আগামী দুই মাস ডেঙ্গুর জন্য বেশ শঙ্কার: কবিরুল বাশার

নিজস্ব প্রতিবেদক
নিজস্ব প্রতিবেদক নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ১০:০৪ এএম, ২৭ জুলাই ২০২৩

চলতি বছরের মে মাসে যখন বৃষ্টি শুরু হলো তখন এডিস মশার ঘনত্ব বাড়তে শুরু করে। এরপর জুন, জুলাইয়ে গিয়ে ব্যাপক ডেঙ্গু রোগী পাওয়া যায়। জ্যামিতিক হারে এডিস মশা বেড়ে গেছে। এখান জুলাইয়ের শেষ। আগামী দু মাস (আগস্ট ও সেপ্টেম্বর) আমাদের জন্য বেশ শঙ্কার। এবার মৃত্যুতে এবং ডেঙ্গু আক্রান্তের হার বাংলাদেশের ইতিহাস ছাড়িয়ে যাবে।

বুধবার (২৬ জুলাই) অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগো নিউজ কার্যালয়ে এক গোলটেবিল বৈঠকে এমন অভিমত দিয়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার। ডেঙ্গুর প্রকোপ: সচেতনতায় করণীয় শীর্ষক এ গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে জাগো নিউজ।

বাংলাদেশে ২০০০ সাল থেকে ডেঙ্গু শুরু হয়েছে জানিয়ে কবিরুল বাশার বলেন, প্রতি বছর ডেঙ্গু জ্বরের মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন। এবার লক্ষ্য করছি সবচেয়ে খারাপ অবস্থা। এর পেছনে কারণ কী। আমরা যদি একটু পেছনে লক্ষ্য করি তাহলে দেখবো, ফিল্ড লেভেলে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে যত ডেঙ্গু হয়েছে, দেখবেন আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে। ২১ সাল পর্যন্ত এ দুটি মাসের একটি মাসে ডেঙ্গু পিক ছিল। ২০২১ সালে দেখেছি অক্টোবর মাস পর্যন্ত ডেঙ্গু ছিল। এরপর এবার দেখলাম নভেম্বর, ডিসেম্বর পার হয়ে চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত ডেঙ্গু চলে আসছে। এ জানুয়ারিতেও ৫০০ মতো ডেঙ্গু রোগী ছিল। এটা বাংলাদেশের ইতিহাসে ছিল না।

তবে আরেকটি শঙ্কার কথা যেটা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পৃথিবীব্যাপী অনেক দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ ছড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশ তার বাইরে নয়। এ রোগ ভবিষ্যতে আরও বাড়বে। এটিকে মোকাবিলা করতে হবে এবং মোকাবিলা করার জন্য প্রস্তুতি থাকতে হবে। তিনি বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ডেঙ্গু আক্রান্তের যে হিসাব দেয়, সেটি পূর্ণ নয়। দেশের সব হাসপাতাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রিপোর্টিং করে না। ফলে পূর্ণাঙ্গ হিসাবটি আসে না।

কবিরুল বাশার বলেন, আগে ঢাকা শহরের ৪০ ভাগ এডিস মশা হতো নির্মাণাধীন ভবন থেকে। সিটি করপোরেশনের অভিযানে সেটি এখন ১৯ ভাগে নেমে এসেছে। কিন্তু এবার গবেষণায় আমরা ৪৩ ভাগ মশা পেয়েছি বহুতল মাল্টিপারপাস ভবনে। আমরা দেখেছি, মাল্টিপারপাস ভবনের যেখানে গাড়ি দোয়া হয়, সেখানে সিটি করপোরেশনের লোকজন ও বাসিন্দারা যায় না। ফলে সেখানে পানি জমে এডিসের লার্ভা জন্মাচ্ছে। এ ক্রিমিনালের (মশা) জন্য বৃষ্টি কোনো প্রয়োজন নেই। শীত, বর্ষা সবসময় গাড়ি দোয়ার জন্য পানি ব্যবহার হচ্ছে, আর এডিস মশা জন্মায়।

ওয়াসার পানির মিটার এডিস মশা প্রজননের আরেকটি উপযোগী জায়গা জানিয়েছে কবিরুল বাশার বলেন, ওয়াসার মিটার যেখানে লাগানো হয় সেটার জন্য একটি চৌবাচ্চা তৈরি করা হয়। সে জায়গায় সারা বছরই পানি জমে থাকে। আমরা গবেষণার সময় দেখেছি, ওয়াসার মিটারগুলোতে পানি জমে মশা জন্মাচ্ছে। বিষয়টি অনেকবার ওয়াসাকে জানিয়েছি। এছাড়া বাসা-বাড়িতে বালতি বা ড্রামে জমা রাখা পানিতে এডিসের লার্ভা পেয়েছি।

কবিরুল বাশার বলেন, সম্প্রতি ঢাকার যে ১১টি এলাকা এডিস মশার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বলা হয়েছে, তার মধ্যে মুগদা থেকে শুরু করে জুরাইন পর্যন্ত একটা বিরাট জোন আছে। আমি যখন জুরাইন এলাকায় গবেষণা করতে গেলাম তখন ওই এলাকাগুলোতে একটি অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে। সেটা হল, ওই এলাকার রাস্তাঘাটগুলো উঁচু হয়েছে। বাড়িগুলো নিচু হয়ে গেছে। বেশিরভাগ বাড়ির নিচ তলার ফ্ল্যাট পরিত্যক্ত। ভাড়াটিয়া নেই। সেখানে চুয়ে চুয়ে পানি জমছে। সেই পানিতে আমরা এডিসের মশা পাচ্ছি।

ঢাকা শহরে লাইট পলিউশনের কারণে এডিস মশা এখন দিনে হোক বা রাতে সব সময় কামড়ায় জানিয়েছে কবিরুল বাশার বলেন, লাইট পলিউশনের বিষয়টি আমরা তিন বছর ধরে গবেষণা করে প্রমাণ করেছি। এ পলিউশন নিয়ে পৃথিবীর কোথাও কথা হয় কি না জানি না। লাইট পলিউশন কিন্তু একটা বিশাল বড় পলিউশন। এ কারণে এডিস মশা তার আচরণে পরিবর্তন করেছে। আর এত দিন আমরা জানতাম এডিস মশা স্বচ্ছ পানিতে জন্মায়, নোংরা পানিতে নয়। অথচ এখন আমরা দেখলাম এডিস স্বচ্ছ পানিতে জন্মাচ্ছে। অর্থাৎ এডিস মশা আচরণে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। এ পরিবর্তনকে টার্গেট করে আমাদের এডিস মশার নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ নিতে হবে। মশক নিধন কার্যক্রম আরও জোরদার করতে হবে।

তিনি বলেন, মশা জন্মানোর ওই তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে যারা মশার নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে আছেন তারা টার্গেট করে মশার নিধন করতে হবে। এডিস মশা যেখানে হয় সেখানে টার্গেট করে আমাদের তা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা করতে হবে। যেখানে হয়তো আমরা পারছি না, কেন পারছি না সেটা বের করতে হবে।

দেশে যখন ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়ে যায় তখন কেন এসব নিয়ে আলোচনা হয় না, এমন প্রশ্ন রাখেন কবিরুল বাশার। তিনি বলেন, যখন ক্রাইসিসটা থাকে না সেই মুহূর্তেতো আমাদের মাথা ঠান্ডা থাকে। তখন আমরা দেশের মানুষের রক্ষা করার জন্য একটি জাতীয় পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে। জাতীয় পরিকল্পনা মাধ্যমে আগামী দিনগুলোতে বাংলাদেশে এডিস রোগ নিয়ন্ত্রণে কী কী করা যায় সেটি আলোচনা করে, বিশ্লেষণ করে সব স্টেকহোল্ডারকে সঙ্গে নিয়ে একটি জাতীয় পরিকল্পনা করতে হবে। প্রয়োজন হলে ইনস্টিটিউট অফ ভেক্টর কন্ট্রোল নামে একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান তৈরি করতে হবে।

এতদিন আমরা মশার জন্য ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনকে চেপে ধরেছি। কিন্তু এখন আমরা দেখছি সারাদেশ মশা ছড়িয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের উপ-শহর, উপজেলাতে ডেঙ্গু ছড়িয়ে গেছে। কেউ জানে না কেন উপজেলাতে ডেঙ্গু হচ্ছে। সে গবেষণাটা কে করবে, সে গবেষণার ফাইন্ডিং কে দেবে সেটি রাষ্ট্রকে ভাবতে হবে। এটা ভাবলে আমাদের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাটাকে আরও জোরদার করবে বলে জানান কবিরুল বাশার। তিনি বলেন, যখন থেমে থেমে বৃষ্টি হয়, তখন এডিস মশার ঘনত্ব বাড়ে। ভারী বর্ষণ হলে হলে এডিস মশার ডেনসিটি কমবে। এখন থেমে থেমে বৃষ্টিটাই আমাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে।

জাগো নিউজের প্ল্যানিং এডিটর মনিরুজ্জামান উজ্জ্বলের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক কে এম জিয়াউল হক। গোলটেবিল বৈঠকে আরও বক্তব্য রাখেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের একুশে পদকপ্রাপ্ত ইমেরিটাস অধ্যাপক ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ, সরকারি সংস্থা আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ডা. মোশতাক হোসেন, স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের সভাপতি ডা. জামাল উদ্দিন চৌধুরী, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সম্পাদক স্থপতি ইকবাল হাবিব, পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) সভাপতি আবু নাছের খান, বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির উপ-পরিচালক (কমিউনিকেশন ডিপার্টমেন্ট) মাহমুদুল হাসান ও জাগো নিউজের ডেপুটি এডিটর ড. হারুন রশীদ।

এসময় আরও উপস্থিত ছিলেন জাগো নিউজের অতিরিক্ত বার্তা সম্পাদক আসিফ আজিজ, প্রধান প্রতিবেদক মাসুদ রানা, উপ-প্রধান প্রতিবেদক সাঈদ শিপন প্রমুখ।

এমএমএ/এমআইএইচএস/এএসএম

টাইমলাইন  

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।