মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে ভ্রান্ত ধারণা
আমি কেন মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নেবো, আমি কি পাগল?
>পুরুষের তুলনায় নারীদের মানসিক সমস্যা দেড় গুণ বেশি
>দেশে ৯২ শতাংশ মানসিক রোগী চিকিৎসা নেন না
>মানসিক চিকিৎসার বাইরে থেকে যাচ্ছে নারী ও প্রবীণরা
মানসিক রোগের বিষয়টি গোটাবিশ্বে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিত হলেও বাংলাদেশে এখনও অবহেলিত। মানসিক অসুস্থতাকে দেশের অধিকাংশ মানুষ কোনো রোগ বলে মানতেও নারাজ। মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের জরিপে উঠে আসে, দেশের ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক এবং ১২ দশমিক ৬ শতাংশ শিশু-কিশোর মানসিক রোগে ভুগছে। মানসিক রোগীদের ৯২ ভাগই কোনো ধরনের চিকিৎসা নেন না। শুধু তাই নয় চিকিৎসকরা বলছেন, পুরুষের তুলনায় নারীদের মানসিক সমস্যা প্রকট।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতে, মানসিক রোগ মোটা দাগে দুই ধরনের। তন্মধ্যে গুরুতর হলো সিজোফ্রেনিয়া, বাইপোলার মুড ডিসঅর্ডার, ডিমেনশিয়া, আলঝেইমারস। সাধারণ মানসিক সমস্যার মধ্যে রয়েছে দুশ্চিন্তা, অনিদ্রা, শুচিবায়ু, ফোবিয়া বা ভীতি ও বিষণ্নতায় ভোগা। বাইপোলার ডিসঅর্ডার হলো দীর্ঘমেয়াদী মানসিক সমস্যা।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মোহিত কামাল বলেন, মানসিক সমস্যা বাড়ার কারণ হলো মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে স্টিগমা বা নেতিবাচক সংস্কার। এ কারণে প্রথম বাধাটা আসে নিজের ভেতর থেকে। অনেকের মতে, আমি কেন মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নেবো, আমি কি পাগল? এরপর পরিবারও মনে করে, কেন মানসিক রোগের চিকিৎসা নিতে হবে? অর্থাৎ প্রথম বাধাটা মূলত মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে ভ্রান্ত ধারণা থাকা।
অধ্যাপক ডা. মোহিত কামাল আরও বলেন, তরুণদের মন চঞ্চল ও সংবেদনশীল হয়। তারা বিষণ্নতায়ও ভোগে বেশি। তাই তরুণদের মনের যত্ন নেওয়া জরুরি। তরুণরা সমস্যায় পড়লে তাদের উচিত মন খুলে কথা বলা। তাদের কথা শুনতে হবে। আবার তরুণরাও যেন অন্যদের কথা শোনে। নিজেকে ভালোবাসার পাশাপাশি ইতিবাচক চিন্তা ও আচরণ করা দরকার।
পুরুষের তুলনায় নারীদের মানসিক সমস্যা প্রায় দেড় গুণ বেশি:
দেশের মোট জনসংখ্যার তুলনায় প্রতি ৬ জনের ১ জন কোনো না কোনো মানসিক রোগে ভুগছেন। পুরুষের তুলনায় নারীদের আক্রান্তের সংখ্যাটা প্রায় দেড় গুণ বেশি। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের শিশু মনোরোগ বিভাগের প্রধান ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, নারীদের মানসিক সমস্যা সারাবিশ্বে বেশি। এর কারণ হলো নারীদের জিনগত গঠন, সামাজিক বঞ্চনা, স্বাধীনতা না থাকা, দারিদ্র্যতা, পারিবারিক কলহ কিংবা সাংসারিক ঝামেলা। এছাড়াও বিষন্নতা বা অন্যান্য মানসিক রোগের ক্ষেত্রে নারীদের হার পুরুষের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি।
আরও পড়ুন>বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস আজ
ডা. হেলাল আহমেদ বলেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে শৈশব থেকে তাদের ভিন্ন চোখে দেখার প্রবণতা, পরিবারের নানা কাজে তাদের মতামত গ্রহণ না করা, ক্ষমতায়ন না করা, কোনো কিছু হলেই নেতিবাচক মন্তব্য করা, পরিবারে বাবা-মায়ের ঝগড়া দেখে বড় হওয়া, বিয়ের পর নির্যাতনের শিকার হওয়া, স্কুলে বা কলেজে বুলিংয়ের শিকার হওয়া। এসব কারণে মূলত বেশি মানসিক রোগে আক্রান্ত হন নারীরা।
প্রবীণদের মাঝে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা সবচেয়ে বেশি:
২০০৫ ও ২০১৮ সালের জরিপের তথ্য বলছে, ৫৫ বছরের বেশি মানুষের মানসিক সমস্যা সবচেয়ে বেশি। এই হার ২০ শতাংশের বেশি। তাদের মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়টি আরও বেশি অবহেলিত হয়ে থাকে। অথচ দেশের ৪২ শতাংশ প্রবীণ গুরুতর মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় আক্রান্ত।
ডা. হেলাল আহমেদ বলেন, দেশে প্রবীণদের সংখ্যা বাড়ছে। পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, এই সংখ্যা প্রায় দুই কোটি। মানুষের বয়স যত বাড়তে থাকে মানসিক রোগ হওয়ার আশঙ্কা কিন্তু বেশি হতে থাকে। ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, বাতের সমস্যা, ক্যানসার, কিডনির সমস্যা এসব রোগ যাদের বেশি তাদের মানসিক সমস্যা হওয়ার শঙ্কাও বেশি থাকে। এ জন্য তাদের চিকিৎসা নিয়ে প্রথমে পরিবারকে এগিয়ে আসতে হবে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, প্রবীণদের মানসিক স্বাস্থ্য অবহেলায় থেকে যায় কারণ তারা উর্পাজনে সক্ষম নয়।
ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ আরও বলেন, গবেষণায় দেখা গেছে, ২৫ থেকে ৩৩ শতাংশ গুরুতর মানসিক রোগ চিকিৎসার মাধ্যমে সারিয়ে তোলা যায়। বাকি ওষুধ বা চিকিৎসার মাধ্যমে রোগটিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে তবে রোগী পুরোপুরি সুস্থ হয় না। বেশিরভাগ রোগীর ওষুধের সেবন প্রক্রিয়া ও জীবনযাপন সঠিকভাবে না করায় সুস্থতায় বাধা তৈরি হয়। বাংলাদেশে দুই তৃতীয়াংশ মানুষ মানসিক রোগীর ক্ষেত্রে সঠিকভাবে চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করছেন না বলেও জানান তিনি।
আরও পড়ুন> কর্মক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা
৬ শতাংশ কমেছে শিশু-কিশোরদের মানসিক রোগ:
দেশে ২০১৮ থেকে ২০১৯ সালের জাতীয় জরিপে দেখা গেছে, ৭ থেকে ১৮ বছর বয়সে শিশু-কিশোরদের প্রায় ১২ দশমিক ৬ শতাংশ মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছে । এর আগে ২০০৯ সালে এক জরিপে ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সীদের মধ্যে মানসিক সমস্যা দেখা গিয়েছিল ১৮ দশমিক ৪ শতাংশ। অর্থাৎ শিশু কিশোরদের ৬ শতাংশ কমেছে মানসিক রোগ।
মানসিক স্বাস্থ্যখাতে বাজেট অপ্রতুল:
স্বাস্থ্য বাজেটের মাত্র শূন্য দশমিক ৪৪ শতাংশ বরাদ্দ পায় মানসিক স্বাস্থ্যখাত। এ বিষয়ে ডা. হেলাল আহমেদের কাছে জানতে চাইলে তিনি জানান, মানসিক স্বাস্থ্যখাতে বাজেট বরাদ্দ অনেক কম। তবে এ ক্ষেত্রে একটি বড় বিষয় হচ্ছে আমাদের অনেক বেশি মেশিনারিজ প্রয়োজন হয় না। কেনাকাটার প্রয়োজন হয় না। আমাদের যে বাজেট হয় তাও সঠিকভাবে খরচ করতে পারলে এই খাতে অগ্রগতি সম্ভব।
মানসিক স্বাস্থ্য চিকিৎসায় চিকিৎসক অপ্রতুল:
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বলছে, প্রতি ১০ হাজারে একজন মানসিক চিকিৎসক প্রয়োজন। সে হিসেবে আমাদের দেশে প্রতি লাখেও ১ জন করে মানসিক স্বাস্থ্য চিকিৎসক নেই। দেশে প্রতি লাখে সাইকিয়াট্রিস্ট আছেন শূন্য দশমিক ১৭ জন। আর সাইকোলজিস্ট আছেন শূন্য দশমিক ৩৪ জন। এছাড়া সংশ্লিষ্ট খাতে অন্যান্য জনবল হাতেগোনা কয়েকজন। প্রতি ২ লাখ মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যসেবায় কর্মরত ১ জন। মানুষের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিতে এই খাতে জনবল বৃদ্ধির বিকল্প নেই বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
এ বিষয়ে ডা. হেলাল বলেন, গত ১৫ বছরে বাংলাদেশে মানসিক স্বাস্থ্য চিকিৎসা অনেক দূর এগিয়েছে। এসময়কে আমরা মানসিক স্বাস্থ্য চিকিৎসার স্বর্ণযুগ বলতে পারি। এর মাঝে মানসিক স্বাস্থ্য আইন হয়েছে, মানসিক স্বাস্থ্যের নীতি হয়েছে, কর্মকৌশল হয়েছে। বর্তমানে আমাদের বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে তা বাস্তবায়ন করা। আমরা প্রান্তিক পর্যায়ে মানসিক স্বাস্থ্যসেবাকে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করছি। আমাদের ৩৫০ জন মানসিক চিকিৎসক এবং ৫০০ জন সাইকোলোজিস্ট দিয়ে ১৭ কোটি মানুষকে চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব না। তাই আমরা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কিছু প্রশিক্ষণকে সাধারণ চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীর কাছে নিয়ে যাচ্ছি যাতে প্রান্তিক পর্যায়েও মানুষ চিকিৎসা পেতে পারে। একজন বিশেষজ্ঞ তৈরিতে তো কমপক্ষে ৭ থেকে ৮ বছর সময় লেগে যায়। এ সময়ের মাঝে আমাদের সেবা দিতে এই প্রশিক্ষণগুলো কার্যকর ভূমিকা রাখবে বলে আশা করি।
এএএম/এসএনআর/জিকেএস