অপ্রয়োজনীয়ভাবে প্লাটিলেট দেওয়া হচ্ছে ৯০ শতাংশ ডেঙ্গুরোগীর
দেশজুড়ে মহামারি আকার ধারণ করতে চলেছে ডেঙ্গু। এডিস মশাবাহিত এ রোগটি প্রতিদিন কাড়ছে প্রাণ। জুলাই মাসে হাসপাতালে ভর্তি ও মৃত্যুর সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। অধিকাংশ ডেঙ্গুরোগী আক্রান্ত হওয়ার পর থেকে দুশ্চিন্তায় থাকেন রক্তের প্লাটিলেট নিয়ে। যার সুযোগ নিচ্ছেন কিছু হাসপাতাল ও চিকিৎসক। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গাইডলাইন অনুসরণ না করেই অপ্রয়োজনীয়ভাবে দেওয়া হচ্ছে প্লাটিলেট। যাতে আক্রান্ত ব্যক্তি শারীরিক ও আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া গাইডলাইন অনুসারে, ডেঙ্গুরোগীর প্লাটিলেট ১০ হাজারের নিচে না নামলে প্লাটিলেট ব্যবহারের প্রয়োজন নেই। তবে ২০ হাজারের নিচে নামলে এবং এ সময়ে রোগীর রক্তক্ষরণ দেখা দিলে সেক্ষেত্রে প্লাটিলেট দেওয়া যেতে পারে। তবে এ নির্দেশনার তোয়াক্কা না করে কিছু চিকিৎসক অকারণেই প্লাটিলেট দিচ্ছেন। ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রেই অযাচিতভাবে দেওয়া হচ্ছে প্লাটিলেট।
আরও পড়ুন>> ডেঙ্গু আক্রান্ত সব রোগীকে হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন নেই
বিশেষজ্ঞদের মতে, অকারণে প্লাটিলেট গ্রহণে ভবিষ্যতে রোগীর শরীরে অজানা ভাইরাস বাসা বাঁধতে পারে। উদ্বেগজনক পরিস্থিতি এড়াতে চিকিৎসক ও রোগী উভয়কে সচেতন হওয়ার পাশাপাশি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তদারকি জরুরি বলে মনে করছেন তারা।
অকারণে প্লাটিলেট দেওয়ার ফলে রোগীর শরীর প্লাটিলেট উৎপাদন বন্ধ করে দেয়। এতে যে রোগীর চার-পাঁচ দিনে হাসপাতাল ছাড়ার কথা তিনি সাত-আট দিনে হাসপাতাল ছাড়ছেন। এই পুরো ব্যাপারটাই বেসরকারি হাসপাতালের লাভ।
রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন ডেঙ্গুরোগী সিরাজুল ইসলাম। তার ভাই আজাদ কোয়ান্টাম ব্লাড ব্যাংকে এসেছেন প্লাটিলেট সংগ্রহ করতে। তিনি জানান, তার ভাই চারদিন ধরে হাসপাতালে ভর্তি। তবে তার প্লাটিলেট কাউন্ট কমছে। এখন ৩০ হাজারে আছে। চিকিৎসক বলেছেন প্লাটিলেট দিতে হবে তাই এসেছেন ডোনার নিয়ে।
প্লাটিলেট কখন নেওয়া উচিত?
শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের ব্লাড ট্রান্সফিউশন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. আশরাফুল হক জাগো নিউজকে বলেন, ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় প্লাটিলেট দেওয়া হচ্ছে। ডেঙ্গুরোগীর স্বজনরা প্লাটিলেট দেওয়ার জন্য চিকিৎসকদের চাপ দিচ্ছেন। চিকিৎসকরাও ঝুঁকি নিতে চাচ্ছেন না। চিকিৎসক চিন্তা করেন প্লাটিলেট ৪০ হাজার বা ৩০ হাজারে নেমে গেলে রোগীর স্বজনরা ভুল বুঝতে পারেন বা জটিলতা তৈরি হতে পারে। সেজন্য অনেক চিকিৎসক দেন। চিকিৎসক সিদ্ধান্তহীনতা ও নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন।
আরও পড়ুন>> ঢাকার যে ১১ এলাকা থেকে ডেঙ্গুরোগী বেশি আসছেন
‘আবার এখানে প্লাটিলেট দেওয়া নিয়ে যে দুষ্কৃতকারী নেই তাও বলা যায় না। দেখা যায় অনেকে প্লাটিলেট ব্যবসায় জড়িত। প্লাটিলেট যত বেশি দেওয়া হবে হাসপাতালের তত লাভ। এতে দেখা যায় যিনি প্লাটিলেট নিতে বলছেন তিনিও কিছুটা বেনিফিটেড হন। এ প্রেক্ষাপটেই প্লাটিলেটের সিদ্ধান্ত খুব দ্রুত চলে আসছে।’
তিনি বলেন, অকারণে প্লাটিলেট দেওয়ার ফলে রোগীর শরীর প্লাটিলেট উৎপাদন বন্ধ করে দেয়। এতে যে রোগীর চার-পাঁচ দিনে হাসপাতাল ছাড়ার কথা তিনি সাত-আট দিনে হাসপাতাল ছাড়ছেন। এই পুরো ব্যাপারটাই বেসরকারি হাসপাতালের লাভ, যা সব হাসপাতালে না হলেও অনেক হাসপাতালই এদিকে ঝুঁকেছে। যা বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে বড় সমস্যা হয়ে উঠতে পারে।
ডেঙ্গুর প্লাটিলেট প্রয়োগের জন্য যে গাইডলাইন দেওয়া হয়েছে তা মেনে চলাই নিরাপদ জানিয়ে তিনি বলেন, ডেঙ্গুতে প্লাটিলেট কমলেও আবার সেটি তৈরি হয়। প্লাটিলেট যখন রোগীর শরীরে প্রয়োজন তখন তা কাজে লাগবে। অপ্রয়োজনীয়ভাবে যদি প্লাটিলেট দেওয়া হয় তখন শরীরের স্বাভাবিক প্লাটিলেট উৎপাদন ব্যাহত হয়। নতুন করে প্লাটিলেট উৎপাদনে সময় নেয় শরীর। রোগী সুস্থ হতে সময় লেগে যায়।
তিনি বলেন, রোগীর অবস্থার ওপর প্লাটিলেট দেওয়া নির্ভর করে। অনেক সময় রোগীর প্লাটিলেট ১০ হাজারের নিচে নামলেও রক্তক্ষরণ হয় না। রক্তপাত না থাকলে প্লাটিলেট দিতে হবে না। আর রক্তপাত যে শুধু প্লাটিলেটের অভাবে হয় তাও নয়। ডেঙ্গুতে নানা কারণে রক্তপাত হতে পারে। এজন্য গাইডলাইনে বলা হয়েছে ডেঙ্গুরোগীর প্লাটিলেট ১০ হাজারের নিচে নামলে প্লাটিলেট দেওয়ার চিন্তা করার জন্য। আর ২০ হাজারের নিচে নামার পরে যখন রক্তপাত হয় তখন তার জন্য প্লাটিলেট দেওয়া যেতে পারে।
আরও পড়ুন>> ডেঙ্গু আক্রান্তদের ৬০ শতাংশের বেশি পুরুষ
ব্লাড ব্যাংকগুলোর তথ্য অনুযায়ী, বর্তমান ডেঙ্গু মৌসুমে প্লাটিলেট দেওয়া-নেওয়া বেড়েছে তিন-চারগুণ। প্লাটিলেট দেওয়া-নেওয়ায় খরচও বেড়েছে। প্লাটিলেট নেওয়ার পরিমাণ সম্পর্কে জানতে চাইলে কোয়ান্টাম ল্যাবের কর্মকর্তা শামীমা নাসরিন মুন্নি বলেন, জুলাইয়ের শুরুতে হঠাৎ প্লাটিলেটের চাহিদা বেড়ে গেছে। দৈনিক গড়ে ২৫০ ব্যাগ করে প্লাটিলেটের চাহিদা আসছে। অন্য সময় ক্যানসার, অ্যানিমিয়া রোগী কিংবা নবজাতকদের জন্য প্লাটিলেটের চাহিদা আসে। তবে সে চাহিদা ৫০ থেকে ৭০ ব্যাগের বেশি ছিল না।
ডেঙ্গু আক্রান্তদের জন্য প্লাটিলেট কমে যাওয়াটা বড় বিষয় নয়। ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে ঝুঁকির কারণ হতে পারে প্লাজমা লিকেজ। কিন্তু সমাজে ভুল ধারণা আছে। প্লাটিলেট কমলেই পরিবারগুলো উদ্বিগ্ন হয়ে যায়।
প্লাটিলেট নিতে খরচ
খরচের বিষয়ে জানতে চাইলে অধ্যাপক ডা. আশরাফুল হক বলেন, দুভাবে মূলত প্লাটিলেট নেওয়া হয়। একটি হচ্ছে সরাসরি ডোনার থেকে মেশিনের মাধ্যমে প্লাটিলেট নেওয়া। অন্যটি চারজন ডোনার থেকে রক্ত নিয়ে সেই রক্ত থেকে এক ব্যাগ প্লাটিলেট নেওয়া। মেশিনারির মাধ্যমে একজন থেকে নেওয়া প্লাটিলেটে খরচ পড়ে কমপক্ষে ২০ হাজার থেকে হাসপাতালভেদে ৩০ হাজার পর্যন্ত। মেশিনারির মাধ্যমে প্লাটিলেট নেওয়ার জন্য যে কিট ব্যবহার করা হয় তার দাম নিয়ন্ত্রিত নয়। কয়েকটি প্রতিষ্ঠান কিটগুলো আনে। তাদের দেওয়া মূল্যেই মানুষকে তা কিনতে হয়। আর কয়েকজন ডোনার থেকে যে প্লাটিলেট তৈরি করা হয় তার মূল্য ছয় হাজার থেকে ১৪ হাজার টাকা পর্যন্ত।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার (এনসিডিসি) লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন জাগো নিউজকে বলেন, ডেঙ্গু আক্রান্তদের জন্য প্লাটিলেট কমে যাওয়াটা বড় বিষয় নয়। ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে ঝুঁকির কারণ হতে পারে প্লাজমা লিকেজ। কিন্তু সমাজে ভুল ধারণা আছে। প্লাটিলেট কমলেই পরিবারগুলো উদ্বিগ্ন হয়ে যায়।
তিনি বলেন, ডেঙ্গুজনিত মৃত্যুঝুঁকি কমাতে প্লাটিলেট নিয়ে চিন্তিত না হয়ে অন্য লক্ষণের দিকে নজর রাখা জরুরি। এসময় রোগীর রক্তচাপ কমে যাওয়া, অবসাদগ্রস্ততা, ঘাম হওয়া ও বমিভাব– এসব লক্ষণ দেখা দিলে রোগীর শারীরিক অবস্থা গুরুতর হয়ে উঠতে পারে। এসব লক্ষণ দেখা দিলে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীকে তাৎক্ষণিক হাসপাতালে ভর্তি করে ফ্লুইড বা স্যালাইন দেওয়া জরুরি।
আশরাফুল হক বলেন, আমাদের দেশে রক্তদাতার সংখ্যা লিমিটেড। এই সময়ে এসে অযাচিত রক্তের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় রক্তদাতা খুঁজে পাওয়া কষ্টকর হয়ে পড়েছে। এভাবে চলতে থাকলে ক্যানসার আক্রান্ত রোগী বা বিভিন্ন রক্তরোগে আক্রান্ত রোগীদের প্রয়োজনে রক্তের ডোনার পাওয়া সমস্যা হয়ে যাবে। তাই এটি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণ করা উচিত।
এএএম/এএসএ/জিকেএস