ক্যানসারের সঙ্গে ডেঙ্গু, সন্তান-পরিবার নিয়ে অথৈ সাগরে মাসুম
ঢাকার পশ্চিম নন্দীপাড়ায় থাকেন মাসুম মাহমুদ। পেশায় কাঠমিস্ত্রি। শরীরে বাসা বেঁধেছে ক্লোন ক্যানসার। এর মধ্যে দেখা দিয়েছে ডেঙ্গু। যার আয়ে বাবা-মা, স্ত্রী ও দেড় বছর বয়সী সন্তানের খরচ চলে, সংসারের চাকা ঘোরে, তিনিই এখন হাসপাতালের বিছানায়। কীভাবে চলবে খরচ, ওষুধ আসবে কোথা থেকে তা নিয়ে পাহাড়সম চিন্তা। তারপরও মাসুমের স্বপ্ন সব ঠিক হয়ে যাবে একদিন। আবার হাল ধরবেন সংসারের, শিশুসন্তানকে মানুষ বানাবেন।
রোববার (১৭ সেপ্টেম্বর) রাজধানীর মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পুরুষ ওয়ার্ডে বসে এমনই স্বপ্নের কথা জাগো নিউজকে বলছিলেন তিনি।
মাসুম বলেন, ক্লোন ক্যানসারের কারণে সার্জারি করা লেগেছে। এখন চলছে কেমোথেরাপি। শরীর কালো হয়ে এসেছে। মোট ছয়টা কেমোর মধ্যে দেওয়া হয়েছে তিনটা। প্রতি কেমোর জন্য ওষুধসহ প্রায় ২০ হাজার টাকা খরচ হয়। ধারদেনা আর অসুস্থ শরীর নিয়ে কাজ করে টাকা জোগাড় করি। ওষুধের খরচ মিটিয়ে চালাতে হয় সংসার। কিন্তু ডেঙ্গু হওয়ার কারণে চাপ আরও বেড়ে গেছে। ওষুধ-চিকিৎসার জন্য এখন অতিরিক্ত টাকা গুনতে হচ্ছে। তার (স্ত্রী) বড় ভাই কিছু টাকা দিয়েছেন। তা দিয়ে আপাতত চলছে চিকিৎসা।
আরও পড়ুন: ‘সুদে টাকা এনে স্বামীর ডেঙ্গু চিকিৎসা করাচ্ছি’
মাসুম যে এখন কতটুকু অসহায় তা তার কথায় ফুটে উঠেছে। তিনি বলেন, আমি এমন পরিস্থিতির মধ্যে আছি যে, কাউকে সাহায্যের জন্য বলতে পারছি না। কারণ নিজেই সংসার চালিয়েছি। কোনোদিন কারও মুখাপেক্ষী হইনি। এখন অনেকটাই অন্যের মুখাপেক্ষী। হাসপাতালে শুয়ে আছি, শরীর খারাপ। এখনো তিনটা কেমো নেওয়া বাকি। টাকা নেই, চিকিৎসা চালাতে পারছি না। কার কাছে যাবো, কে সহযোগিতা করবে এসব ভেবে মাঝেমধ্যে নিজেকে অন্য জগতে হারিয়ে ফেলি। পরে আবার যখন আমার শিশুসন্তানের মুখের দিকে তাকাই, তখন বুকটা ভরে ওঠে। ভাবি সব ঠিক হয়ে যাবে। অর্থকষ্ট থাকবে না, পরিবার নিয়ে আগের মতো চলতে পারবো, শরীরও আগের মতো কাজ করবে।
মাসুমের পরিবার জানায়, এর আগে সার্জারি ও অন্যান্য খরচ মিলে তাদের প্রায় চার লাখ টাকা খরচ হয়েছে। এখনো ওষুধ ও কেমো দেওয়া হচ্ছে। অত্যধিক কড়া ওষুধের কারণে মাসুমের শরীরের বিভিন্ন অংশ কালো হয়ে গেছে। এরমধ্যে আবার ডেঙ্গু হওয়ায় দুর্বল হয়ে যাচ্ছে শরীর। খরচ হচ্ছে অনেক। প্রতিদিনই টেস্ট করা লাগছে, প্লাটিলেট দেখার জন্য।
আরও পড়ুন: থামছে না ডেঙ্গু আক্রান্ত-মৃত্যু, স্যালাইনের জন্য হাহাকার
মাসুম বলেন, এখন সমাজের বিত্তবানদের সহযোগিতা পেলে ভালো। কিন্তু আমরা অনেক আগেই কুমিল্লা থেকে ঢাকায় চলে এসেছি। গ্রামে না যাওয়ায় সেখানকার লোকদেরও তেমন চিনি না। কার কাছে সহযোগিতার জন্য যাবো।
ডেঙ্গু যে শুধু মাসুমের জীবনই ওলটপালট করেছে তা কিন্তু নয়। তার মতো আরও অনেকের জীবন করে দিয়েছে দুর্বিষহ।
তেমনই একজন সৌরভ। তিনিও ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মুগদা হাসপাতালে ভর্তি। শ্যামপুরের বাসিন্দা। পাঁচদিন ধরে চিকিৎসা নিচ্ছেন এ হাসপাতালে। আড়াই বছর বয়সী সন্তানসহ বিছানায় এখন তার জীবন কাটে। আর তার পাশে রয়েছেন স্ত্রী। তিনিই এখন হাসপাতালে লাইনে দাঁড়িয়ে পরীক্ষার টাকা জমা দেওয়া, রিপোর্ট উঠানো, ওষুধ কেনাসহ ঘরের কাজ সবই করছেন।
আরও পড়ুন: ডেঙ্গু আক্রান্ত কোনো রোগীকে ঢাকায় স্থানান্তর না করার নির্দেশ
সৌরভ জাগো নিউজকে বলেন, পরিবারের আয় যা আছে তা দিয়ে সংসার চলছে, চিকিৎসা চলছে। তেমন সমস্যা হচ্ছে না। তবে সংসার-সন্তান নিয়ে মাঝেমধ্যে চিন্তা হয়। আমি সুস্থ না হলে কীভাবে চলবে সব। দোয়া চাই যাতে সুস্থ হয়ে আবারও স্বাভাবিক হতে পারি।
ডেঙ্গুর কারণে এমন হাজারো মানুষ অসহায় হয়ে পড়েছেন। কেউ কেউ হারিয়েছেন তার আপনজনকেও। তছনছ হয়ে গেছে একেকটি পরিবার। শুধু রাজধানী নয়, সারাদেশেই ছড়িয়ে পড়েছে ডেঙ্গু।
এরমধ্যে রাজধানীর যেসব হাসপাতালে ডেঙ্গুরোগীর চাপ বেশি তার মধ্যে অন্যতম মুগদা হাসপাতাল। শুধু ডেঙ্গুরোগীর জন্যই এখানে খোলা হয়েছে তিনটি ওয়ার্ড। এ হাসপাতালে চলতি (সেপ্টেম্বর) মাসে প্রতিদিন গড়ে প্রায় একজন করে ডেঙ্গুরোগীর মৃত্যু হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
মুগদা হাসপাতালে গত জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত মোট ১০ হাজার ২৭০ জন ডেঙ্গুরোগী ভর্তি হন। তাদের মধ্যে মারা গেছেন ১১৬ জন। হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়েছেন নয় হাজার ৮৪৬ জন। চিকিৎসাধীন ৩০৮ জন।
এছাড়া সারাদেশে চলতি (সেপ্টেম্বর) মাসে ডেঙ্গুতে গড়ে প্রতিদিন ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। মাত্র ১৪ দিনে এ রোগে মৃত্যু হয়েছে ১৮৫ জনের। গত আগস্ট মাসের প্রথম দুই সপ্তাহে মারা গিয়েছিলেন ১৬৫ জন। এর আগে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে সর্বোচ্চ মৃত্যুর রেকর্ড হয়েছিল গত বছর ২৮১ জন।
আরও পড়ুন: ‘ভুল ধারণায়’ আটকে থাকায় বাড়ছে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা
এছাড়া ২০১৯ সালে মৃত্যু হয়েছিল ১৭৯ জন, ২০২০ সালে সাতজন এবং ২০২১ সালে ১০৫ জনের মৃত্যু হয় ডেঙ্গুতে। সবশেষ সারাদেশে ১৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মারা গেছেন ৮২২ জন। ১ জানুয়ারি থেকে ১৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এক লাখ ৬৭ হাজার ৬৮৪ জন।
মুগদা হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. নিয়াতুজ্জামান টুটুল জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের এখানে ভর্তি রোগীর প্রায় সবাই সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরছেন। তবে মৃত্যুর ঘটনা একটু অস্বাভাবিক।’
ইএআর/জেডএইচ/জেআইএম