ডেঙ্গু আক্রান্ত ভাই আইসিইউতে, নীরবে চোখের পানি ফেলছেন সাইফুল
স্টার লাইন পরিবহনের লাইনম্যান সাইফুল ইসলাম। মুগদা হাসপাতালের আইসিইউর সামনে বসে আছেন প্লাস্টিকের টুলে। মন ভারাক্রান্ত। একটু পরপর তাকাচ্ছেন আইসিইউর দরজার দিকে। এই বুঝি এলো কোনো সংবাদ! নিজের অগোচরেই মাঝে মধ্যে ভিজে যাচ্ছে চোখ। পাশে নিকটাত্মীয় কেউ এলে চোখের পানি মুছছেন তড়িঘড়ি করে। কাউকে বুঝতে দিতে চান না কষ্ট।
ধীর পায়ে কাছে গিয়ে কথা বলে জানা যায় সাইফুল ইসলামের ভাই মো. শরিফ আইসিইউতে ভর্তি। দুই মেয়ের জনক শরিফ। সপ্তাহখানেক আগে তিনি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন। এর আগে তার জন্ডিসসহ কিডনি রোগ ছিল। পেশায় রিকশাচালক। চিকিৎসার খরচ বহন করার ক্ষমতা তার একার নেই। তবে চিকিৎসার কমতি রাখেননি ভাই সাইফুল।
এরই মধ্যে খরচ হয়ে গেছে ৫০ হাজার টাকা। নিজের সম্বল একটা সিএনজি অটোরিকশা ছিল সাইফুলের। সেটাও লোকসানে তিন লাখ ৮০ হাজার টাকায় বিক্রি করেছেন। যে কোনো কিছুর বিনিময়ে ভাইকে সুস্থ করে তোলা।
আরও পড়ুন>> ডেঙ্গুর সঙ্গে লড়ছে চার সন্তান, দিশেহারা মা আসমা আক্তার
রোববার (১৭ সেপ্টেম্বর) সাইফুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, আমরা একই মায়ের পেটের সন্তান। আমাদের সম্পদ নেই তেমন। ছোট ভাইর (অসুস্থ শরিফ) অবস্থা আরও খারাপ। আমরা আলাদা সংসারে বসবাস করলেও একজনের উপকারে অন্যজন যতটা পারি সহযোগিতা করি। আজ আমার ভাই অসুস্থ। কিন্তু আমিতো সুস্থ। তাকে সুস্থ করার জন্য আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো।
তিনি বলেন, আমার এই মুহূর্তে টাকার দরকার ছিল। চিকিৎসার জন্য অনেক টাকার প্রয়োজন। হাতে ৫০-৬০ হাজার টাকা ছিল সব শেষ। আমার শেষ সম্বল সিএনজিচালিত অটোরিকশা ছিল সেটাও বিক্রি করেছি। আমার ভাই সুস্থ হবে, তার পরিবারের হাল ধরবে এ প্রত্যাশা আমার। আমি সব সময় আইসিইউর সামনে থাকছি, কোনো খবর কিংবা ডাক্তার যদি এসে বলেন কিছু লাগবে এজন্য বাইরে যেতে পারছি না।
আরও পড়ুন>> ‘সুদে টাকা এনে স্বামীর ডেঙ্গু চিকিৎসা করাচ্ছি’
অসুস্থ শরিফের এক মেয়ের বয়স ১৬ বছর ও আরেকজনের ১৪ বছর। ভালোই চলছিল তার সংসার। যদিও শারীরিক সমস্যা রয়েছে দীর্ঘদিন ধরেই। তার গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়ার খোকসা হলেও এখন থাকেন রাজধানীর মুগদায়।
১০ সেপ্টেম্বর প্রথমে জ্বর আসে শরিফের। পরে তার অবস্থার অবনতি হলে সেদিনই ডেঙ্গু পরীক্ষা করানো হয়। পরের দিন সেটা পজিটিভ আসে। এরপরই মুগদা মেডিকেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এখন ডেঙ্গু নেগেটিভ এলেও শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়েছে। আগে থেকেই জন্ডিসে আক্রান্ত ছিলেন, সঙ্গে কিডনি রোগও ছিল। গতকাল খুবই খারাপ অবস্থা হওয়ায় আইসিইউতে নেওয়া হয় শরিফকে। দেখভালের জন্য তার মা, বোন ও ভাই সাইফুল ইসলাম রয়েছেন সব সময়।
সারাদেশে বেসামাল ডেঙ্গু পরিস্থিতি। প্রতিদিনই আক্রান্তের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মৃত্যু। চলতি (সেপ্টেম্বর) মাসে এখন পর্যন্ত গড়ে প্রতিদিন ১৩ জনের মৃত্যু হচ্ছে। মাসটির দুই সপ্তাহে এত বেশি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে যে দেশের ইতিহাসে কোনো মাসের দুই সপ্তাহে এত বেশি মানুষের মৃত্যু হয়নি। মাত্র ১৪ দিনে এ রোগে মৃত্যু হয়েছে ১৮৫ জনের। গত আগস্ট মাসের প্রথম দুই সপ্তাহে মারা গিয়েছিলেন ১৬৫ জন। এর আগে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে সর্বোচ্চ মৃত্যুর রেকর্ড হয়েছিল গত বছর, ২৮১ জন।
আরও পড়ুন>> থামছে না ডেঙ্গু আক্রান্ত-মৃত্যু, স্যালাইনের জন্য হাহাকার
এছাড়া ২০১৯ সালে মৃত্যু হয়েছিল ১৭৯ জন, ২০২০ সালে সাতজন এবং ২০২১ সালে ১০৫ জনের। চলতি বছর মৃত্যু এরই মধ্যে ৮শ ছাড়িয়ে গেছে।
এবার ঢাকায় মশার ঘনত্ব বেড়েছে, ডেঙ্গুরোগীর সংখ্যাও বেড়েছে, যা অন্য বছরের তুলনায় অনেক বেশি। অনেক বাসার ফ্রিজের ট্রে, থালা-বাসন রাখার র্যাকের নিচে জমে থাকা পানিতে লার্ভা পাওয়া গেছে। এতে দীর্ঘায়িত হবে ডেঙ্গু সংক্রমণ- এমনটাই বলছেন বিশেষজ্ঞরা। এরপর এখনো ভুল ধারণায় আটকে আছে এক শ্রেণির মানুষ, যাদের বসবাস ছয় কিংবা সাততলায়। বিশেষ করে মেসে থাকা কিংবা ব্যাচেলর বাসায় এ অসচেতনতা ও ভুল ধারণা বেশি।
তবে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাসা-বাড়ির যে কোনো তলা থেকে তার ওপরের তলায় সহজেই যেতে পারে মশা। ভুল ধারণার ওপর ভিত্তি করে অসাবধান হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
ইএআর/এএসএ/এএসএম