পকেট খসছে ক্রেতার

ডেঙ্গুর বাড়বাড়ন্তে কয়েল-ক্রিম-স্প্রে ব্যবসায়ীদের পোয়াবারো

তৌহিদুজ্জামান তন্ময়
তৌহিদুজ্জামান তন্ময় তৌহিদুজ্জামান তন্ময় , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৯:৪৯ পিএম, ২৬ জুলাই ২০২৩
একটি সুপারশপে মশাপ্রতিরোধী বিভিন্ন স্প্রে/জাগো নিউজ

ভয়াবহরূপে লাফিয়ে বাড়ছে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা। আক্রান্ত-মৃত্যুতে প্রায় প্রতিদিনই ছাড়াচ্ছে রেকর্ড। এডিস মশাবাহিত রোগটির দাপট এখন দেশজুড়ে। ডেঙ্গুর কারণে চলতি মাসে রাজধানীবাসীর রোজকার জীবনধারাই যেন পাল্টে গেছে। বেড়েছে খরচ। মশা থেকে বাঁচতে এই দুর্মূল্যের বাজারে রাখতে হচ্ছে বাড়তি বাজেট। সুযোগ বুঝে অসৎ ব্যবসায়ীরাও মশানিরোধক সব পণ্যের দাম বাড়িয়েছেন কয়েক গুণ।

মশা থেকে বাঁচতে মশারি, কয়েল, অ্যারোসল, স্প্রে, লোশন, ক্রিম ও র্যাকেটের মতো মশাপ্রতিরোধী পণ্য কিনতে মানুষ ভিড় করছেন ফার্মেসি, সুপারশপ ও জেনারেল স্টোরগুলোতে। অনেক দোকান ঘুরেও মিলছে না মশা নিরোধক এসব পণ্য। এমন পরিস্থিতিতে ব্যবসায়ীরা এসব পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন বলে অভিযোগ ক্রেতাদের।

ডেঙ্গুতে আক্রান্তদের বড় একটি অংশ শিশু। ডেঙ্গু ভয়াবহ আকারে ছড়িয়ে পড়ার কারণে শিশুদের নিয়ে দুশ্চিন্তা বাড়ছে পরিবারের সদস্যদের। স্কুলপড়ুয়া শিশুরা দিনের একটা বড় সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অবস্থান করছে। ফলে ডেঙ্গু থেকে তাদের সুরক্ষায় অতিপ্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে মশা প্রতিরোধক এসব পণ্য।

আরও পড়ুন>> জ্বর হওয়ার কতদিনের মধ্যে কোন টেস্ট করলে ডেঙ্গু ধরা পড়ে?

মাসিক বাজারের তালিকায় চাল-ডাল ও নিত্যপণ্যের আগে যোগ করতে হচ্ছে কয়েল, ব্যাট, অ্যারোসল, লোশন, ক্রিমসহ মশাপ্রতিরোধী নানা জিনিসের নাম। ঘরে যেন একটাও মশা না ঢোকে এ ভাবনা থেকে অনেকে পুরো বাসা নেট দিয়ে ঘিরে ফেলেছেন। আর এসব জিনিস জোগাড় করতে পকেট থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে বাড়তি টাকা।

আগে যেখানে একটি পরিবার মশা মারতে অ্যারোসলের একটি ক্যানেই মোটামুটি মাস চালিয়ে নিতে পারতেন, এখন সেখানে তিনবেলাই অ্যারোসল স্প্রে করতে হচ্ছে। একটির জায়গায় অ্যারোসলের ক্যান লাগছে তিন-চারটি, ক্ষেত্রবিশেষে আরও বেশি।

রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে এ চিত্র পাওয়া যায়। মশার উপদ্রব থেকে বাঁচতে অনেকেই বাসার বেসিনে ন্যাপথলিন রেখে দিচ্ছেন। ভালো মানের এক প্যাকেট ন্যাপথলিনের দাম রাখা হচ্ছে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা পর্যন্ত। মশারিভেদে দাম বেড়েছে দুইশ টাকা পর্যন্ত। ওডোমসসহ এজাতীয় পণ্যের দাম সংকট থাকায় নেওয়া হচ্ছে ইচ্ছামতো।

রাজধানীর মিরপুরের রাজধানী বেডিংয়ের বিক্রেতা নোমান আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, গত এক মাসে মশারী বিক্রি অনেক বেড়েছে। মশারী কিনতে আসা বেশিরভাগই ডেঙ্গু আতঙ্কে মশারী কিনছে। কয়েকমাস আগেও নরমাল মশারীর দাম ছিল ৩০০ থেকে ৫০০ টাকার মধ্যে সেগুলো এখন ৭০০-৮০০ টাকা। ভালো মানের মশারী আগে ছিল এক হাজার থেকে বারোশ টাকার মধ্যে, সেগুলো এখন দেড় থেকে আঠারোশ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে।

শ্যামলীতে মা বেডিং অ্যান্ড পর্দা স্টোরে মশারি কিনতে এসেছেন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থী ইমন ইকবাল। কয়েকটি মশারির দাম জিজ্ঞেস করে দোকানির সঙ্গে দামাদামি করছেন তিনি। ৫০০ টাকার একটি মশারি পছন্দ হয়েছে তার, কিন্তু দুই মাস আগেও সেটি ২০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। ইমন ৩০০ থেকে সাড়ে তিনশ পর্যন্ত দাম বলেছেন, কিন্তু দোকানি ৫০০ টাকার নিচে নামছেন না। পরে অবশ্য অনেকটা বাধ্য হয়েই ৫০০ টাকায় মশারি কেনেন শিক্ষার্থী ইমন ইকবাল।

রাজধানীর শিয়া মোহাম্মদপুরের লিড ফার্মায় গিয়ে দেখা যায়, তাদের ফার্মেসিতে ৫০ গ্রামের ওডোমস রয়েছে মাত্র দুটি। দাম চাওয়া হচ্ছে আড়াইশ টাকা। এত দাম কেন জানতে চাইলে বিক্রেতা সজীব জানান, বেশ কিছুদিন ধরে ওডোমস ক্রিমের সাপ্লাই নেই। এজন্য সবাই দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। দাম বাড়িয়ে দিয়েও ওডোমস পাওয়া যাচ্ছে না।

ডেঙ্গুর বাড়বাড়ন্তে কয়েল-ক্রিম-স্প্রে ব্যবসায়ীদের পোয়াবারো

এদিকে রাজধানীর কয়েকটি ফার্মেসিতে ড. রাজেশ মসকিউটো রেপেলেন্ট ফেব্রিক রোল খুঁজেও পাওয়া যায়নি। পরিবর্তে বেশিরভাগ ফার্মেসিতে বিক্রি হচ্ছে এক্সেল মসকিউটো স্প্রে। এই স্প্রের দাম ১১০ টাকা।

আরও পড়ুন>> ডেঙ্গু মোকাবিলায় ব্যর্থ হলে দেশে রোগী হতো ২০-৩০ লাখ: তাজুল

সোহরাব হোসেন। ছয় সদস্যের পরিবারের জন্য মশার হাত থেকে রক্ষা পেতে মাসে প্রায় তিন হাজার টাকার বেশি খরচ হচ্ছে বলে জানান। সোহরাব জাগো নিউজকে বলেন, পরিবারে ছয়জন সদস্য। তাদের মধ্যে নিজের একবার, দুই সন্তানের একজনের দুবার ডেঙ্গু হয়েছে। ছেলেকে শিশু হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা নিতে হয়েছিল। এবার নিজের ঘর পরিষ্কার রাখা ছাড়াও ওডোমস ক্রিম, অ্যারোসল ও রিচার্জেবল ব্যাট কিনেছি আড়াই হাজার টাকায়। ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে যাওয়ার চেয়ে এক মাসে দুই-তিন হাজার টাকার এসব উপকরণ কিনে যতটা সম্ভব সুরক্ষায় থাকা নিরাপদ।

রাজধানীর আদাবরের বাসিন্দা ইয়াসমিন লাবনী বাসার সব ঘরে একটি করে অ্যারোসলের ক্যান রেখেছেন। সকালে বাসার সবাই যে যার কাজে বের হলে সব ঘরের আনাচে-কানাচে ছিটাচ্ছেন অ্যারোসল।

ওই গৃহিণী জাগো নিউজকে বলেন, আগে তো বাসায় রাখতে হয় বলে একটা অ্যারোসল রাখতাম। আরশোলা আর পোকা-মাকড় মারার জন্য। এখনতো প্রতি মাসে আমাকে ছয়-সাতটা করে অ্যারোসল কিনতে হচ্ছে।

কাছাকাছি এলাকা শ্যামলীর নিজের ফ্ল্যাটে পরিবার নিয়ে থাকেন আহসান কবির। তিনি বাসার মূল দরজায় লাগিয়ে নিয়েছেন নেট। দুই বারান্দা আর সবগুলো জানালায়ও একই অবস্থা- রীতিমতো কারাজীবন। এসব করতেই তার প্রায় ৩০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। এতেই ক্ষান্ত হননি তিনি। প্রতিদিন সকালে বাসায় মশা মারার অ্যারোসলও স্প্রে করা হচ্ছে।

আরও পড়ুন>> ডেঙ্গুতে একদিনে রেকর্ড ১৯ জনের মৃত্যু

অভিজাত এলাকা গুলশানের বাসিন্দা মায়শা আফরিন সারাক্ষণই চিন্তায় থাকেন তার সাড়ে তিন বছর বয়সী ছেলে আনাসকে নিয়ে। সার্বক্ষণিক ছেলের জামায় মসকিউটো প্যাচ লাগিয়ে রাখছেন। আর বাইরে বের হওয়ার আগে সন্তানের শরীরে লাগাচ্ছেন মশা প্রতিরোধক ক্রিম ওডোমস। এক ধরনের স্টিকার মসকিউটো প্যাচ কাপড়ে লাগিয়ে দিলে সাধারণত মশা কাছে ঘেঁষে না।

ডেঙ্গুর বাড়বাড়ন্তে কয়েল-ক্রিম-স্প্রে ব্যবসায়ীদের পোয়াবারো

তিনি জাগো নিউজকে জানান, মশা থেকে তার পরিবারকে সুরক্ষিত রাখতে মাসে সুপারশপ থেকে তাকে পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকার মশা নিরোধক পণ্য কিনতে হচ্ছে।

২০ হাজার টাকা বেতনের বেসরকারি চাকরিজীবী মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর জাগো নিউজকে বলেন, জিনিসপত্রের যে দাম তাতে এই বেতনে মাস চলা অনেক কঠিন। মাস শেষ না হতেই ধার-দেনা করা লাগে। এর মধ্যে ডেঙ্গুর হাত থেকে বাঁচতে এই মাসে এক হাজার টাকায় কয়েল, মশারি ও ক্রিম কিনেছি।

এদিকে রাজধানীর মোহাম্মদপুর, শ্যামলী, কলেজগেট, ফার্মগেট ও ধানমন্ডি এলাকার বেশ কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা যায়, স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় মশানিরোধক পণ্যের বিক্রি বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। অনলাইনেও দেখা গেছে, আগের তুলনায় ৫০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত বেশি দাম রাখা হচ্ছে মশা নিরোধক পণ্যের। অনেক পণ্য আবার মিলছেই না। সোল্ড আউট লেখা।

বিশেষ করে ভারতীয় ক্রিম ওডোমস ও ড. রাজেশ মসকিউটো রেপেলেন্ট ফেব্রিক রোলের চাহিদা বেড়ে গেলেও ক্রেতারা পাচ্ছেন না। ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাজারে এক প্রকার কৃত্রিম সংকট দেখা যাচ্ছে পণ্যগুলোর। কোথাও কোথাও পাওয়া গেলেও রাখা হচ্ছে বেশি দাম।

ক্রেতাদের অভিযোগ, চাহিদা বাড়ার সুযোগ নিয়ে খুচরা বিক্রেতারা মশারি, কয়েল, স্প্রে ও র্যাকেটের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন।

রাজধানীর রিং রোড এলাকার তানিশা ঔষধালয় ও ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে গিয়ে দেখা যায়, হঠাৎ ক্রেতার চাহিদার কারণে দোকানে নেই কোনো মশা নিরোধক ক্রিম বা লোশন। যারা কিনতে আসছেন তারা না পেয়ে অন্য দোকানে দেখছেন। দোকানে বিক্রেতা বলছেন, দু-একদিন আগে সব শেষ হয়েছে। অর্ডার করেছি কিন্তু এখনো দোকানে মাল আসেনি।

টিটি/এএসএ/জেআইএম

টাইমলাইন  

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।