ডেঙ্গুর বাড়বাড়ন্তেও মশারির বিক্রি কম, দাম চড়া
নাসিরুল ইসলাম। পড়ালেখা করছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে। থাকেন পুরান ঢাকার রায়সাহেব বাজার এলাকায়। একটি ফ্ল্যাটের ছয়তলায় মেস হিসেবে থাকেন কয়েকজন মিলে। শুরু থেকেই মশারি বা কয়েল ব্যবহার করেন না। তাদের ধারণা ছয়তলায় মশা যায় না। সম্প্রতি মেসের দুজন সদস্য জ্বরাক্রান্ত হন। টেস্টে ডেঙ্গু ধরা পড়ে একজনের।
এর পরই নড়ে-চড়ে বসেন তারা। এখন প্রতিদিনই কয়েল জ্বালিয়ে ঘুমান। তবে নাসিরুল ইসলাম আলাদাভাবে ঘুমানোর জন্য মশারি কিনতে এসেছেন গুলিস্তানে। গরমের কারণে একটু ভালোমানের মশারি চাইছেন। যাতে বাতাস সহজে আসা-যাওয়া করতে পারে। তবে তার ধারণার চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ দাম চাওয়া হচ্ছে মশারির।
আরও পড়ুন>>নিম্নমানের মশার কয়েলে সয়লাব বাজার, স্বাস্থ্যঝুঁকিতে মানুষ
দোকানে কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘মশারি কিনবো দেখে গতকাল গ্রাম থেকে টাকা পাঠিয়েছে। ভাবছি একটু ভালোটা নেবো। ৪শ টাকায় হয়ে যাবে। একটা ছাপা মশারি বড়টার দাম চাওয়া হচ্ছে ৮শ টাকা, আরেকটি ১২শ টাকা চাইছেন বিক্রেতা। নরমাল মশারিও চাওয়া হচ্ছে ৪শ টাকা। অথচ এর আগে ভ্যানগাড়িতে ভালোমানের মশারিই চার থেকে সাড়ে চারশ টাকায় পাওয়া যেত।’
একই কথা বলেন সাইদ আহমেদ। তিনি গুলিস্তানে একটি জরুরি কাজে এসে মশারি নেওয়ার কথা ভাবেন। তবে ধারণার চেয়ে বেশি দাম চাওয়ায় সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলেন না। পরে বাধ্য হয়ে একটা পাঁচ ফুট বাই সাত ফুটের নরমাল মশারি কিনেছেন সাড়ে চারশ টাকা দিয়ে। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘এর আগে দাম কমেছিল। এখন ডেঙ্গুরোগীর সংখ্যা বাড়ায় মশারির দামও বেশি চাওয়া হচ্ছে।’
মশারির বিক্রি তুলনামূলক কম হচ্ছে জানিয়ে এখানকার ব্যবসায়ীরা জাগো নিউজকে বলেন, করোনার পর থেকেই সুতার বাজার বেশ চড়া। ধীরে ধীরে সুতার তৈরি সব পণ্যের দাম বাড়ছে। মশারির দামও বেড়েছে। ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ায় আরও একটু বেড়েছে, তবে তা খুব বেশি নয়।
আরও পড়ুন>>প্লাটিলেটে চড়া খরচ, ডেঙ্গুর চিকিৎসায় পকেট ফাঁকা
খুচরা মশারি বিক্রেতা গুলজার হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘মশারির বিক্রি আর আগের মতো নেই। অনেকেই কিনেছেন মশারি। একবার কিনলে তো দুই বছরে আর মশারি কেনা লাগে না।’
বিক্রি কমার পরও দাম চড়া কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অনেক দিন ধরেই মশারির বাজার একটু চড়া। ডেঙ্গু আসার পর কিছুটা দাম বেড়েছে। কিন্তু বিক্রি বাড়েনি।’
খুচরায় রাজধানীর ফুলবাড়িয়া সিটি সুপার মার্কেট, জাকের মার্কেট, সিদ্দিকবাজার শপিং কমপ্লেক্স, গুলিস্তান মার্কেট ও এর আশপাশে একটা ছোট সিঙ্গেল মশারি (নরমাল) বিক্রি হচ্ছে ২৫০ থেকে তিনশ টাকা, সিঙ্গেল একটু ভালোমানেরটা চারশ টাকা, বড় মশারি ম্যাজিক চার থেকে ৬শ টাকা, বড় মজবুত সুতি ৭শ থেকে ৮শ টাকা, বড় ছাপা মশারি (প্রিমিয়াম কোয়ালিটি) ৮শ টাকা, ডিব্বা বোনাফাইড অ্যানজেল মশারি ৯শ থেকে ১২শ টাকা, হোমটেক্স ডিব্বা ১৪শ টাকার মধ্যে বিক্রি হচ্ছে।
এ এম এন্টারপ্রাইজের মালিক জাহিদ জাগো নিউজকে বলেন, মশারির বিক্রি এখন কমে গেছে। অনেক এনজিও, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও দাতা সংস্থা এখন মশারি বিতরণ করছে। গরিব মানুষসহ অনেকেই মশারি পেয়েছেন। এতে মশারির বিক্রি কম হচ্ছে হয়তো, তবে একেবারেই কম বলা যাবে না, স্বাভাবিক বিক্রি হচ্ছে।
মশারির বিকল্প হিসেবে মশা প্রতিরোধক লিকুইড কিনছেন অনেকে। গুলিস্তানের বিভিন্ন দোকানে মর্টিনের লিকুইড বিক্রি হচ্ছে ২১০ থেকে ২২০ টাকার মধ্যে। এছাড়া মশা মারার ব্যাট কোয়ালিটিভেদে বিক্রি হচ্ছে ৫শ থেকে এক হাজার টাকার মধ্যে।
আরও পড়ুন>>ছোট মেয়ে আইসিইউতে, বড় মেয়ে ওয়ার্ডে
ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিশেষজ্ঞরা বারবার মশারির ব্যবহার বাড়াতে বললেও এতে অনীহা অনেকের। মশারি টাঙানো একটা ঝামেলা মনে করেন কেউ কেউ। মশারি ব্যবহারের পরিবর্তে কয়েল ব্যবহার করছেন তারা। এতে চাহিদা বেড়েছে কয়েলের। এ সুযোগে রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে বিক্রি হচ্ছে নিম্নমানের মশার কয়েল। বাজার ঘুরে জানা যায়, নিম্নমানের এসব কয়েল ‘পাঁচ-দশের কয়েল’ এবং ‘বাংলা কয়েল’ নামেও পরিচিত। এসব কয়েলে উচ্চমাত্রার রাসায়নিক ব্যবহারের কারণে দ্রুত মশা তাড়ায়, দামেও সস্তা। ফলে চাহিদার বাজারে এসব নন-ব্র্যান্ডের কয়েলের চাহিদাই এখন বেশি। তবে নিম্নমানের এসব কয়েল জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর বলে সতর্ক করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বিশিষ্ট কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার মশাবাহিত বিভিন্ন রোগ নিয়ে গবেষণা করছেন দীর্ঘদিন। গবেষণার অংশ হিসেবে তিনি ২০০২ সাল থেকে মশা ও কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণ এবং বিতরণ সামগ্রী পরীক্ষা করেছেন নিয়মিত। নিম্নমানের কয়েলের বিষয়ে জাগো নিউজকে ড. কবিরুল বাশার জানান, এ পর্যন্ত তিনি ৬০টির বেশি ব্র্যান্ড ও নন-ব্র্যান্ডের কয়েল পরীক্ষা করেছেন। তাতে তিনি মাত্র ৬-৭টি ব্র্যান্ডের কয়েল পেয়েছেন, যেগুলো যথার্থ কার্যকর ও সঠিক মাত্রায় রাসায়নিকের ব্যবহার হয়েছে। নন-ব্র্যান্ডের কয়েলগুলোতে মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক পেয়েছেন তিনি।
‘মশা তাড়ায় এমন কয়েলের ব্র্যান্ডের সংখ্যা অনেক বেশি। কিন্তু সেগুলোতে নির্ধারিত মানের অতিরিক্ত মাত্রায় রাসায়নিক ব্যবহার হয়েছে। যেটা মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ হতে পারে।’
ইএআর/এএসএ/জিকেএস