আইনি জটিলতায় স্থবির ‘ইমোশোনাল ডোনার’ দিয়ে কিডনি প্রতিস্থাপন

আবদুল্লাহ আল মিরাজ
আবদুল্লাহ আল মিরাজ আবদুল্লাহ আল মিরাজ , নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৮:৫১ এএম, ৩১ জুলাই ২০২৩
প্রতীকী ছবি

ইংরেজিতে অনার্স পড়ুয়া নারায়ণগঞ্জের নিধী দেড় বছর ধরে কিডনি জটিলতায় ভুগছেন। ভর্তি আছেন জাতীয় কিডনি রোগ ও ইউরোলজি ইনস্টিটিউটে (নিকডু)। নিধীর বাবা বলেন, মেয়েকে নিয়ে হাসপাতালে দোড়ঝাঁপ করছি। চিকিৎসকরা বলেছেন, মেয়ের দুটো কিডনিই অকেজো। যেহেতু তার বয়স এখনো কম, কিডনি প্রতিস্থাপন করলে ভালো হবে। কিডনির জন্য আত্মীয় স্বজনদের দ্বারস্থ হচ্ছি, খোঁজ নিচ্ছি কিন্তু এখন পর্যন্ত কেউ আগ্রহ প্রকাশ করেনি। প্রচলিত আইনে অন্য মানুষ থেকেও তো কিডনি নেওয়া যাবে না। কিডনি পেলেও অপারেশন ও আনুষাঙ্গিকে অনেক টাকা খরচ। মেয়েকে সুস্থ করতে চেষ্টা করছি, জানি না কী হয়!

কিডনি স্থায়ীভাবে কাজ করতে পারছে না, তাদেরই কিডনি প্রতিস্থাপনের পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা। কিডনি প্রতিস্থাপনের আগ পর্যন্ত রোগীকে ডায়ালাইসিস করাতে হয়। তবে এসব রোগীর ক্ষেত্রে ডায়ালসিস থেকে কিডনি প্রতিস্থাপন উত্তম। তবে যাদের কিডনি দাতা থাকে না এবং আর্থিক সামর্থ্য নেই তারা ডায়ালসিস চালিয়ে যান।

দেশে কিডনি প্রতিস্থাপন আলোর মুখ দেখেছে। দেশে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে এখন কিডনি প্রতিস্থাপন করা হচ্ছে। জাতীয় কিডনি রোগ ও ইউরোলজি ইনস্টিটিউট (নিকডু), বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ), কিডনি ফাউন্ডেশন, সেন্টার ফর কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলোজি হাসপাতাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বারডেম, পপুলার হাসপাতাল, ইউনাইটেড হাসপাতাল, এভারকেয়ার হাসপাতালে কিডনি প্রতিস্থাপন করা যায়।

তবে বড় সমস্যা হচ্ছে কিডনি দাতা খুঁজে পাওয়া। বাংলাদেশের আইনে ২২ ধরনের আত্মীয় থেকে কিডনি নেওয়া যাবে। মানবদেহে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সংযোজন (সংশোধন) আইন, ২০১৮ অনুযায়ী জীবন রক্ষায় নিকটাত্মীয়ের কিডনি নেওয়া যাবে। নিকটাত্মীয় হচ্ছেন, মা, বাবা, ছেলে, মেয়ে, ভাই, বোন, স্বামী, স্ত্রী ও আপন চাচা, ফুফু, মামা, খালা, নানা, নানি, দাদা, দাদি, নাতি, নাতনি এবং আপন চাচাতো, মামাতো, ফুফাতো, খালাতো ভাই বা বোন। তবে এসব নিকটত্মায়ীর বাইরে কিডনি গ্রহণের সুযোগ নেই।

এতে কিডনি প্রয়োজন এমন রোগী ও তাদের স্বজনরা পড়েছেন বিপাকে। অনেকে চিকিৎসার জন্য দ্বারস্থ হচ্ছেন বিদেশে। আর অনেকে আইনকে ফাঁকি দিয়ে দালালের মাধ্যমে আর্থিক লেনদেন করে নিচ্ছেন কিডনি।

সম্প্রতি দেশের নতুন প্রতিষ্ঠিত বিএসএমএমইউ সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালে কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়। পরবর্তীতে জানা যায়, ভাই পরিচয়ে কিডনি দান করা হলেও দালালের মাধ্যমে টাকার বিনিময়ে ও বিদেশে নেওয়ার আশ্বাসে কিডনি দিয়েছেন দাতা।

আরও পড়ুন> বিএসএমএমইউ সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালে কিডনি প্রতিস্থাপন শুরু

দেশে এখনো সক্রিয় কিডনির দালাল চক্র। কিডনি ফাউন্ডেশনে গেলে বাথরুমের দেওয়ালে কিডনি দিতে চাই উল্লেখ করে নাম ও নাম্বারসহ দালাল চক্রের সদস্যদের লেখা চোখে পড়বে। অনেক সময় বিপাকে পড়ে এসব নাম্বারে কলও দেন রোগীর স্বজনরা। পড়েন বিপদে।

কিডনি ফাউন্ডেশনে চিকিৎসা নিতে আসা এক রোগীর স্বজন আজাদুল জানান, আমাদের রোগীর দুইটি কিডনিতেই সমস্যা। আত্মীয়দের মাঝে খুঁজেছি, ব্যবস্থা হয়নি। পরে এখানে বাথরুমে থাকা এক নাম্বারে কল দেই। কিডনি দেওয়ার আশ্বাসে অগ্রিম হিসেবে ৫০ হাজার টাকা দেই। পরে টাকা নিয়ে ওই লোক গায়েব।

হাসপাতালের টয়লেটে এভাবে কিডনি দানের বিজ্ঞাপন সম্পর্কে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক চিকিৎসক জানান, কিছু লোক থাকে তারা সাধারণ মানুষের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে টাকা হাতিয়ে নেয়। হাসপাতালের এসব লেখা কিছুদিন পর পর মুছে দেওয়া হয়।

সম্প্রতি দেশে কিডনির দালাল চক্রের ৫ সদস্যকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। বিত্তশালী রোগীদের টার্গেট করে তাদের কিডনির ব্যবস্থা করে দিতো তারা চড়া মূল্যে। তবে মূল কিডনি দাতা সামান্য অর্থ পেলেও দালাল চক্রটি আর্থিক লেনদেনের বড় একটি অংশ হাতিয়ে নিতো। এ বিষয়ে র‌্যাব-১ অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোস্তাক আহমেদ বলেন, প্রতারণার মাধ্যমে মানবদেহের কিডনিসহ নানাবিধ অঙ্গের অবৈধভাবে প্রতিস্থাপনের সঙ্গে সক্রিয় রয়েছে কয়েকটি চক্র। এসব চক্রের ফাঁদে পড়ে সর্বহারা হচ্ছে অসহায় নিম্ন আয়ের মানুষ।

আরও পড়ুন> অর্থাভাবে ডায়ালাইসিস নিতে পারেন না ৮০ শতাংশের বেশি কিডনি রোগী

এসব সমস্যার কারণে দীর্ঘদিন ধরে কিডনি দানে আইন শিথিল করার আবেদন জানিয়ে আসছেন রোগী ও তাদের স্বজন এবং চিকিৎসকরা। এতে করে অনেক সেচ্ছাসেবী থেকে কিডনি পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হবে।

জাতীয় কিডনি রোগ ও ইউরোলজি ইনস্টিটিউটে সরেজমিনে দেখা যায়, হাসপাতালে বর্তমানে কিডনি প্রতিস্থাপনের অপেক্ষায় রয়েছে এমন রোগী ৩ জন। হাসপাতালের দুই তলায় কেবিন ও ওয়ার্ডে এসব রোগী ভর্তি আছেন। তবে এখানে কোনো ধরনের কিডনি বিক্রির বিজ্ঞাপন চোখে পড়েনি।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ও রেনাল ট্রান্সপ্লান্ট ডিভিশনের প্রধান অধ্যাপক ডা. হাবিবুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, আত্মীয় স্বজনের বাইরে কাছের মানুষ, বন্ধু ও ইমোশনাল ডোনাররা কিডনি দিতে আগ্রহী হয়ে থাকেন কোনো লেনদেন ছাড়া। তবে আইনের জটিলতায় এটি সম্ভব হচ্ছে না। মানুষজন দেশের বাইরে যাচ্ছে। দেশের টাকা বাইরে যাচ্ছে। অন্যদিকে, দালালদের দৌরাত্ম্যও কমে না। তাই আইনে ‘ইমোশনাল ডোনার’ বিষয়টিকে সংযুক্ত করা প্রয়োজন।

আরও পড়ুন> দেশে প্রথমবার ব্রেইন ডেথ মানুষ থেকে কিডনি প্রতিস্থাপন

তিনি আরও জানান, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা জাফরুল্লাহ চৌধুরী ২০১৯ সালে আদালতে একটি রিট করেন। তখন হাইকোর্টের আদেশে বলা হয়, ইমোশনাল ডোনাররা কিডনি দিতে পারবেন। আমরা সেই কাগজপত্রগুলো আবারও বের করেছি। আমাদের ট্রান্সপ্লান্ট কমিটির মাধ্যমে অ্যাটর্নি জেনারেলের কাছে এই আদেশের ব্যাপারে কথা বলবো। আমরা কী এখন থেকেই ইমোশনাল ডোনার থেকে কিডনি নিয়ে ট্রান্সপ্লান্ট করতে পারবো নাকি সংসদে পাস হয়ে আসতে হবে। সেই অনুযায়ী আমরা ব্যবস্থা নেবো।

এএএম/এসএনআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।