‘মহামারি ঘোষণা করতে নীতিনির্ধারকদের মধ্যে অজানা ভয় আছে’
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ও সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মোশতাক হোসেন বলেছেন, মহামারি ঘোষণা করার ক্ষেত্রে আমাদের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে অজানা ভয় আছে, স্পর্শকাতরতা আছে। এগুলো পরিবর্তনের জন্য আমাদের সময় লাগবে। কাজেই ডেঙ্গু মহামারি হয়েছে কি না- এটার জন্য আমাদের নীতিনির্ধারকদের বিব্রত করার কোনো প্রয়োজন নেই। এটা রোগতাত্ত্বিকদের বিশ্লেষণের বিষয়। কোভিড কি আমাদের দেশের সরকার গেজেট দিয়ে বলেছে আমরা মহামারিতে ঢুকেছি। পারেনি। এটা আমাদের রোগতাত্ত্বিকরা বলেছেন আমরা মহামারিতে ঢুকেছি। কাজেই এটা নিয়ে বিতর্ক করার কোনো দরকার নেই।
বুধবার (২৬ জুলাই) অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগো নিউজ কার্যালয়ে এক গোলটেবিল বৈঠকে এমন অভিমত দেন তিনি। ‘ডেঙ্গুর প্রকোপ: সচেতনতায় করণীয়’ শীর্ষক এই গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে জাগো নিউজ।
ডা. মোশতাক হোসেন বলেন, ডেঙ্গু একটি মহামারি। মহামারি বললে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় পড়ে আছে- এ রকম একটা চিত্র মনে হবে বলে আমাদের যারা কর্তৃপক্ষ তারা এটা খুবই সেনসেটিভ মনে করে। তাই এটা বলতেই চান না। আমাদের গণমাধ্যমকর্মীরা অনেক সময় কর্তৃপক্ষকে প্রশ্ন করেন এটাকে মহামারি হিসেবে ঘোষণা করবেন কবে। জরুরি জনসাস্থ্যের বাংলাদেশে ঘোষণা করার কোনো ইতিহাস নেই এবং এর প্রয়োজন খুব একটা আছে বলে মনে করি না। যদি তরুণ জনগোষ্ঠীর ডায়াবেটিস হয় তবে সেটি তরুণ জনগোষ্ঠীর ডায়াবেটিস মহামারি। কারণ রোগতত্ত্বের ভাষায় সময়, স্থান ও ব্যক্তি এই তিন প্রেক্ষিতে ব্যাপক এলাকাজুড়ে যদি ধারাবাহিকভাবে অস্বাভাবিক অসুস্থতা হয় তখন এটাকে মহামারি বলা যায়। ২০২১ সালে আমাদের এখানে ডায়রিয়ার মহামারি হয়েছে বললে আমাকে মারতে আসবে কারণ বলবে কত লোক মারা গেছে। অথচ অসময়েই ডায়রিয়াটা হয়েছিল, কলেরাও ছিল।
আরও পড়ুন: আগামী দুই মাস ডেঙ্গুর জন্য বেশ শঙ্কার: কবিরুল বাশার
তিনি বলেন, জরুরি জনস্বাস্থ্যের বিষয়টি অন্য একটি কথা। বাংলাদেশের রাজনৈতিক কারণ ছাড়া কখনোই জরুরি অবস্থা ঘোষণা হয়নি। এই ঐতিহ্য নেই বাংলাদেশে। স্বাস্থ্যের জরুরি অবস্থা ঘোষণা অনেকবার হয়েছে। উত্তরবঙ্গে যখন নিপা ভাইরাস হয় তখন সেটা অঞ্চলভিত্তিক জরুরি জনস্বাস্থ্য। ২০২১ সালের ডায়রিয়া ছিল জাতীয়ভিত্তিক জরুরি জনস্বাস্থ্য। ডেঙ্গুটাও এখন তা-ই। এটা ঘোষণা করার বাংলাদেশে ঐতিহ্যবাহী নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ঘোষণা করতে হয় কারণ যদি থোক বরাদ্দ দিতে হয় মার্কিন প্রেসিডেন্ট জরুরি অবস্থা ঘোষণা না করলে সে বরাদ্দ দিতে পারে না। বাংলাদেশে কি এমন কোনো বাধা আছে? আমাদের প্রধানমন্ত্রী যদি এখন মনে করেন ডেঙ্গুর জন্য থোক বরাদ্দ দেওয়া দরকার তিনি করতে পারেন। মন্ত্রিপরিষদে অনুমোদন নিয়ে করেন সেটার জন্য তার বরাদ্দ ঠেকে থাকে না।
‘স্বাস্থ্যের জরুরি অবস্থা আমাদের অনেকবারই হয়েছে কিন্তু জরুরি ভিত্তিতে কাজ হয়। আজ সব হাসপাতালে ডেঙ্গু ওয়ার্ড খোলা হয়েছে, অতিরিক্ত ডাক্তার দেওয়া হয়েছে। এতে আমাদের দেশের আইনি কোনো বাধা নেই।’
আইইডিসিআরের উপদেষ্টা বলেন, আমরা জরুরি জনস্বাস্থ্য পরিস্থিতি কেন বলছি, আমরা এখনো প্রথাগতভাবেই চিন্তা করছি। মশা মারার দায়িত্ব না, রোগী কেন ডেঙ্গুর কারণে মারা যাচ্ছে- এ ধরনের কথা যারা দায়িত্বে আছে তারা শুনতে রাজি না। তাই আমরা এমন এক লোক চাই সরকারের দায়িত্বে যিনি বলবেন মশা মারা ও রোগীর মৃত্যু কমানোর দায়িত্ব নিলাম। খণ্ড খণ্ড কথা বলে জনগণকে অসহায় অবস্থায় ফেলে নিজেকে বুঝ দিলাম অনেক কিছু করে ফেলেছি তার জন্য জরুরি জনস্বাস্থ্য বুঝতে হবে। জরুরি জনস্বাস্থ্য বিষয়ে এমন একজন দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ থাকবে যিনি সবকিছুর দায়িত্ব নেবেন, সমন্বয় করবেন।
আরও পড়ুন: ‘রেজিট্যান্স ম্যাকানিজম বেড়ে মশা শক্তিশালী হয়ে উঠছে’
সমন্বয় করে কাজ করা উচিত জানিয়ে তিনি বলেন, আমাদের আন্তঃমন্ত্রণালয় টাস্কফোর্সের একটি নির্দেশনা আছে। স্থানীয় সরকার বিভাগ ২০২১ সালে করেছে কিন্তু তারা উল্লেখ করে না। ডেঙ্গুতে ভয় পায় না এমন কোনো লোক নেই। অনেকগুলো কাজ ব্যক্তিগতভাবে করা যায় আবার অনেকগুলো ব্যক্তিগতভাবে করা যায় না। আপনার ফ্ল্যাটের পরিচ্ছন্নতা করতে গেলে সিটি করপোরেশনের অভিজ্ঞ কর্মী, ফ্ল্যাট মালিক সমিতির স্বেচ্ছাসেবক ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধির সমন্বয় লাগবে। সমন্বিত একটা চেষ্টা না থাকলে শুধু প্রচার করলেন তাতে হবে না। প্রচার যথেষ্ট হয়েছে এটা অব্যাহত থাকুক।
সিটি করপোরেশনের কাজের সমালোচনা করে আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ডা. মোশতাক হোসেন বলেন, সিটি করপোরেশনের সম্পদ নেই। সিটি করপোরেশনে যেই কোটি কোটি এই কোটি কোটি টাকার হিসাব দেন। প্রয়োজনের তুলনায় কিচ্ছু নেই। পুরো শহরে মশক নিয়ন্ত্রণে ঢাকায় প্রতি ওয়ার্ডে ১১ জন শ্রমিক কাজ করছেন। অথচ ঢাকা শহরের একটি ওয়ার্ডে লাখের বেশি লোক থাকে। এখানে স্থানীয় সরকার বিভাগে যেই নির্দেশিকা তাতে বলা আছে, প্রয়োজনে ১০টি বা তার বেশি ভাগ করে গলি-মহল্লাসহ ডেঙ্গু প্রতিরোধ কমিটি করতে হবে। সেখানে ১১ জন কর্মী নয়, সঙ্গে অসংখ্য স্বেচ্ছাসেবী লাগবে। সেই স্বেচ্ছাসেবীদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে।
আরও পড়ুন: শহর ছাড়িয়ে ঝুঁকি বাড়ছে প্রত্যন্ত অঞ্চলেও
মশকনিধনে সিটি করপোরেশনের জরিমানার সমালোচনা করে তিনি বলেন, জরিমানা করে জনস্বাস্থ্যের সমস্যার সমাধান হবে না। জনগণকে আপনারা দূরে সরিয়ে দিচ্ছেন। সিটি করপোরেশনের কর্মীরা এলে জনগণ দরজাই খুলবে না, ঢুকতে দেবে না। ঢুকলেই জরিমানা করবেন। একটি হটলাইন দিয়ে দিয়েছেন মশক আছে কি না জানানোর জন্য। কে ফোন দিয়ে জরিমানা ডেকে নিয়ে আসবে। এসে লার্ভা পাবেন আর জরিমানা করবেন। সাধারণ বিষয়ে জরিমানা হতে পারে কিন্তু জনস্বাস্থ্যের বিষয়ে জরিমানা দিয়ে জনগণকে দূরে সরিয়ে দিয়েন না। কমিউনিটি সম্পৃক্ততার যেই কাঠামো স্থানীয় সরকার বিভাগের নির্দেশিকায় দেওয়া আছে সেটা অনুসরণ করুন।
তিনি বলেন, একটি ইনস্টিটিউট অবশ্যই দরকার। কারণ গবেষণা, রোগ নিয়ন্ত্রণ করাসহ পুরো বিষয়টা সমন্বয় করে একটি ড্রাফ করা দরকার। প্রতিটি বিষয়েই আমাদের সার্ভে করা দরকার। কারণ মশা নিধনের জন্য যেই কীটনাশক আনা হয় সেটা প্রতিদিনই পরীক্ষা করা উচিত। কারণ ঢাকায় যেটা কাজে লাগছে না সেটা নরসিংদীতে কাজে লাগতে পারে। আবার ভোলায় যেটা কাজে লাগছে না সেটা ঢাকায় কাজে লাগতে পারে। এভাবে যখন একটা মাত্র জায়গায় একটা ড্যাশবোর্ডে থাকে তাহলে যারা গবেষক, যারা কাজ করছেন এবং গণমাধ্যমকর্মী তারা দেখতে পারবে মশার অবস্থা, ডেঙ্গু রোগীর অবস্থা জানতে পারবে।
জাগো নিউজের প্ল্যানিং এডিটর মনিরুজ্জামান উজ্জ্বলের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক কে এম জিয়াউল হক। গোলটেবিল বৈঠকে আরও বক্তব্য রাখেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের একুশে পদকপ্রাপ্ত ইমেরিটাস অধ্যাপক ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ, স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের সভাপতি ডা. জামাল উদ্দিন চৌধুরী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সম্পাদক স্থপতি ইকবাল হাবিব, পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) সভাপতি আবু নাছের খান, বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির উপ-পরিচালক (কমিউনিকেশন ডিপার্টমেন্ট) মাহমুদুল হাসান ও জাগো নিউজের ডেপুটি এডিটর ড. হারুন রশীদ।
এসময় আরও উপস্থিত ছিলেন জাগো নিউজের অতিরিক্ত বার্তা সম্পাদক আসিফ আজিজ, প্রধান প্রতিবেদক মাসুদ রানা, উপ-প্রধান প্রতিবেদক সাঈদ শিপন প্রমুখ।
আরএসএম/বিএ/এএসএম