চিকিৎসায় গাফিলতিতে মৃত্যু

অভিযোগ নিষ্পত্তি করতেই বিএমডিসির বছর পার

আবদুল্লাহ আল মিরাজ
আবদুল্লাহ আল মিরাজ আবদুল্লাহ আল মিরাজ , নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৪:৫৫ পিএম, ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

ইডেন কলেজের শিক্ষার্থী মাহবুবা রহমান আঁখি (২৫)। নরমাল ডেলিভারির আশায় কুমিল্লার দাউদকান্দি থেকে রাজধানীর গ্রিন রোডে সেন্ট্রাল হাসপাতালে আসেন তিনি। মূলত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে হাসপাতালের গাইনি চিকিৎসক ডা. সংযুক্তা সাহার নরমাল ডেলিভারি সংক্রান্ত ভিডিও দেখে ও পরামর্শ শুনেই এখানে আসেন তিনি। আঁখির ইচ্ছা ছিল ডা. সংযুক্তা সাহার কাছে ডেলিভারি করাবেন। কিন্তু তার এই হাসপাতালে আসাই যেন কাল হয়ে দাঁড়ায়। ভুল চিকিৎসায় মারা যায় তার নবজাতক সন্তান। সন্তানের মৃত্যুর সপ্তাহখানেক পর না ফেরের দেশে পাড়ি জমান আঁখিও। ঘটনাটি দাগ কেটে যায় দেশের মানুষের মনে। জড়িতদের শাস্তির দাবি ওঠে বিভিন্ন মহল থেকে।

পরে এ ঘটনা গড়ায় আদালত পর্যন্ত। মামলা, গ্রেফতারের পর জামিনও হয় অভিযুক্ত চিবিৎসকদের। তবে এ ঘটনায় ডা. সংযুক্তা সাহাসহ চিকিৎসায় জড়িত চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের এখনো সুরাহা দিতে পারেনি বাংলাদেশ মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি)। তবে তদন্ত শেষ হয়েছে। এ নিয়ে শৃঙ্খলা কমিটিতে আলোচনা শেষ হয়েছে। ৯ ফেব্রুয়ারি মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা শেষে সংস্থাটির ইসি মিটিংয়ে এই আলোচনার সিদ্ধান্ত জানানো হবে। সেখানে যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে সেটা চূড়ান্ত হবে।

আরও পড়ুন>> ভুল চিকিৎসায় নবজাতকের মৃত্যুর পর চলে গেলেন আঁখিও

অন্যদিক গত ৩১ ডিসেম্বর খতনার জন্য রাজধানীর বাড্ডার সাতারকুল ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয় শিশু আয়ানকে। খতনার পর চেতনা ফিরে না আসায় তাকে গুলশানে অবস্থিত ইউনাইটেড হাসপাতালে নিয়ে পিআইসিইউতে (শিশু নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র) লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়। সেখানে ৭ জানুয়ারি মৃত্যু হয় আয়ানের।

এ ঘটনায় আয়ানের পরিবার মামলা করে এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে অভিযোগ জানিয়ে জড়িত থাকা প্রতিষ্ঠান ও চিকিৎসকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আবেদন জানায়। তবে বিএমডিসি এখনো এ বিষয়ে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এ বিষয়ে শৃঙ্খলা কমিটি কিছুদিন পরই মিটিংয়ে বসবে। এরপর তদন্ত কমিটি বিষয়টি তদন্ত করবে। এরপর বিষয়টি নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে পারে।

দেশে চিকিৎসায় অবহেলাজনিত কারণে অভিযোগ করার একমাত্র জায়গা সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল বা বিএমডিসি। দেশে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ও চিকিৎসকের বিরুদ্ধে অবহেলা, ভুল চিকিৎসার অভিযোগ থাকলে বিএমডিসিতে অভিযোগ জানাতে হয়। তবে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সমাধানের দীর্ঘসূত্রতায় আটকে এসব অভিযোগের বেশিরভাগই সমাধান হয় না। বিচারে সর্বোচ্চ কয়েক মাসের নিবন্ধন স্থগিত ছাড়া এর থেকে বড় শাস্তি দেওয়া হয়নি এ পর্যন্ত।

আরও পড়ুন>> নবজাতকের মৃত্যু: সেন্ট্রাল হাসপাতালের ২ চিকিৎসকের দায় স্বীকার

বিএমডিসির সহকারী রেজিস্ট্রার কৌশিক জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিএমডিসিতে তিনভাবে অভিযোগ আসে। এর মধ্যে অনেকে কোর্টে মামলা করে, কোর্ট সেই অভিযোগ বিএমডিসিতে পাঠায় নিষ্পত্তির জন্য। আরেকটি হলো- স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে আসা অভিযোগ পাঠানো হয় বিএমডিসিতে। এছাড়া বিএমডিসিতে সরাসরি কিছু অভিযোগ আসে।’

অভিযোগ নিষ্পত্তিতে কত সময় লাগে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অভিযোগ এলে প্রথমে সেটি শৃঙ্খলা কমিটিতে উপস্থাপন করা হয়। সেখানে উত্থাপন করা হলে যদি বুঝতে পারে তারাই সমাধান করতে পারবে তাহলে তারা একটি সিদ্ধান্ত দেয়। সেখানে যদি মনে হয় তদন্ত দরকার, সেক্ষেত্রে বিএমডিসি একটি তদন্ত কমিটি করে। সেই তদন্ত কমিটি রিপোর্ট আবার শৃঙ্খলা কমিটিতে উত্থাপন করে। এরপর তারা যদি এর সঙ্গে একমত হয়, তাহলে তা ইসি কমিটিতে উত্থাপিত হয়। ইসি কমিটি সিদ্ধান্ত জানালে তা চূড়ান্ত হয়। তবে সেখানে যদি আবার বলা হয় আরও তদন্ত দরকার, সেক্ষেত্রে আবারও একই ধারায় কাজ হয়। এসব কিছু মিলিয়ে যে কোনো একটি অভিযোগ সমাধানে কমপক্ষে ছয় মাস, অনেক ক্ষেত্রে বছরেরও বেশি সময় লেগে যায়। মাসে তো দুটোর বেশি শৃঙ্খলা কমিটির মিটিং করা সম্ভব হয় না। আর যে কোনো ঘটনায় চার থেকে পাঁচটির কম মিটিং ছাড়া সমাধান হয় না।’

অভিযোগের শাস্তির বিষয়ে জানতে চাইলে বিএমডিসির কর্মকর্তাদের পক্ষ থেকে জানা যায়, এখন পর্যন্ত এক থেকে দুজনের চিকিৎসা সনদ আজীবনের জন্য বাতিল করা হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে কয়েক মাস থেকে বছর পর্যন্ত লাইসেন্স স্থগিত করা হয়। আবার অনেক ক্ষেত্রে চিকিৎসকদের ডেকে বিএমডিসি থেকে সতর্ক করা হয়।

আরও পড়ুন>> ‘ভুল চিকিৎসা’য় সেন্ট্রাল হাসপাতালের ২ চিকিৎসক গ্রেফতার

এ বিষয়ে জাতীয় স্বাস্থ্য আন্দোলনের সভাপতি অধ্যাপক রশিদ-ই-মাহবুব জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রথমত মানুষ এসব বিষয়ে খুব বেশি জানে না। আবার যারা জানে, তাদের ৯০ শতাংশ বিচারের দীর্ঘসূত্রতার কারণে ঘটনা মিটমাট করে। এ কারণে বিচার প্রক্রিয়া শেষ পর্যন্ত গড়ায় না।’

বিএমডিসি সূত্রে জানা যায়, গত ১৩ বছরে বিএমডিসিতে অভিযোগ জমা পড়েছে ৩১৪টি। চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে অবহেলা ও ভুল চিকিৎসার অভিযোগে ২০১০ সালে চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে চারটি অভিযোগ জমা পড়ে। এর পরের পাঁচ বছর জমা পড়ে মাত্র চারটি। এছাড়া ২০১৬ সালে ছয়টি, ২০১৭ সালে ১৪টি, ২০১৮ ও ২০১৯ সালে ২৬টি করে, ২০২০ সালে আটটি, ২০২১ সালে ৩২ এবং ২০২২ সালে জমা পড়ে ৩১টি অভিযোগ। ২০২৩ সালে অভিযোগ জমা পড়েছে ৪৬টি।

আরও পড়ুন>> মারা গেলো ইউনাইটেডে খতনা করাতে এসে লাইফ সাপোর্টে থাকা আয়ান

বিএমডিসির রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) ডা. মো. লিয়াকত হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘চিকিৎসায় যেসব সমস্যা জাতীয় ইস্যু হয়ে যায় তা সমাধানের দ্রুত চেষ্টা করা হয়। খতনা করাতে গিয়ে শিশু আয়ানের মৃত্যুর ঘটনায় বিএমডিসিতে অভিযোগ আসার আগেই আমরা বিষয়টি আমলে নিয়েছি। আমরা মিটিংয়ে উপস্থাপন করবো।’

আইনজীবীদের মতে, চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ থাকলে তা বিএমডিসির মাধ্যমেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়। সেখানে বেশিরভাগই চিকিৎসক। সে কারণে বেশিরভাগ অভিযোগের ক্ষেত্রেই প্রমাণ হয় না। সম্প্রতি ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শিশু আয়ানের মৃত্যুর ঘটনায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের তদন্ত রিপোর্ট পেয়ে উচ্চ আদালত সেই রিপোর্টকে ‘আই ওয়াশ’ বলেছেন।

আরও পড়ুন>> অবহেলায় নবজাতকের মৃত্যু, খোঁজ নেই চিকিৎসকের

অন্যদিকে দেশে ‘স্বাস্থ্যসেবা ও সুরক্ষা আইন ২০২৩’ নামে একটি আইনের খসড়া করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। তবে এটি এখনো আইনে পরিণত হয়নি। আইনের খসড়ায় চিকিৎসায় অবহেলাজনিত কারণে রোগীর মৃত্যু হলে ফৌজদারি আইনে বিচার এবং আদালত কর্তৃক নির্ধারিত ক্ষতিপূরণ আদায়ের কথা বলা হয়েছে। খসড়ায় হাসপাতালের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হলে লাইসেন্স বাতিল ও চিকিৎসকের ক্ষেত্রে নিবন্ধন বাতিলের সুপারিশের কথা উল্লেখ আছে।

এএএম/ইএ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।