হবে। ফিডারের নিপল-এর ছিদ্রটি ভালোভাবে পরিষ্কার করে রাখতে হবে।
ডায়রিয়া হলে যা করণীয়
চিকিৎসকরা জানান, কারও ডায়রিয়া হলে ১ প্যাকেট স্যালাইন আধা লিটার পানিতে গুলিয়ে খেতে হবে। ১০ বছরের বেশি বয়সীদের ডায়রিয়া হলে প্রতিবার পায়খানার পর ১ গ্লাস বা ২৫০ মিলিলিটার খাবার স্যালাইন খেতে হবে।
খাবার পানি ফুটিয়ে বা বিশুদ্ধ করে পান করতে হবে
শিশুদের ডায়রিয়া হলে প্রতিবার পায়খানার পর শিশুর যত কেজি ওজন তত চা-চামচ বা যতটুকু পায়খানা হয়েছে আনুমানিক সেই পরিমাণ খাবার স্যালাইন খাওয়াতে হবে। শিশু বমি করলে ধীরে ধীরে যেমন- ৩ বা ৪ মিনিট পর পর ১ চা-চামচ করে খেতে দিতে হবে।
আরও পড়ুন
খাবার স্যালাইনের পাশাপাশি দুই বছরের কম বয়সী শিশুকে অবশ্যই মায়ের বুকের দুধ খেতে দিতে হবে। শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানো কোনো অবস্থাতেই বন্ধ করা যাবে না। ছয় মাসের বেশি বয়সী রোগী খাবার স্যালাইনের পাশাপাশি সব ধরনের স্বাভাবিক খাবার খাবেন। রোগীকে খাবার স্যালাইনের পাশাপাশি বেশি বেশি তরল খাবার যেমন- ডাবের পানি, চিড়ার পানি, স্যুপ ইত্যাদি খাওয়াতে হবে।
এছাড়া রোগীকে সাধ্যমত কোমল পানীয়, ফলের জুস, আঙুর, বেদানা খাওয়াতে হবে। ছয় মাস থেকে পাঁচ বছর বয়সী শিশুকে প্রতিদিন একটি করে জিংক ট্যাবলেট পানিতে গুলিয়ে ১০ দিন খাওয়াতে হবে। তারপরও রোগীর অবস্থার উন্নতি না হলে বা বেশি খারাপ হলে দ্রুত কাছাকাছি কোনো হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিতে হবে। চিকিৎসকের সঙ্গে দ্রুত যোগাযোগ করে পরামর্শ নিতে হবে।
এএএম/এমকেআর/এএসএম